|
|
|
|
|
|
|
ফক্কাবাদ |
তিলোত্তমা মজুমদার |
দেশ
জুড়ে দশদিনব্যাপী উৎসব হতে চলেছে। আণবিক, পারমাণবিক ইত্যাদি যত রকম মারণাস্ত্র পৃথিবীর মহাশক্তিধর দেশগুলির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে, তার সেরাটির সফল প্রয়োগ করেছে এই দেশ। এশিয়া মহাদেশের উত্তরপশ্চিম প্রান্তের এক ক্ষুদ্র দেশ।
উৎসবের জন্য কোনও ফরমান জারি করতে হয়নি। এমন বুরবাক কে আছে যে, এমন দিনেও খুশি নয়? তবে কিনা, সব দেশেই থাকে কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চল। ভালমন্দের সরবরাহ সেখানে যথানিয়মে পৌঁছয় না। তা সে খবরই হোক, কী সুযোগসুবিধা। ওই ক্ষুদ্র দেশে সেই রকমই এক রুক্ষ পাহাড়ি গ্রাম ফক্কাবাদ! বড় দুর্দশা সে গ্রামের। পথঘাট প্রায় নেই। শীতে বরফ। গরমে খরা। এক-এক বছর বর্ষা প্রলয় নিয়ে আসে। তখন বড় বড় পাথর গড়িয়ে পড়ে। জীবনধারণই সেখানে কঠিনতম কাজ।
এই ফক্কাবাদেই বসবাস করে রতু আর চন্দা। আরও অনেক দম্পতির মতো তারাও ঘর বেঁধেছে সন্তান-সন্ততিসহ এক সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন নিয়ে। অল্প দিন হল বিয়ে হয়েছে, এখনও বাচ্চা আসেনি।
রতুর ছেলেবেলায় অসুখ করেছিল। কী অসুখ সে জানে না। গ্রামের বৈদ্য জড়িবুটি খাইয়েছিল, কাজ হয়নি। একটি পা শুকনো কাঠি। কোনও মতে লেংচে চলতে সাহায্য করে। বাকি সব অঙ্গ, এই যুবা বয়সে যেমন হওয়া উচিত তার চেয়ে কম পুষ্ট। তাই নিয়েই সে পাথুরে জমিতে চাষ দেয়। অন্তত এক বেলার আহার্য শস্য জোটাবার চেষ্টা করে। ওই সব কম পুষ্ট শরীর মাধ্যমেই সে চন্দার প্রেম পায়। চন্দা তাকে চাষের কাজে সাহায্য করে। ছাগল প্রতিপালন করে। সজীব বুনোলতার মতো তার প্রাণশক্তি। দু’বেলা পেটভরা খাবার সে-ও পায় না। তবে ঈশ্বর অল্প দিয়েই তার শরীরকে ভরাট করেছেন। রতু আর চন্দা, ফক্কাবাদ গ্রামের অন্যদের মতো, যা পেয়েছে, যতটুকু পেয়েছে, তাকেই সুখ-শান্তি বলে জানে।
এক হিমেল সকালে যখন কুয়াশা কেটে গেছে, আরামদায়ক রোদ্দুর ভরা খেতে কাজ করতে এল রতু আর চন্দা। হঠাৎ তাদের অবাক করে দিয়ে একটি ঝোপের আড়াল থেকে দাঁতন করতে করতে বেরিয়ে এল জোলন। হেসে বলল, ‘কী রে চন্দা, কেমন আছিস! ল্যাংড়া রতুকে বিয়ে করেছিস দেখছি। রতু তোর কী কপাল রে! চন্দার মতো মেয়ের জন্য যে কেউ বসতবাটী বাজি রাখবে।’
সে একদলা থুতু ফেলল। ফের দাঁতনকাঠি চিবোচ্ছে। রতু শুকনো হাসল। ল্যাংড়া বলে সে চিরকাল উপহাসের পাত্র, তবু তার লজ্জা ফুরোয়নি। চন্দাকে বিয়ে করেছে বলে অন্য বন্ধুরাও টিটকিরি মেরেছে। জোলন তার সমবয়সী বন্ধু, সেও ব্যঙ্গোক্তি করবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সে বলল, ‘আরে জোলন, কবে এলি?’ ‘এই তো। কাল বিকেলে।’
ফক্কাবাদ যতই দরিদ্র এবং সংগ্রামী হোক, সচরাচর গাঁ ছেড়ে কেউ যায় না। রতুর বাবার যখন যুবক বয়স ছিল, তখন এক জন রাজধানীর উদ্দেশ্যে গিয়েছিল, আর ফেরেনি। তার কী হয়েছে কেউ জানে না। তাদের যাওয়া বলতে গ্রামের নিকটতম বাজার। মাসে এক বার বসে। ছাগল, ভেড়া, খচ্চর, ঘোড়া, গাধা থেকে নুন, আলু, মুরগি, ওষুধপত্র, মদ, শুখা বা কাঁচা মাংস সবই বিকোয়। ফক্কাবাদ থেকে বাজার পর্যন্ত নেমে আসতে লাগে একবেলা। উঠতে পুরো একটি দিন। বিকিকিনির পসরা নিয়ে মাসে ওই একটি বার গ্রামছাড়া হয় লোকজন। বাজারের দিনে আসে। ছাউনিতে রাত্রিবাস করে। পরের দিন ফিরে যায়।
এই সব লোকজনের মধ্যে জোলন ব্যতিক্রম। বাজারের এক সওদাগরের সঙ্গে সে রাজধানী চলে যায় দশ বছর আগে। ক’বছর খোঁজ ছিল না। লোকে ভেবেছিল, সেই রতুর বাবার আমলের মানুষটির মতো জোলন নামের ছেলেটাও বেখবর হয়ে গেল। কিন্তু তাদের ধারণা মেলেনি। অবশেষে যখন সে গ্রামে এল, তার তাগড়াই ঘোড়া, জেল্লাদার পোশাক-আশাক, কথা বলার কায়দা-তরিবত দেখে সকলের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। সবাই বুঝেছিল জোলন ভাল আছে। রতু এবং অন্যান্য তরুণদের মধ্যে স্পষ্টত ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল এই মতদ্বৈধে যে জোলনের মতো রাজধানীতে চলে যাওয়াই ভাল, না গ্রামে থেকে যাওয়া। জোলনের সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনেকেই তদ্বির করেছিল। শেষ পর্যন্ত জোলন সঙ্গে নেয় কেবল মন্তা আর লাজুকে। উঠতি যুবকুলে তারাই তখন দম্পতি।
সেই যে গিয়েছিল, আর এই এল। মন্তা ও লাজু আর আসেনি।
জোলন রতুকে ব্যঙ্গ করছে দেখে চন্দার কষ্ট হল। সে বলল, ‘তোর কি খাবার জুটছিল না জোলন? ভিক্ষে দিচ্ছিল না কেউ রাজধানীতে?’ রতু ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে বলল, ‘কাকে কী বলছ চন্দা? জোলন এখন আমির জনাব। মস্ত লোক। দেখছ না চেহারাটা কী চিকনা! ও কি আমাদের মতো? জোয়ার-বাজরা খেয়ে দিন কাটায়?’ ‘তো কী খায়? আপেল খেজুর মাংস? খেলই বা! আমাদের কী? আমাদের তো আর নেমন্তন্ন করছে না! গরিবকে চেকনাই দেখাতে এসেছে নাকি?’ চন্দা চিড়বিড় করে। জোলন দাঁতনকাঠি ছুড়ে দিয়ে কোমরে বাঁধা জলপাত্র থেকে জল ঢেলে মুখ ধোয়। রতু বলে, ‘কিছু মনে করিস না জোলন। চন্দা কোনও কারণে রেগে আছে।’ ‘আরে আমি কি বুরবাক যে, সুন্দরী চন্দার কথায় রাগ করতে থাকব? তা ছাড়া চন্দা কি আমার পর?’ জোলন কান ছোঁয়া হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেলে। বলে, ‘এত দিন পর ফক্কাবাদ এলাম, তোরা বিয়ে করেছিস, দাওয়াত তো তোরাই দিবি আমাকে। কী রে রতু?’
রতু তাড়াতাড়ি বলে, ‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আজ রাতেই আমাদের ঘরে চলে আয়। তবে কি জোলন, আমাদের গরিবের সংসার। তোর উপযুক্ত সমাদর কি আমরা করতে পারব?’
জোলন বলে, ‘উপযুক্ত সমাদর আবার কী? বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু প্রাণ খুলে সুখদুঃখের গল্প করবে, বন্ধুনির হাতে যা হোক কিছু পেট পুরে খাবে। সেই তো মহা ভোজ।’
পুরনো বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গতা তার স্বরে ও সুরে। রতু খুশি হল। বড়লোক হয়েও জোলন রতুকে আগের চোখেই দেখে। একটু-আধটু ব্যঙ্গ-পরিহাস আর কোন বন্ধু করে না! জোলন ছাড়া বাকি সবার অবস্থাই তো তারই মতো। সেজন্য কি কেউ বেশি বন্ধু হয়ে গেছে, না কম?
জোলন ফিরে যাচ্ছে। রতু কাজে মন দিল। সম্পূর্ণ সুস্থ নয় বলে তার গতি ধীর। চন্দা মুখ গোমড়া করে বলল, ‘কথা নেই বার্তা নেই নেমন্তন্ন দিয়ে বসলে!’ রতু বলে, ‘দিলাম কোথায়? ও তো চেয়ে নিল।’ ‘চাইলেই দিতে হবে? বড়লোক বন্ধুকে খাওয়াবে কী শুনি?’ ‘আমরা যা খাব ও-ও তাই খাবে চন্দা!’ ‘তা বললে হয়? তোমার একটা মানসম্মান নেই?’ ‘তা হলে কী করবে?’ ‘খয়েরি মোরগটা রেখেছিলাম আর একটু মোটা করে পরের হাটে বেচে কিছু জিনিস কিনব, সেটাই কাটি।’ ‘কালকের হাটে যাব না তো আমরা?’ ‘কী করতে যাব? না আছে কেনার পয়সা, না আছে বেচার জিনিস।’
সন্ধ্যায় মোরগের ঝোল পেয়ে জোলন খুব খুশি। বলল, ‘জানতাম বন্ধুনি আমায় শুধু-মুখে বিদায় করবে না। এর সঙ্গে সুরা একটু পেলে জমত খুব। যাকগে, চন্দাকে দেখে এমনিতেই তো নেশা লেগে যাচ্ছে। সত্যি রতু, তোকে দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে। আবার দুঃখও হচ্ছে।’
চন্দা বলল, ‘ঈর্ষার কারণ তো সকালে বুঝেছি, দুঃখের কারণ কি রতুর পা? তা যদি হয় তো শুনে রাখ জোলন, ওই রোগা পুরনো পায়ের জন্য আর দুঃখের প্রয়োজন নেই।’
জোলন বলে, ‘আরে না না। সেকথা না। চন্দা, তুই আমাকে শত্তুর ঠাউরাচ্ছিস কেন বল তো?’
অনেকদিন পরে মোরগের ঝোল পেয়ে রতু বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছিল। এ তো শুধু মাংস ভোজন নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। কারণ, শুধু মোরগ পেলেই ঝোল হয় না। একটু তেল মশলা রসুন পেঁয়াজ লাগে। ঘরে কিছুই ছিল না। চন্দা চেয়ে-চিন্তে সংগ্রহ করেছে। প্রয়োজনের তুলনায় সবই ছিল অপ্রতুল, তবু রান্নায় কী স্বাদ! সুস্বাদে রতু ডুবে ছিল। চন্দা ও জোলনের ঝগড়া বাধে দেখে সে তাড়াতাড়ি বলল, ‘তা জোলন, মন্তা আর লাজুর খবর কী? সেই যে গেল, আর তো এল না।’ ‘কেন আসবে? এই ফক্কাবাদে কেন পচে মরতে আসবে?’ ‘না না। মরতে আসবে কেন? বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি টান বলেও তো একটা কথা আছে। এই যে তুই এত বছর পর পর আসিস, কেন? না টান আছে বলেই তো?’ ‘আরে টান কি ওদের নেই? আছে। সময় পায় না। রাজধানীতে মানুষের জীবন হল চোখের পলক। এই শুরু, এই শেষ।’ ‘মানে?’ ‘এত কাজ, এত কাজ যে দিন কোথা দিয়ে কেটে যায় কেউ ঠাহর করতেই পারে না।’ ‘এই যে তুই এলি, ওরা পারে না কেন?’ ‘আসবে আসবে। এই তো গেল মাসে মন্তা একটা মস্ত ঘোড়া কিনল। তা একটা ঘোড়ায় পুরো পরিবার আসে কী করে? বালবাচ্চা হয়েছে। পরিবার বেড়েছে, এ কি কম কথা?’ ‘তোর পরিবারের কী খবর?’ ‘হা হা! আমি কি বিয়ে করেছি নাকি? আমার সময় কোথায়। গ্রামে আসি কারণ এটা আমার কর্তব্য। মন্তা ও লাজুর মতো আরও যদি কাউকে নিয়ে সুখী জীবন দিতে পারি। কী জানিস, যেতে অনেকেই চায়। কিন্তু সবাইকে নিয়ে যাওয়া যায় না। আর যাবই বা কেন? যে দুর্বল তার পাশে আগে দাঁড়াতে হয়। তুই বলবি মন্তা ও লাজু কীসে দুর্বল? আমি বলব, সে ভাবে দুর্বল না। কিন্তু আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ও-ই প্রথম বিয়ে-শাদি করল। একটু সুখে থাকবে, আমোদে-আহ্লাদে দিন কাটাবে, দেখতে ভাল লাগে না? এই যেমন তোর জন্য আমার দুঃখ হয় বললাম আর চন্দা চটে উঠল। কেন হয় আগে শোন। তুই রতু ভাল মানুষ। রাজধানীতে তোর কত কাজের সুযোগ।’ ‘কীভাবে?’ চন্দা জানতে চায়। জোলন বলে, ‘ওখানকার ব্যাপার-স্যাপার আলাদা। ওখানে অন্ধ কানা ল্যাংড়া নুলো এদের আগে কাজ দেয়। তার পর মেয়েদের।’ ‘মেয়েদের জন্যও ওখানে কাজ আছে?’ ‘থাকবে না? এখন কি আর সেই যুগ আছে যে মেয়েরা শুধু ঘর মুছবে, খানা বানাবে, বাচ্চা পয়দা করবে আর ছাগল চরাবে?’ ‘লাজু কাজ করে?’ ‘করে বই কী। আরে দুর্বল মানুষের পাশে আগে দাঁড়াতে হয়, সেই শিক্ষা তো ওখানেই পেয়েছি। গ্রামে লোকে অক্ষম হলে তার মজাক ওড়ায়, শহরে তার জন্য চোখের জল ফেলে।’ ‘মজাক তো তুই কিছু কম ওড়াচ্ছিলি না সকালে রতুকে নিয়ে।’ চন্দা বলে। জোলন বলে, ‘সত্যি চন্দা, বলিহারি তোর প্রেম। সেই সকাল থেকে এক জিনিস নিয়ে পড়ে আছিস। আচ্ছা, রতু তো আমার ইয়ার, না কী! ইয়ারের সঙ্গে ইয়ারকি করব না? আচ্ছা বাবা মাফি চাইছি। হল?’ ‘আরে ছি ছি! চন্দার কথা রাখ। মাফি চেয়ে দোস্তিকে ছোট করিস না জোলন। তুই বরং বল, আমার মতো লোক সত্যি রাজধানীতে গিয়ে ভাল রোজগার করতে পারবে?’ ‘আলবাত।’ জোলন উত্তর দেয়। চন্দা বলে, ‘তা অতই যদি সহজ, এই ফক্কাবাদ গ্রাম ছাড়া আশেপাশে আরও তো গ্রাম আছে, সব গ্রামের সব লোক উজাড় করে রাজধানীতে চলে যাচ্ছে না কেন?’ ‘ভয়ে। স্রেফ ভয়ে। নতুন জায়গা, নতুন লোক, নতুন কাজ। এ সব ভয় পায়। তা ছাড়া সবার কি জোলন বন্ধু আছে যে জান লড়িয়ে বন্ধুর উপকার করতে লাগবে?’
তাও বটে। রতু ও চন্দা ভাবল। মন্তা ও লাজুকে আমির বানানোর মূলে তো জোলনই। ভাবা যায়, তারা ঘোড়া কিনছে! ক’জনের ভাগ্যে এমন বন্ধু জোটে? দু’জনকে নীরব দেখে জোলন বলল, ‘তাই বলছিলাম, আমি যখন এসে পড়েছি, তোরা আমার সঙ্গে চল। ভাগ্য ফিরে যাবে। তা ছাড়া রাজধানীতে এখন দারুণ সব ব্যাপার ঘটতে চলেছে। এখন কাজ পাওয়া খুব সহজ।’ ‘তুই আছিস ক’দিন?’ ‘দু-চার দিন থাকতাম। কিন্তু তোদের জন্য কালই রওনা দিতে পারি। কাল তো বাজার বসবে। ওখান থেকে একটা ঘোড়া ভাড়া করে নিলে আর চিন্তা নেই। চাই কী একটা ঘোড়া আমি কিনেও নিতে পারি।’
চন্দা বলে, ‘বলিস কী, এই ঘরবাড়ি জমিজমা ছেড়ে কালই চলে যাব? গ্রামে কাউকে বলব না? আলাপ-আলোচনা করব না?’ ‘কর। আমি তো বারণ করিনি। তবে কাল বাজারের দিনে যে সুবিধা, তা পেতে আরও এক মাস। তখন আবার আমি থাকব না। ভেবে দ্যাখ।’ ‘ওখানে গিয়ে থাকব কোথায়?’ ‘কোথায় আবার? মানুষ যেখানে থাকে। লক্ষ লক্ষ ঘর। কোনও একটায় ঢুকে পড়লেই হল। রোজগার করবি, ভাড়া দিবি, থাকবি। কে কী বলবে?’
রতু বলে, ‘দু’বেলাই খেতে পাব রে জোলন?’ ‘দু’বেলা কী রে! চারবেলা পাবি। খেতে পাবি। শুতে পাবি। মজা পাবি। কত আনন্দ উৎসব হই হট্টগোল! চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। অসুখ করলেই হাসপাতাল পাবি।’ ‘হাসপাতালে রতুর পায়ের চিকিৎসা করানো যায় না?’ চন্দা সাগ্রহে বলে। জোলন বলে, ‘যায় না আবার? খুব যায়। আরে ওখানে কুকুর-বেড়ালের পর্যন্ত চিকিচ্ছে হয় তো মানুষ! হাসপাতালে এত খাবার যে বেড়ালগুলো খেয়েদেয়ে নড়তে পারে না। ইঁদুরগুলো ইঁয়া মোটা। ইঁদুর-বেড়ালে ঝগড়া পর্যন্ত ভুলে গেছে। বেহেস্ত রতু বেহেস্ত! যদি কাল যাস, জেনে রাখ, স্বর্গের পথে যাচ্ছিস। আরে ভাল না লাগলে চলে আসবি আবার। যেমন ছিলি তেমন থাকবি। তোদের জমিবাড়ি তো কেড়ে নিতে যাচ্ছে না কেউ।’
যাওয়াই যাক। ভাবল রতু আর চন্দা। ওদের চোখে সমৃদ্ধ সুচিক্কণ জীবনের ঘোর লাগল। আধফলন্ত ক্ষেত্র, আধভাঙা কুটির, আধখাওয়া রুটির টুকরো ফেলে রেখে সেই কাকভোরে দু’জনে বেরিয়ে পড়ল জোলনের সঙ্গে। বাজারের দিন বলে বেশির ভাগ লোক পথে নেমে পড়েছে। জোলন ল্যাংড়া রতু আর সুন্দরী চন্দাকে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে নিজে হেঁটে চলেছে। পায়ের জন্য রতু বাজারে কমই আসে। লোকে ভাবল, বন্ধুর ঘোড়ার সুবিধা পেয়েছে বলে ল্যাংড়া রতু বাজারে চলেছে। কিন্তু তারা যখন শুনল, রতু আর চন্দাকে জোলন রাজধানীতে নিয়ে যাচ্ছে সুখের জীবন দিতে, তখন কেউ কেউ ভারী ঈর্ষা বোধ করল। কেউ কেউ ভয় পেল। কেউ কেউ সন্দেহাকুল হয়ে পড়ল। আর বাজারে পৌঁছে জোলন একটি ঘোড়া কিনে তাতে চেপে বসল।
তিন দিন তিন রাত্রি চলার পর শ্রান্ত ক্লান্ত অভিভূত রতু আর চন্দাকে নিয়ে জোলন উপস্থিত হল রাজধানীর প্রান্তে এক সরাইখানায়। উৎসব শুরু হতে চলেছে। চার দিক আলোয় আলো। রাতের বেলা এত আলোও জ্বলে? রতু ও চন্দা হাঁ করে দেখছে। জোলন তাড়া দিল, ‘চল্ চল্। ও-সব দেখে দেখে পরে চোখ পচে যাবে। এখন স্নান-টান সেরে নে। ভাল পোশাক-টোশাক পর।’ চন্দা বলল, ‘আমি ক্লান্ত। একটু ঘুমোই ভাল করে।’ ‘ঘুমোবি। আগে ভাল করে খাওয়া-দাওয়া কর।’
চন্দা ও রতুর আর সব পোশাক জরাজীর্ণ। টুটাফাটা। একমাত্র বিয়ের পোশাকটাই ছিল পরিষ্কার ও ঝলমলে। স্নান করে ওরা সেই পোশাকই পরল। উৎসবমুখর রাতে পোশাকগুলি ভারী মানানসই। সরাইয়ের বিরাট ভোজনালয়ে তারা আহারে বসল। শিকে গাঁথা কত রকম মাংস! কত রকম চাপাটি! কী সুগন্ধ! কত লোক! কত হাঁক-ডাক। রতু ও চন্দার বিস্ময় ফুরোয় না। তারা জোলনকে খুবই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ধন্যবাদ দিতে লাগল। জোলন কান ছোঁয়া হাসি হাসছে, দলবল নিয়ে এক সেনাকর্তা ঢুকল। জোলন ছুটে গিয়ে তার কাছে আভূমি প্রণত অভিবাদন জানাল। সেনাকর্তা বলল, ‘আরে জোলন যে! ভাল খবর আছে নাকি?’
কথা বলতে বলতে জোলন রতু ও চন্দার কাছে নিয়ে এল কর্তাকে। বলল, ‘একটা নতুন ঘোড়ি কিনেছি। ভাল জাত। নেবেন নাকি?’
কর্তা রতু ও চন্দাকে ভাল করে দেখল। জোলন বলল, ‘এই, কর্তাকে সালাম কর।’
রতু ও চন্দা উঠে অভিবাদন করল ঠিক তেমনি করে যেমন করেছিল জোলন। আর জোলন তো সত্যি একটা ঘোড়া কিনেছে। তা হলে ঘোড়ি বলছে কেন? চন্দা বলে বসল, ‘জোলন, কিনলি ঘোড়া, সাহেবকে ঘোড়ি বলে চালাতে চাইছিস কেন?’
চন্দার কথা শুনে কর্তা হা হা করে হেসে উঠল। কেয়াবাত কেয়াবাত করল কিছুক্ষণ। অতঃপর বলল, ‘তা হলে জোলন, আমার ঘরে আয়। দাম-টাম ঠিক হয়ে যাক।’ কর্তা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে খেতে বসল। আর খাওয়া সেরে রতু আর চন্দা এমন ঘুমোল যে তাদের আর জ্ঞান রইল না।
সকালবেলায় ঘুম ভাঙল রতুর। দেখে পাশে চন্দা নেই। ভাবল, বোধ হয় বাইরে ঘুরছে ফিরছে। কিন্তু কোথায় সে? চন্দা নেই, জোলন নেই, এমনকী সাঙ্গপাঙ্গসহ সেনাকর্তাও উধাও। বরবেশে ল্যাংড়া রতু হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল। তার কান্না দেখে লোক জুটে গেল এবং বউ হারিয়েছে শুনে তারা সহানুভূতিও দেখাল বটে, তবে কিনা উৎসব শুরু হয়ে গেছে, কান্নাকাটি শোনার সময় নেই লোকের। কেউ বলল শহরে যাও, খুঁজে পাবে। কেউ বলল, দু’-চার দিন থাকো, ফিরে আসবে। কিন্তু টাকাকড়ি নেই, আঙুলে একটা দামি আংটিও নেই যে কেড়ে নেবে, সরাইমালিক রতুকে গলাধাক্কা দিল। দিন নেই রাত নেই ল্যাংড়া রতু পথ চলে। নাওয়া নেই খাওয়া নেই চন্দাকে খুঁজে খুঁজে পাগল। চুল রুক্ষ, উস্কোখুস্কো। পোশাক ধূলিমলিন। গালে ক’দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখে অসহায় যন্ত্রণার ছাপ, রতু এসে পৌঁছল রাজধানীর প্রধান অঞ্চলে। উৎসবের উল্লাসে, হাজার হাজার লোকের মাঝে কোথাকার কোন ফক্কাবাদের রতু আর রতু রইল না। একটা লোক মাত্র হয়ে গেল। জনগণ পথে নেমে নাচাগানা করছে। হাজার হাজার জাতীয় পতাকা পতপত করে উড়ছে। বাচ্চারা হাতে কাগজের পতাকা নিয়ে ছুটছে। এর মধ্যে লোকটাকে পেড়ে ফেলল শোকের মধ্যে সেরা শোক ক্ষুধা। একে রোগা। তায় ক’দিন খায়নি। গ্রামে যাহোক কিছু খেত। লজ্জায় হাত পাতবেই বা কী করে! কিন্তু আর যে পারে না। ভুল করে খাবার চেয়ে বসল এক সেনাকর্তার কাছে। সেনারা টহল দিচ্ছিল রাস্তায়, যাতে এই আনন্দের দিনে প্রতিবেশী কিন্তু শত্রু দেশ কোনও চক্রান্ত করতে না পারে। লোকটি শুকনো মুখে খাবার চাওয়ায় সেনাকর্তা বলল এত খাই খাই কীসের? নাচ!
আমি যে খোঁড়া লোক সাহেব।
তবু নাচবি। যেমন করে পারিস।
নাচব?
হ্যাঁ নাচবি। আজ আনন্দের দিন। উৎসবের প্রধান দিন আজ। দেখতে পাচ্ছিস, সবাই কেমন নাচতে নাচতে বেহুঁশ? আজ যে যত খুশি সুরা পান করবে, খরচ দেবে সরকার।
সুরা না সাহেব। একটু খাবার চাই। খাব, খেয়ে বউকে খুঁজব। আমার বউ হারিয়ে গেছে।
লোকটা হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগল। সেনাকর্তা ঠাস করে চড় কষিয়ে বলল আনন্দের দিনে কাঁদিস? ল্যাংড়া কোথাকার। দ্যাখ বউ মজা লুটতে কার সঙ্গে ভেগেছে!
না না সাহেব। তা হতে পারে না।
চোপ্। আনন্দ কর।
কীসের আনন্দ সাহেব?
দেশ নিউক্লীয় বোমা ফাটিয়েছে, জানিস না উজবুক? হা হা হা! আমরা এখন শক্তিমান।
সাহেব ক’দিন ভুখা আছি। একটা দানা পড়েনি পেটে।
তো কী হয়েছে? ভুখপেট থেকে রোজা রাখতে পারো, পূজা করতে পারো, ভুখ হরতাল করতে পারো, আর আনন্দে নাচতে পারো না স্রেফ ক’দিন খাওনি বলে? কেন? তোর আনন্দ হচ্ছে না?
না সাহেব!
হচ্ছে না?
না সাহেব!
দেশদ্রোহী!
এক লাথি মারল লোকটার তলপেটে। লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল। বমি করার উপক্রম হল, কিছু বেরোল না। কর্তা হাততালি দিল। দু’জন সৈনিক ছুটে এল। কর্তা বলল, ‘নিউক্লীয় বোমার নামে শপথ। এ দেশদ্রোহী। বিদেশি গুপ্তচরও হতে পারে। একে নিয়ে যাও। বন্দি করো।’
বলা মাত্র সৈনিকরা লোকটাকে বেঁধে ফেলল পিছমোড়া করে। বাঁধবার কাটবার ছিন্নভিন্ন করবার অস্ত্র সদাই মজুত সঙ্গে। এ বার তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলল কোথায় কে জানে। অনাহারী দুর্বল লোকটার মাথার ভেতর নানা রঙের ভোজবাজি চলছিল। দলবদ্ধ উল্লসিত চিৎকারে সে আকাশের দিকে তাকাল। সবিস্ময়ে দেখল তার মাথার ভোজবাজি এখন আকাশভরা আলোর খেলা। সৈনিকদ্বয় সেদিকে তাকিয়ে স্যালুট করল। এক জন হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘এই সেই ক্ষণ...’
অপরজন বলল, ‘মহান বিজ্ঞানীরা সম্মানিত হলেন...’ ‘তাঁরা আজ সামরিক পোশাকে সজ্জিত...’ ‘আজ বড় আনন্দের দিন। দেশ সাবালক হল...’
হঠাৎ একখানা জাতীয় পতাকা উড়ে এসে পড়ল। লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল তার ওপর।
এক জন সৈনিক বলল, ‘দ্যাখ, এই মহাক্ষণে লোকটা জাতীয় পতাকা চুম্বন করছে।’
অপরজন বলল, ‘তা হলে বোধ হয় দেশদ্রোহী নয়।’
জাতীয় পতাকা ভিজে উঠল।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|