|
|
|
|
|
|
|
আয়লা ২০১১ |
ফুরিয়ে গিয়েছে আমাদের চাঁদা দেওয়া চৈতন্য। ঘুরে গিয়েছে মিডিয়ার চোখ।
চাপা পড়ে আছে সুন্দরবনের মানুষের জীবন। কাদামাখা খিদে ঢাকা ভুলে যাওয়া। লিখছেন স্বাতী ভট্টাচার্য |
তুমি আমার ঘরে এলে দিদি, এমন জায়গা নেই যে তোমাকে একটু বসতে দিই।
ভারী লজ্জা পেয়েছেন অঞ্জলি সর্দার। সত্যিই তো, একটা হাতল-ভাঙা চেয়ার কী নড়বড়ে বেঞ্চি দূরস্থান, একটা পাটিও চোখে পড়ে না। স্টিলের গেলাস নেই, ছোপ-লাগা কাপ-ডিশ নেই, অ্যালুমিনিয়াম কাঁসির উপর বসানো ঝাপসা কাচের গেলাস নেই। আছে কেবল ঘরটা, সে যে তাঁর নিজের হাতে তৈরি তা দেখেই বোঝা যায়। তাড়া খেয়ে কোণঠাসা কুকুরের মতো, ঘরখানা যেন নিজের মধ্যে নিজে সিঁধিয়ে যেতে চাইছে। দেওয়াল বলতে কোমর পর্যন্ত কাদা-মাটির পাঁচিল, তার উপরে বন থেকে কুড়িয়ে-কেটে আনা সরু মোটা আঁকাবাঁকা গাছের ডাল। এ বাড়ির সবই অসমান, কোনও দিক ঝুলে পড়ছে, কোনও দিক বেখাপ্পা উঁচিয়ে রয়েছে। খড়-ছাওয়া, কঞ্চি-ঘেরা ঘরে ঢাকার চাইতে ফাঁকা বেশি। যারা এখানে মাথা-গুঁজে থাকে, তাদের জীবনটা কেমন, তা টের পাওয়া যায় এই ঘরে দাঁড়ালে।
এ ঘরে আসার পথটিও তেমন। পথ ঠিক নয়, আয়লা ঝড়ে সব তছনছ হয়ে যাওয়ার পর ভেড়ির মালিকরা নতুন করে জমি ঘিরেছে জল ধরে রাখতে। সে কেবল কাদা-মাটির দেওয়াল, উপরটা সমান করার চেষ্টাও কেউ করেনি। শীত বলে মাটি শক্ত, ঢেলা ঢেলা শুকনো কাদার এবড়ো খেবড়ো একটা ফালি বেয়ে হেঁটে আসতে হয় বাড়িতে। ‘বর্ষাকালে যা দশা হয়, জল আনতে গিয়ে মাসে দু’তিনটে কলসি ভাঙে।’
সে জল কেমন? আমাদের সঙ্গীরা বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘বোতলে জল নিয়ে যাবেন, গ্রামের জল খেলেই জন্ডিস।’ সেই জল আনতে মেয়েরা গ্রামের নানা কোণ থেকে আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা হেঁটে কোনও টিউবওয়েলে পৌঁছন। বাসন্তী ব্লকের এই হরেকৃষ্ণপুরে একশোটা পরিবারের জন্য একটা টিউবওয়েল। ‘জল কেমন?’ জিজ্ঞেস করতেই নানা বয়সের মেয়েরা একযোগে মাথা কাত করলেন। ‘জল ভাল।’ জল নিয়ে ওঁদের কোনও নালিশ নেই।
নালিশ নেই খাওয়া-দাওয়া নিয়েও। ‘কাল কী খেলেন?’ প্রশ্ন করতেই পৌষী সিংহ, কানন দলুইরা এ ওর গায়ে ঢলে পড়লেন। ওঁদের শাড়ির প্রান্ত হাঁটুতে শেষ, পায়ের গোছ ঢাকা পুরু কাদার প্রলেপ শুকিয়ে সাদা, চুল রুক্ষ, কিন্তু মুখের হাসি যেন কাশের বন। হরেকৃষ্ণপুরে গোটা চল্লিশ ঘর বাগদি রয়েছে, ওঁরা সেই সব বাড়ির মা-শাশুড়ি-বউমা। ‘ভাত, কাঁকড়া আর শাপলা দিয়ে তরকারি।’ ওই কাঁকড়া ধরতে ওঁরা রাত থাকতে বেরিয়ে যান। সে অনেক দূর, যেতে বহুক্ষণ লাগে। ভোর চারটে থেকে কাদার উপর কাঁকড়ার পায়ের চিহ্ন দেখে গর্ত নিশানা করে শিক ঢুকিয়ে বসে থাকেন, তাতেও কাজ না হলে হাত ঢুকিয়ে তুলতে হয়। কিন্তু কাঁকড়ার দাঁড়া যদি কামড়ে ধরে হাতে? ‘তখন বাবা গো মা গো বলে চেঁচাই!’ কাঁকড়া ওঁরা বিক্রি করেন, দেড় ঘণ্টা হেঁটে বাজারে গিয়ে। বেশ বড় বড় কাঁকড়াগুলো ৫০ টাকাতে বিক্রি হয়। আরও সুখাদ্য আছে এক জন একটা টিন খুলে দেখালেন, চকচকে রুপোলি চুনোমাছ। অনেক সময় লাগে, অনেক কষ্ট হয় এ সব জোগাড় করতে। কিন্তু পাওয়া তো যাচ্ছে খাবার মাটি থেকে, জল থেকে। ‘কলের জল ছাড়া সবই কিনে খেতে হয়,’ কলরব করে বললেন ওরা। ‘বেগুন উনিশ টাকা কিলো, পালং শাক ছোঁয়া যায় না।’ ডাল শেষ কবে খেয়েছিলেন? বেশ একটু ভেবে ওঁদের এক জন বললেন, ‘মনে পড়ে না।’ আচ্ছা, পুজোর দিন কী খেয়েছিলেন? শুনেই তাঁর মুখ যেন আলো হয়ে উঠল। একগাল হেসে বললেন, ‘পুজোর দিন রুটি খেয়েছিলাম। সঙ্গে আলু আর বুটের তরকারি। অষ্টমীর দিন ছিল।’
আপনারা কী চান? শুনেই ওঁরা একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘কাজ, কাজ দাও আমাদের। যে কোনও কাজ।’ রেশন নয়, টাকা নয়, কাজ।
এ বছর একশো দিনের প্রকল্পে সুন্দরবনে কাজ হয়েছে ১৭ দিন।
|
দিনভর দুর্যোগ |
যারা মনে করে আয়লা হয়েছিল ২৫ মে ২০০৯, তারা সুন্দরবনের বাইরের লোক। যাঁরা সুন্দরবনে বাস করেন, তাঁদের জীবনে আয়লা চলেছে নিত্য দিন। মৃত পরমাত্মীয়, ফেলে-আসা বাস্তুভিটে, দুর্ঘটনায় হারানো দেহখণ্ড, এ সবের মতো আয়লার দেগে যাওয়া ক্ষতস্থান রোজ দপদপ করে। জীবন যেন প্রতিদিন আরও কর্কশ হয়ে উঠছে, ভাগ্য যেন বিদ্রুপ করে তাকাচ্ছে এক চোখ কুঁচকে। তুই আর আয়লা-দুর্গত নোস বাপ, তুই আবার গরিবের ছাপমারা ছকে ফিরে গিয়েছিস ভূমিহীন, দিনমজুর, গ্রামছুট শ্রমিক, বিধবা-ভাতার প্রাপক। বি পি এল, জব কার্ড হোল্ডার, এস সি-এস টি। আয়লার জল সরে গেল, ক্যানিং, গোসাবা, বাসন্তী, হিঙ্গলগঞ্জের মানুষ ভোট দিল দু-দুবার, জমানা বদল হল, আবার আয়লা তোলা কেন?
কী আর করা, জমি থেকে নুন যে সরে যায়নি আজও। ‘যে রবি শস্যের জন্য সুন্দরবন বিখ্যাত ছিল, তা এখন কই?’ বলছিলেন বাসন্তীর নানা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানরা। নব্বই শতাংশ জমি আগের উর্বরতা হারিয়েছে। ধানের পর ডাল ছিল এদের দ্বিতীয় শস্য। ‘বাসন্তী থেকে মুগ ডাল হত, তা ধরুন অন্তত ১০-১৫ হাজার কুইন্টাল। আর খেসারি, সেও ১০-১২ হাজার কুইন্টাল। সে সব আর নেই।’ বর্ষায় হত ঢ্যাড়শ, বরবটি, কুমড়ো, ঝিঙে, শশা। শীতে মুলো, পালং। কুমড়ো, তরমুজ, লঙ্কার জন্য সুন্দরবন নাকি বিখ্যাত ছিল। আর আজ? ‘সবজি ফলন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে বললেই হয়,’ বললেন এক জন। নফরগঞ্জের মেয়েরা নালিশ করলেন, ‘কত কলা গাছ হত এখানে, এখন কত বার কলা লাগাচ্ছি, কিছুতে হচ্ছে না।’ হচ্ছে না আম, জাম, বেল, পেয়ারা সব গাছ ক্রমশ মরে গিয়েছে। রয়ে গিয়েছে কেবল নারকোল, আর কিছু সবেদা। |
|
ছবি: সুমন বল্লভ
|
এ দিকে কী এক ভাইরাস লেগেছে মাছে, ১৫-২০ গ্রাম হওয়ার পরই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মাছগুলো। আগেও মাঝেসাঝে এ রোগ হয়েছে, কিন্তু এখন একেবারে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। ধান যা-ও বা হয়েছিল, পুজোর আগের অতিবৃষ্টিতে গেছে বেশির ভাগই স্লুইস গেটগুলো কাজ করেনি, নিকাশি ব্যবস্থা বলে কিছু আর নেই। আর যা ছিল, তার অর্ধেক গিয়েছে গত ক’মাসের খরায়। শুনতে শুনতে যেন হাঁপ ধরে যায় বাপ রে, এ যে দুর্ভাগ্যের এভালাঁশ। যদি ডুবে না মরো, তেষ্টায় মরবে। যদি পচে না যায় ধান, খরায় শুকোবে। এ কেমন বাঁচা?
|
বাঘ, কুমির, সরকার |
ওদের বেঁচে থাকার একটা সরকারি ছবি পাওয়া যায়। সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের ওয়েবসাইট বলছে, ওখানে নাকি ৭০ শতাংশ মানুষের কাজ নেই। চাষিদের অর্ধেক খেতমজুর। চার দিক জলে জলাকার হলে হবে কী, সেচের জল পায় অতি সামান্য (১২%) জমি। দশটায় সাতটা গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। মেয়েদের বিয়ে হয় ১৪ বছরে, সন্তান হয় ১৬ বছরে। শিশুরা পাচার হয়ে যায় প্রায়ই, যারা থেকে যায় তারাও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইস্কুল ছেড়ে নানা কাজে লেগে পড়ে, নইলে “এমপ্লয়মেন্ট অপারচুনিটি”র অভাবে বাগদার মিন ধরে। ইয়েস স্যর, এ একেবারে সরকারি দফতরের বয়ান (www.sadepartmentwb.org)।
যা লেখা যায় না সরকারি নথি-পত্রে, তা হল পঞ্চায়েতি রাজ ওই সব জল-ঘেরা গ্রামে হয়ে উঠেছে কনট্র্যাক্টর রাজ, বাঁধ-মাফিয়া রাজ। বাঁধ তৈরির বরাত যারা পায়, তাদের মুখের ওপর কথা বলার সাহস কার আছে? নদীর ধারে যেখানে শালের খুঁটি পোঁতার কথা, সেখানে কঞ্চি বাঁশ পুঁতলেও কেউ টুঁ শব্দটি করবে না। বাসন্তীর সোনাগাঁয়ের পাশে বাঁধের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাদায় পোঁতা বাঁশের খাঁচা দেখে শিউরে উঠছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা সাংবাদিক সুমনা চৌধুরী। ‘দেখছেন, সব কাঁচা বাঁশ। হাতখানেক দূরে পোঁতার কথা, কত দূর দূর পুঁতেছে দেখুন। এ কখনও থাকে?’ ওখানে যে কাঠামো ওরা করতে চেয়েছে, তার জন্য যত বাঁশ দরকার, সুমনার মতে তার দশ শতাংশ বাঁশও লাগানো হয়নি। শাল বল্লা একটাও নেই। ‘এত খারাপ কাজ উত্তর ২৪ পরগনা বা দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোথাও দেখিনি,’ বললেন সুমনা। যত প্রত্যন্ত গ্রাম, তত যেন কাজ খারাপ। খাতায় কলমে দেখা যাবে সব হয়েছে, আদতে হয়নি কিছুই। সামান্য ঝড়ে-জোয়ারে ভেঙে পড়বে জল রোখার ব্যবস্থা। স্থানীয় সংবাদপত্রে অভিযোগ, সুন্দরবনের নানা গ্রাম পঞ্চায়েতের বহু প্রধান-উপ প্রধান নাকি আজকাল কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে গিয়ে নিজের বাড়িতেই ওঠেন। সল্ট লেক, নিউ টাউনে। আর রাইটার্স থেকে যাঁরা বাঁধের কাজ দেখতে আসেন, তাঁরা ভাতের পাতে সাত-আট রকম মাছ খেয়ে ফিরে যান।
আর গরিবের ঘরবাড়ি? যেদিন ভেসে যাবে, সেদিন বউ-ছেলে নিয়ে, কিংবা না নিয়ে, ওরা বেরিয়ে যাবে শহরের দিকে। যারা সেচ দফতরকে প্রশ্ন করতে পারত, কত খরচে কত কিলোমিটার বাঁধ বানালে বাপু হে, কী দিয়েই বা বানালে? যারা বলতে পারত বন দফতরকে, যে বিপুল খরচ দেখিয়েছ ম্যানগ্রোভ চারা পোঁতার জন্য তাতে কত হেক্টর বন গজিয়েছে দেখাও দেখি? সেই লোকগুলো হারিয়ে যাবে কলকাতা, দিল্লি, পুণে, মুম্বই, চেন্নাই, আন্দামানের ভিড়ে। যে মানুষগুলো চিরকাল জলে কুমির ডাঙায় বাঘ নিয়ে কাটিয়ে এল, তারা দুর্নীতির সামনে দাঁড়াতে পারল না। যারা থেকে গেল, নেতারা তাদের হাতে এক প্যাকেট বিস্কুট, দুটো ত্রিপল কী এক প্যাকেট বীজ দিয়ে বলবে, ‘লিখে রেখো, আমি দিলাম।’
ঝড়ের পর ব্যাঙ্কগুলো নাকি তড়িঘড়ি বিনে পয়সায় অ্যাকাউন্ট খুলে দিচ্ছিল যাতে বাড়ি বানানোর টাকা পাঠাতে পারে সরকার। দুর্নীতি রোখার সরকারি দাওয়াই। আর আজকাল টাকা না দিলে অ্যাকাউন্ট খুলছে না ব্যাঙ্ক, নালিশ করলেন বাসন্তীর নানা পঞ্চায়েতের কর্তারা। এদিকে স্থানীয় নানা কাগজে অভিযোগ, প্রধানরা নাকি একশো টাকা না নিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলার আবেদনে সই করেন না। যাদের বাড়ি পড়ে গিয়েছে, তারা টাকা পায়নি। যাদের দোতলা বাড়ি, টাকা পেয়েছে তারা। কয়েকশো পুকুরকে নুনমুক্ত করার টাকা দিয়ে কাজ হয়েছে ৪০-৫০টা পুকুরে।
সুন্দরবনকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছিলেন মির জাফর, ১৭৫৭ সালের চুক্তিতে। তারপর তা হয়ে ওঠে লর্ড ক্লাইভের জাগিরদারি। ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।’
|
ঘর বেঁধেছি শূন্যে |
উন্নয়ন বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, তা ক্ষতিপূরণ। সে বস্তুটিও কম নয়, তার আন্দাজ দিলেন অঞ্জলি। ঘর বানানোর বাঁশের দাম দুশো টাকা করে, চল্লিশখানা তো লাগবেই। ভ্যানভাড়া ৫০ টাকা। অন্য পাড়ার বাসিন্দা মিতা দাস বললেন, ‘রান্নাঘরটা পড়ে গিয়েছিল, সেটা তুলতে পেরেছি, কিন্তু বাড়িটা হেলে গিয়েছে আয়লায়, সে তেমনই রয়েছে।’ তিন বছর যে হেলে-যাওয়া বাড়িতে থাকে, সরকারের মতে তারও টাকা পাওয়ার অধিকার নেই। আংশিক ক্ষতিপূরণের আড়াই হাজার টাকা, পুরো ক্ষতিপূরণের দশ হাজার টাকা, কোনও একটা যদি পেতেন এই কাঁকড়া-শাপলা খাওয়া মেয়েরা! ‘আমরা লিস্টেই নেই,’ জানিয়ে দিল ওরা। হরেকৃষ্ণপুরের চল্লিশ ঘর বাগদি বি পি এল কার্ডও পায়নি। অবশ্য যাঁরা ক্ষতিপূরণের লিস্টে রয়েছেন, তাঁরাও সকলে টাকা পাননি। বাসন্তী ব্লকে মোট ৫৪ কোটি টাকা নাকি দেওয়ার ছিল, কেবল ভেসে-যাওয়া বাড়ির ক্ষতিপূরণ হিসেবে। তার মধ্যে ২৪ কোটি দেওয়া হয়েছে, বাকিগুলো নিয়ে দাবি-ডেপুটেশন চলছে আজও।
সৈয়দ মুজতবা আলি লিখেছিলেন তাঁর গ্রামের পণ্ডিতমশায়ের কথা, যিনি হিসেব করে দেখিয়েছিলেন, তাঁর আট-ন’জনের পরিবারের জন্য যা মাইনে পান তিনি, স্কুল ইনস্পেকটর সাহেবের কুকুরের একটা ঠ্যাঙের জন্য খরচ হয় তার চেয়ে বেশি। আজ ভয় হয়, বাসন্তী ব্লকের কেউ কি শুনে ফেলেছেন যে মুম্বইয়ে একখানা বাড়ি তৈরি হচ্ছে, যার খরচ ৬০ কোটি টাকা? ওঁদের গোটা ব্লকের সব ভাঙা বাড়ি বানানোর যা খরচ দেবে সরকার, তার চাইতেও বেশি ওই বাড়ির দাম? |
|
ছবি: সনৎকুমার সিংহ
|
ঘরণীই নাকি ঘর। কথাটা কত সত্যি, তা বুঝতে যেতে হয় সুন্দরবনে। দশ জনে ন’জন পুরুষ ভিন রাজ্যে কাজ করছে, অল্প বয়সী মেয়েদের একটা বড় অংশ কাজ করতে যায় বাইরে। বাড়ি সামলাচ্ছেন মা-শাশুড়িরা। এই ৪০-৫৫ বয়সী মেয়েরা গোটা এলাকাটাকে যেন দশ হাতে ধরে রেখেছেন। দৈনন্দিন খাবার, জ্বালানি, জলের জোগান, ছাদের ছাউনি বা দেওয়ালে মাটি লেপা তো করেই যাচ্ছেন। আবার তাঁদের উপরেই গ্রামের হাজার কাজ চাপছে। বাসন্তী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান আলেপ মোল্লা বললেন, ‘পঞ্চায়েতে আমরা মিটিং করতে পারি না, মেয়েরা কিন্তু মিটিং করে।’ স্বাস্থ্য, পরিবেশ নিয়ে প্রকল্পের প্রচার, কার বাড়ি শৌচাগার বসবে তার তালিকা, এ সব কাজ করিয়ে নেওয়া হয় মেয়েদের দিয়ে। আর ওঁরা যখন পঞ্চায়েতে গিয়ে বলেন, কাজ দাও, ঋ
ণের ব্যবস্থা করে দাও, মদের ভাটি উঠিয়ে দাও? নফরগঞ্জের মেয়েরা বললেন, ‘তখন বলে, তোমাদের কথা মাথায় রাখা হবে। তার পর কিছুই করে না। ওই জন্য তো আমরা যাই না।’
ঝর্না হালদার ক্যানিং-এর নিকারিঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান। বললেন, ‘পঞ্চায়েত মেয়েদের কাজ দিতে পারছে না, কাজ করালে পয়সা দিতে পারছে না। মায়েরা বাধ্য হয়ে বাচ্চাদের ফেলে রেখে কাজে যায়। আমাদের গ্রামের সব মেয়েই ঝি-গিরি করে। বাচ্চাগুলো বাড়িতে পড়ে থাকে। কেউ হয়তো পেটের জ্বালায় অঙ্গনওয়াড়িতে যায়, কিন্তু পড়াশোনা করে না।’
২০০৯ সালের মে মাসে যে জন্মায়নি, সেই শিশুও আয়লা-দুর্গত থাকবে গোটা জীবন।
|
কয়েন না, বাঘায় হাসব |
সুন্দরবনে ফোটা ফুলের খোঁজে সেই কাশ্মীর থেকে ছুটে আসে মৌমাছিরা। কিন্তু কলকাতার ক’টা লোকই বা সুন্দরবন যায়? রাত নামলেই অন্ধকার, বাঘগুলো বেয়াদপি করে লুকিয়ে থাকে, মাল্টি-ক্যুজিন রেস্তোরাঁ নেই, এ সি ডিলাক্স রুম পাওয়া যায় না। ওই লঞ্চ ভ্রমণটাই যা, তাও বোটের বাথরুমগুলো সুবিধের নয়।
সরকারও কি তেমন ভাবে? সুন্দরবন উন্নয়ন দফতর ময়ূখ ভবনে। সেখানে সুন্দরবন দিবসের (২১ অগস্ট) পোস্টার, উপরে বাঁ দিকে মস্ত বাঘ, নীচের বাঁ দিকে মস্ত কুমির, ডানদিকের নীচে গোটা তিনেক হরিণ, মধ্যিখানে একটা টুরিস্ট লঞ্চ। আর ডানদিকের উপরে পুঁচকি কী এক প্রাণী, দূর থেকে ঠাহর হয় না। কাছে গেলে বোঝা গেল, জাল ফেলছে এক মানুষ।
দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্যামল মণ্ডল। তিনি নিজে ক্যানিং-এরই মানুষ, এলাকার হাল ভাল বোঝেন। অফিসারদের তাড়া দিচ্ছেন, ‘কার্তিক মাস চলে গেল, সূর্যমুখী, খেসারির বীজ আর কবে দেবেন? আড়াই মাসে একটা ফাইল ক্লিয়ার হয় না?’ চেয়ারে জাম হয়ে বসে থাকা অফিসার বললেন, ‘কী বলব স্যর, আমি নিজে দু’দিন গিয়েছি।’ অফিসারদের তৎপরতার নমুনা, দফতরের ওয়েবসাইট আজও জানাচ্ছে, মন্ত্রীর নাম শ্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। মন্ত্রীর নাম বদলায় না, ভোটারদের নসিব বদলাবে?
আয়লার পর যে বিপুল টাকা এসেছিল, তাতে তিন বছরের মধ্যে সব বাঁধ তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সামান্যই হয়েছে। কীসের বাঁধ হবে? মন্ত্রী বললেন, ‘ফুল কংক্রিট’ বাঁধ হবে ১১৩২ কিলোমিটার। সচিব বললেন, ‘লোকাল মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি ব্লক’ দিয়ে হবে, মাটির বাঁধও থাকবে অনেকটা। মানুষ কাজ পাবে কি?
‘আমরা ঠিকাদারকে বলে দিয়েছি, ২০ শতাংশ লেবার নিতে হবে স্থানীয় মানুষকে,’ বললেন শ্যামলবাবু। কাজ পেল কি না, নজর রাখবে কে? সেচ দফতর, বি ডি ও, বিধায়ক-সাংসদ, প্রধান-সভাপতির কমিটি।
কিন্তু এরা নজর রাখলে তো দুর্নীতি হতেই পারত না। শেয়ালমাস্টার কুমিরছানার হেফাজত করছে বলেই না ...
‘কমপ্লেন এলেই শাস্তি হবে,’ বললেন মন্ত্রী।
ঢাকাই কুট্টি হলে বলত, কয়েন না দাদা, বাঘায় হাসব। সুন্দরবনের মেয়েরা ওসব বলেন না। ওঁরা লেবার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবেন এক পা কাদা মেখে, ছেলেমেয়েদের ফাঁকা বাড়িতে ফেলে রেখে, নিজে এক পেট খিদে নিয়ে। যে বাঁধ বন্যায় টিকবে না, সে বাঁধের জন্য সারা দিন মাটি কেটে, মাটি ফেলে, ন্যূনতম মজুরির চেয়েও কম ক’টা টাকা হাতে নিয়ে হাঁটা দেবেন বাড়ির দিকে।
পৌষী, কানন, অঞ্জলিদের জীবনে সে দিনটা বড় ভাল দিন। |
|
|
|
|
|