ব্যাগ গুছিয়ে...
ঠাকুরবাড়ির
ঠেলাঠেলি...
গ্রামের মেলা দেখার সুযোগ আজকাল তো বড় একটা হয় না। রথের মেলাতেও যে শেষ কবে গিয়েছি, মনেই পড়ে না। গাড়ি থেকে নামতেই তাই সবার আগে মনকে স্মৃতিমেদুর করে দিল স্নানযাত্রার মেলা। সাজ-সরঞ্জাম সামান্যই। ইতিউতি গোটা দুয়েক নাগরদোলা। কাঁচা রাস্তার দু’ধারে বড় লণ্ঠন নিয়ে বসে কাঁসার বাসন, মাটির ও কাঠের পুতুল আর চাকি-বেলনের ব্যাপারীরা। জিলিপি আর পাঁপড় ভাজা হচ্ছে এক জায়গায়। আছে ঘুগনিওয়ালাও। রাত্রিবেলা যাত্রা বসবে। পালাগানের দল এসে গিয়েছে আগেই। মেলার মাঠ ছাড়িয়ে এগোতেই সামনে পড়ল ঠাকুরবাড়ির দরজা। এসে পড়েছি শ্রীপাটে।
তবে শুধু মেলা উপলক্ষেই নয়, এখানে আসা যায় বছরের যে কোনও সময়।
মতিঝিলের কাছেই শ্রীপাট কুমারপাড়া। গৌড়ীয় বৈষ্ণব শ্রীপাটে আছেন প্রায় চারশো বছরের পুরনো কষ্টিপাথরের মাধব আর রাধারানি। আর আছেন গৌর-নিতাই। কাছেপিঠের গ্রামের মানুষদের নিত্য যাওয়া-আসা এখানে। স্নানযাত্রাই সব চেয়ে বড় উৎসব। তবে দোল এবং জন্মাষ্টমীতেও উৎসব হয়। প্রায় তিনশো বছরের মুর্শিদাবাদে চারশো বছরের রাধামাধব। তাই হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয় স্নানযাত্রায়।
স্নানযাত্রার দিন বৃষ্টি হবেই। এমনটাই নাকি দস্তুর, বলছিল রাধা বোষ্টমী। রাধারানির নামে নাম তার। বাড়ির কথা জানতে চাইলেই বলে, “আমার জীবনমরণ সব এই রাধামাধবতলাতেই গো! যখন ঠাকুরবাড়ির ঘর-দালান ধোয়া-মোছা করি, যেন মাধবেরই নরম পায়ের ছোঁয়া পাই!” স্নানযাত্রা উপলক্ষে ঠাকুরবাড়িতে সাজ সাজ রব। দূর-দূরান্ত থেকে এসে পড়েছেন ভক্তেরা। জানতে ইচ্ছে হল, স্নানযাত্রায় কী হবে এখানে?
মূল মন্দির থেকে কষ্টিপাথরের মাধব যাবেন স্নানমন্দিরে। দুধ-জল ঢেলে স্নান করানো হবে মাধবকে। আর তাই স্বচক্ষে দেখতে আকাশভাঙা বৃষ্টির মধ্যে কাকভেজা ভিজবে সারে সারে কালো মাথা। সেই সঙ্গে সকাল থেকেই চলছে সামিয়ানা খাটিয়ে ভোগ রান্না। অগণিত ভক্ত-শরণার্থীদের তো পাত পড়বে ঠাকুরবাড়িতেই। পদ্মপাতায় মাধবের প্রসাদ ‘পুষ্পান্ন’ খেয়ে ধন্য হবে সকলে!
প্রায় চারশো বছর আগে স্নানপূর্ণিমার দিনেই নাকি শ্রীজীব গোস্বামীর নির্দেশে শিষ্য বংশীবদন গোস্বামী আর বৈষ্ণবী হরিপ্রিয়া বৃন্দাবন থেকে রাধামাধবের বিগ্রহ নিয়ে এসেছিলেন ভাগীরথীর তীরে। মাধবীতলায় একটা কুলুঙ্গিতে বসিয়েছিলেন কষ্টিপাথরের মাধব আর রাধারানিকে। মুর্শিদাবাদ নামকরণ তখনও হয়নি। ‘মধুর মাধবীকুঞ্জ’ তখনও ছিল। আর ছিল কাঠচাঁপা, নাগলিঙ্গম, বকুল আর স্বর্ণচাঁপা। ছিল পঞ্চবটি আর তমালও। ‘কৃষ্ণ কালো, তমাল কালো, তাই তো তমাল ভালবাসি’, বলছিল রাধা বোষ্টমী।
সেই কবেকার কথা! যে দিন প্রথম বংশীবদন গোঁসাই এলেন এই ‘মধুর মাধবীকুঞ্জে’। সেই দিনকার সাক্ষী ছিল কি ওই তমাল? ও কি চেনে শ্রীজীব গোস্বামীর শিষ্যা হরিপ্রিয়াকে? মন্দিরের গায়ে টিনের ফলকে সেই দিনও কি লেখা ছিল ‘মধুর মাধবীকুঞ্জ’-এর নাম? নবাব নওয়াজেস আর তাঁর বেগম ঘসেটি বৈষ্ণবদের
সাধন-ভজনের খোল-করতালের শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁদের জব্দ করার জন্য ষড়যন্ত্র করে নাকি নিষিদ্ধ মাংস পাঠিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়িতে। কিন্তু তখনকার সেবায়েত লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামী পাত্রের ঢাকনা খুলেই দেখতে পেয়েছিলেন একরাশ জুঁইফুল। পরের দিন আবার একই ঘটনা। কিন্তু সে দিন জুঁই ফুলের বদলে মিলল শ্বেতপদ্ম। পরপর কয়েক বার এর পুনরাবৃত্তি হওয়ায় নওয়াজেসও শেষে ভক্ত হয়ে যান রাধামাধবের! আর তাঁরই ব্যবস্থায় এই শ্রীপাটের রাধামাধবের নাম ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে। ঠাকুরবাড়ির পরিধি আরও বাড়ে। বহু নিষ্কর জমি ঠাকুরবাড়ির আওতায় আসে। বছরের পর বছর লোকের মুখে মুখে ফেরা এই লোকগাথা সত্যি কি না তার খবর কি রাখে ওই মাধবী?
মাধবীলতা শুধু তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে চলে বছরের পর বছর ধরে। সেই গাছে ফুল ধরে এখনও। তবে লতা আজ প্রায় বৃক্ষের আকার নিয়েছে। মতিঝিলের ওই পাড়ে ঘসেটি বেগমের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ আজও আছে। আর আছেন রাধামাধব। রাধামাধবতলায় মাধবের টানে আসা বৈষ্ণব ভক্তেরা কীর্তনে বিভোর হয়ে থাকেন প্রতি সন্ধ্যায়। কীর্তনের সেই সুর আর খোলের আওয়াজ শোনা যায় দূর থেকে। আর স্নানযাত্রার মেলাশেষে গ্রামবাসীরা কানে সেই সুর নিয়ে ফিরে চলেন ঘরের দিকে। হাওয়ায় তখনও ভেসে আসছে, ‘ভজ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ...’।

কী ভাবে যাবেন
শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে মুর্শিদাবাদ। সেখান থেকে
গাড়িতে পৌঁছনো যায় রোশনবাগ বা শ্রীপাট কুমারপাড়া।
কোথায় থাকবেন
মুর্শিদাবাদেই প্রচুর থাকার জায়গা রয়েছে। মুর্শিদাবাদ থেকেই যাওয়া যায় শ্রীপাটে।
সেই সঙ্গে অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানও ঘুরে দেখা যায়।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.