নিজস্ব সংবাদদাতা • অন্ডাল |
শিবমন্দির থেকে ফলের বাগান, এমনকী শতবর্ষ প্রাচীন শ্মশানও হারিয়ে গিয়েছে। ভাঙনে দামোদরে তলিয়ে গিয়েছে চাষের জমি। খেত মজুর তাই বাধ্য হয়েছেন জীবিকা পরিবর্তনে। এমনই নানা ঘটনার সাক্ষী অন্ডালের মদনপুর থেকে রামপ্রসাদপুর এবং রানিগঞ্জের নূপুর মৌজার বহু বাসিন্দা।
দামোদরের গা ঘেঁষে থাকা এই এলাকার চাষিদের কাছে এখন অনেক কিছুই স্মৃতি। সে সব গল্প উজাড় করে দিলেন গ্রামের বাসিন্দারা। প্রবীণ তারক ধাঙর, বঙ্কিম মণ্ডলেরা জানালেন, ছোটবেলায় তাঁরা গরমে স্নান করতে যেতেন নদের ওপাড়ে বাঁকুড়ার ঘাটে। এ দিকে বিশেষ জল থাকত না। সেই নদ এখন গ্রামের ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে। মনোহর মণ্ডল, রবি দেওয়াসিদের কথায়, “এই এলাকায় সবথেকে বেশি আখ চাষ হত। পাড়ায় পাড়ায় আখশাল ছিল।” রানিগঞ্জ, কাজোড়া এবং অন্ডালের সব্জি বাজারে কাঁচামাল সরবরাহে এক সময় এই এলাকার নাম ছিল উপরের সারিতে। এলাকায় সব্জি চাষের এমন রমরমা ছিল, যে বরবটি, ঢেঁড়শ, আলু বহু সময় মাঠেই পড়ে থাকত। সে সব এখন স্মৃতি। এক সময় খেত মজুরি করতেন প্রহ্লাদ বাউরি, খোকন বাউরি, জয়রাম বাউরিরা। এখন তাঁরা কখনও রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হিসাবে কাজ করেন। কখনও নানা সামগ্রী মাথায় নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ফেরি করে বেড়ান। |
মদনপুরের বাসিন্দা চণ্ডী মণ্ডল, কংগ্রেস নেতা রবিন মিশ্ররা জানালেন, বহু প্রাচীন একটি শিব মন্দির কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। বিশাল ফলের বাগান বিস্মৃতির অন্তরালে। এলাকার এক খেতমজুর সাগর বাগদি আজ দিন-মজুর। তিনি বললেন, “হারিয়ে গিয়েছে প্রাচীন শ্মশান। এখন লোকালয়ের কাছাকাছি নতুন একটি জায়গায় চলছে শবদাহ।” অনেকে অবশ্য যান রানিগঞ্জের বল্লভপুর শ্মশানঘাটে। বাসকা গ্রামের আস্তিক রায় জানালেন, একদা সেচে ব্যবহারের জন্য নির্মিত পাম্প ঘর এখন জলের তোড়ে ধুয়ে মুছে সাফ। সেচের জন্য বেশ কিছু কুয়োও ছিল জমিতে। বাসকার আম বাগান ভাঙনের তোড়ে শেষ। নদের জল এগিয়ে এসে এখন প্রাথমিক স্কুলের একশো ফুট দূর দিয়ে বইছে। গ্রামবাসীদের হাজার বিঘা জমি বালির তলায়। সবথেকে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে নদের গা ঘেঁষে থাকা ভালুকসোঁদা গ্রাম। গ্রামেরই বাসিন্দা অজয় পাল জানালেন, ১৯৮০ সালে এক চিলতে বাঁধ দিয়েছিল ঠিকাদার সংস্থা। এখন জলের তোড়ে সেই বাঁধের পাথর, ইট আলগা হয়ে গিয়েছে। বাঁধের দু’পাশ থেকে জল ঢুকে যাচ্ছে গ্রামে। অজয়বাবু বলেন, “যখন তখন বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে, এটা ভেবেই এখানে বাস করছি। যাব কোথায়? আমাদের তো সে ক্ষমতা নেই।”
এ দিকে, ভাঙনের জন্য ইসিএলের জে কে রোপওয়েজকে দায়ী করে বিভিন্ন দফতরে চিঠি লিখেছেন গ্রামের বাসিন্দারা। বার বার বিক্ষোভ দেখিয়েও প্রতিকার মেলেনি। জে কে রোপওয়েজ ইসিএলের বিভিন্ন কোলিয়ারিতে ভূগর্ভে বালি ভরাটের কাজ করে। অন্ডাল পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সদস্য তৃণমূলের ঘনশ্যাম দেওয়াসির অভিযোগ, “বালি ভরাটের জন্য মদনপুর থেকে রামপ্রসাদপুর পর্যন্ত তারা নদীর বালি লিজ নিয়েছে। নদী পাড়ের ৩০০ মিটার দূর থেকে বালি তোলা বিধিসম্মত। কিন্তু সেই বিধি না মেনে ৫০ মিটার এমনকী তার থেকেও কম দূরত্বে বালি কেটে নেওয়া হচ্ছে। তাই এই পরিণতি।” জে কে রোপওয়েজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, বিধি মেনেই কাজ চলছে। নদী তার তীর ভাঙছে কালের নিয়মেই। এতে তাঁদের কোনও হাত নেই।
অন্ডাল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সিপিএমের শুভাশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভাঙন নিয়ে সংশ্লিষ্ট সমস্ত দফতরের সঙ্গেই কথা হয়েছে। দেখা যাক কী হয়।” কী যে হবে, বোঝা গেল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি দফতরের এক কর্তার কথায়। বললেন, “নদীর জল এলাকা ভাঙলে অন্যত্র সরে যেতে হয়, এটাই নিয়ম। দামোদর এখন এই দিকে বইছে। কারও কিছু করার নেই।”
গ্রাম বাঁচাতে এ বার তাই মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে চান বাসিন্দারা। |