ট্রলি পেয়েছেন! ভেবে নিন লটারি জিতলেন
বাবাকে দু’হাতে পাঁজাকোলা করে দৌড়োচ্ছিলেন যুবকটি।
সকালে বৃদ্ধের বুকে ব্যথা শুরু হয়েছিল। ইমার্জেন্সিতে আনার পরে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেরে ডাক্তারেরা বলেছেন অবিলম্বে কার্ডিওলজিতে নিয়ে যেতে। কী ভাবে নিয়ে যাবেন?
ডাক্তারেরা বলেছিলেন, “দেখুন, ট্রলি পান কি না!”
কিন্তু কোথায় দেখবেন? কে বলবে? রোগীর বাড়ির লোকের কথা শোনার ধৈর্য কারও নেই! এক পুলিশকর্মী তো বলেই ফেললেন, “ট্রলি পাওয়া আর লটারি পাওয়া এখানে একই ব্যাপার!”
অগত্যা দু’হাতের ভরসায় বাবাকে তুলে ছুটলেন ওই যুবক। দক্ষিণ কলকাতার চেতলার বাসিন্দা সজল সমাদ্দার (পরিবর্তিত নাম)। সকাল ন’টার ভিড়ে ঠাসা এসএসকেএম হাসপাতালের করিডর ধরে।
ক্ষমতায় আসার পরেই এক দিন ক’মিনিটের জন্য এসএসকেএমে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাসপাতালের পরিষেবা উন্নত করতে একগুচ্ছ নির্দেশ দিয়েছিলেন। যার অন্যতম ছিল, রোগীর প্রয়োজনে পর্যাপ্ত ট্রলি যেন মজুত থাকে। অথচ বাস্তব হল: ট্রলি এখনও অমিল। নেতিয়ে পড়া রোগীকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ক্বচিৎ কারও ভাগ্যে ট্রলি জুটে যাওয়াটা বাস্তবিকই লটারি জেতার সামিল!
কোথায় গেল সব ট্রলি?
হাসপাতালের এক কর্মীরই ব্যাখ্যা, “ফোর্থ ক্লাস স্টাফের কয়েক জনকে টাকা দিন। ম্যাজিকের মতো ট্রলি পাবেন! এই অন্যায় কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না।”
অসহায় পরিজন। ছবি: অশোক মজুমদার।
এই অন্যায়ই রোজ ঘটছে, সবার চোখের সামনে। যার শিকার সজলবাবু। এবং যাঁর দুর্ভোগের সেখানেই শেষ নয়।
কার্ডিওলজি আউটডোরে পৌঁছে তিনি দেখেন, এক জনও সিনিয়র ডাক্তার নেই! দু’-তিন জন জুনিয়র ডাক্তার আউটডোর সামলাচ্ছেন। স্টেথো ঝোলানো এক তরুণকে ডেকে বাবার কথা বলায় বিরক্ত জবাব পেলেন, “অপেক্ষা করুন। আসামাত্রই সব হয়ে যাবে নাকি!” অন্য এক রোগীর আত্মীয়কে জিজ্ঞাসা করলেন, “বড় ডাক্তারবাবুরা কখন আসবেন?” এসএসকেএমের আউটডোরে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ সেই ব্যক্তির প্রত্যয়ী উত্তর, “বারোটা তো বাজবেই।”
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে সরকারি হাসপাতালে আউটডোর সওয়া ন’টাতেই চালু হচ্ছে। তবে তাতে ‘গোঁজামিল’ রয়েছে বলে অভিযোগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দু’-তিন জন জুনিয়র ডাক্তার ছাড়া কেউ থাকছেন না। অধিকাংশ ভিজিটিং ডাক্তার আসছেন বেলা সাড়ে ১১টা-১২টায়। উপরন্তু সকালে যত মেডিক্যাল অফিসার থাকার কথা, বহু জায়গায় তার অর্ধেকও থাকছেন না। স্বাস্থ্য দফতরের এক সূত্রের মন্তব্য, “রোজ সকালে হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যভবনে এসএমএস করে আউটডোর চালুর খবর দেওয়া হচ্ছে বটে, তবে তাতে শুধু ‘অশ্বত্থামা হত’টাই বলা থাকছে। ‘ইতি গজ’ থাকছে না।”
অতএব, বহির্বিভাগে হয়রানিও বন্ধ হচ্ছে না। যেমন বন্ধ করা যায়নি দালালের দাপাদাপি। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ মেনে নিচ্ছেন যে, দালাল ঠেকানোর চেষ্টা করে তাঁরা বার বার ব্যর্থ হচ্ছেন। যে ‘ব্যর্থতা’-র নমুনা টের পেয়েছেন সজলবাবুও। আউটডোরেই তাঁর কানের কাছে মাঝবয়সী একটি লোক ফিসফিসিয়ে বলেছে, “ভর্তির কেস? চিন্তা নেই। সব ব্যবস্থা হবে। আলাদা রেট আছে।”
পরিদর্শনের পাঁচ মাস
কী বলেছিলেন কী হয়েছে
সওয়া ন’টায় আউটডোর চালু, তবে জুনিয়র ডাক্তার দিয়ে
দালাল উৎখাত জাঁকিয়ে দালাল-রাজ
রোগী ফেরানো যাবে না শৌচাগারেও রোগী
খারাপ যন্ত্র দ্রুত সারাই নিয়মের ফাঁসে মেরামতি শিকেয়
সজলবাবু অবশ্য হুঁশিয়ার ছিলেন। তাই দালালের খপ্পরে পড়েননি। কর্তৃপক্ষ কেন সতর্ক হচ্ছেন না?
এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমইআর)-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের জবাব, “রোগীরাই তো লিখিত অভিযোগ করেন না! ব্যবস্থা নেব কীসের ভিত্তিতে?”
এ হেন যুক্তি শুনে রোগীর পরিজনেরা বিস্মিত। তাঁদের প্রতিক্রিয়া, “চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি করব, নাকি অভিযোগ নিয়ে পড়ে থাকব?” হাসপাতালে কোনও অনিয়ম চললে কর্তৃপক্ষ নিজে কেন উদ্যোগী হয়ে তদন্ত করবেন না, সে প্রশ্নও তুলছেন ওঁরা। যার কোনও উত্তর প্রদীপবাবু দিতে পারেননি। হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে নার্সিংহোমে রোগী পাঠানোর অভিযোগ নিয়ে কী ব্যবস্থা হচ্ছে, সে সম্পর্কেওকর্তৃপক্ষ নিরুত্তর।
বেলা ১১টা বেজে গিয়েছে। বাবাকে আউটডোরের এক ধারে মেঝেতে শুইয়ে দিয়েছেন সজলবাবু। হাসপাতাল চত্বর উপচে পড়ছে ভিড়ে। মুখ্যমন্ত্রীর ফরমান, রোগী ফেরানো যাবে না। কর্তৃপক্ষ তা মানারও চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভর্তি হয়েও রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন কি?
একটা আন্দাজ মিলল মেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে। রোগীর ভিড় বাড়তে বাড়তে লিফ্টের দরজা প্রায় আটকে ফেলেছে! উল্টো দিকে এন্ডোক্রিনোলজি-র প্রবেশপথও বন্ধ হওয়ার জোগাড়! নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের ওয়ার্ডে ঢোকানো যাচ্ছে না, এমনকী ডাক্তারেরাও ঢুকতে পারছেন না। তা হলে চিকিৎসা হবে কী করে?
অধিকর্তার অসহায় আক্ষেপ, “রেফারেল সিস্টেম ঠিকঠাক কাজ না-করলে এমনই চলবে। কোনও কারণ ছাড়াই অন্য হাসপাতাল থেকে রেফার করা হচ্ছে! আর রোগী ফেরানো যাবে না বলে আমরাও ভর্তি করে নিচ্ছি! কিন্তু এ ভাবে এত ভিড়ের মধ্যে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব কি না, সেটা কেউ ভেবে দেখছেন না!”
মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বলেছিলেন, হাসপাতালে কোনও সরঞ্জাম খারাপ হলে দ্রুত মেরামতির ব্যবস্থা করতে হবে। বাস্তবটা কী?
সেখানেও আঠারো মাসে বছর। কোথাও ভেন্টিলেটর খারাপ, কোথাও সি-আর্ম যন্ত্র বিকল। ষাটোর্ধ্ব অমল চৌধুরীর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। তার পরে যেই ভেন্টিলেশনে রাখার দরকার পড়ল, চিকিৎসক হাত তুলে দিলেন। বললেন, “এখানকার আইটিইউয়ে জায়গা নেই। অন্যত্র চেষ্টা করুন।”
কোথায় চেষ্টা করবেন? সব জায়গায় যে একই অবস্থা!
ভেন্টিলেটরের অভাবে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল অমলবাবুর। তার পরেও অবস্থা বদলায়নি। দেখা গেল, অর্থোপেডিক বিভাগের সামনে বসে রয়েছেন চঞ্চলা সাহা। সি আর্ম যন্ত্র খারাপ বলে তাঁর অস্ত্রোপচার আটকে গিয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, বহু যন্ত্রের বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণের চুক্তি (এএমসি)-ই হয়নি। ঠিক যেমন আগে হতো না! রাজ্যের প্রথম সারির সরকারি হাসপাতালেই নিয়মের গেরোয় থমকে রয়েছে যাবতীয় সরঞ্জাম সারাই।
দুপুর প্রায় একটা। সজলবাবুর বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা হল। যদিও ভর্তি করা হল না। ডাক্তারেরা বলে দিলেন, ভর্তির দরকার নেই। যে ভাবে পাঁজাকোলা করে এনেছিলেন, সে ভাবেই বাবাকে নিয়ে গিয়ে ট্যাক্সিতে তুললেন সজল সমাদ্দার।

(চলবে)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.