ভরসা এখন পুণে
কী সে জীবাণু, বিভ্রান্তির জ্বরে কাহিল কলকাতা
মাঝে-মধ্যে জ্বর উঠে যাচ্ছে ১০৩-১০৪ ডিগ্রিতে। গাঁটে গাঁটে অসহ্য ব্যথা। গায়ে লালচে দাগও।
উপসর্গগুলো তো মোটামুটি চেনা! ডেঙ্গি কিংবা চিকুনগুনিয়া।
অথচ এক বার রক্ত পরীক্ষায় কিচ্ছু মিলছে না। ফের অন্যত্র পরীক্ষা। তাতেও মিলছে না কোনও জীবাণুর অস্তিত্ব! শেষমেশ কলকাতা থেকে রক্তের নমুনা পাঠানো হল পুণেতে। কয়েকটা ক্ষেত্রে জানা গেল, রোগটি চিকুনগুনিয়া। বাকিদের রোগই ধরা পড়ছে না।
নাম না-জানা জীবাণুর আক্রমণেএই মুহূর্তে মহানগরী দিশেহারা!
পুজোর ঠিক পরেই কলকাতায় হানা দিয়েছে ওই অ-শনাক্ত জ্বর। চিকিৎসক ও জীবাণু-বিশেষজ্ঞেরা গোড়ায় ভেবেছিলেন, জীবাণু যা-ই হোক না কেন, অস্বস্তিকর আবহাওয়া কেটে তাপমাত্রা কমলেই তা আর বাঁচতে পারবে না। কিন্তু উত্তুরে বাতাসে এখন তো শীতের ছোঁয়া। তবু তার দাপট কমছে কোথায়?
কমছে তো না-ই, বরং দিন দিন বাড়ছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ কাউকেই ছাড়ছে না। স্বাস্থ্যবান যুবকদেরও কাহিল করে দিচ্ছে। রোগ ধরা না-পড়লেও উপসর্গ দেখে জীবাণু-বিশেষজ্ঞদের আন্দাজ, ডেঙ্গি-চিকুনগুনিয়ার মতো এই জ্বরের মূলেও কোনও মশাবাহিত ভাইরাস। যার চরিত্র জানা না-থাকায় ঝুঁকি এড়াতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতাল-নার্সিংহোমে ভর্তি হতে হচ্ছে।
পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কেউ কেউ অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন যে, রোগের উৎস না-জেনে অনেক ক্ষেত্রে প্রথম থেকে কড়া মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করায় জটিলতা বাড়ছে। তাঁদের দাওয়াই: অজানা শত্রুটির বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে প্যারাসিটামল, প্রয়োজনে স্যালাইন দিয়ে। ওঁদের দাবি, এ ভাবে চিকিৎসা চললে রোগী সুস্থ হয়ে উঠছেন।
কিন্তু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও জ্বর কি ঘুরে আসতে পারে?
বস্তুত জীবাণুর প্রকৃতি না-জানায় বিশেষজ্ঞেরাও সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা, পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী চেতলায় একটি ক্লিনিক চালান। সেখানে জ্বরের রোগী উপচে পড়েছে। অমিতাভবাবু জানাচ্ছেন, অগস্ট থেকে সোমবার পর্যন্ত ডেঙ্গি-চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ থাকা ১৮০ জনের রক্ত পরীক্ষা করিয়েছেন। ৭১ জনের ক্ষেত্রে ভাইরাস চিহ্নিত হয়নি।
অর্থাৎ, মোট রোগীর চল্লিশ শতাংশের ক্ষেত্রেই জীবাণু চিহ্নিত হয়নি। অমিতাভবাবুর কথায়, “দেখে মনে হচ্ছে, ডেঙ্গি বা চিকুগুনিয়া। কিন্তু একাধিক বার রক্ত পরীক্ষায় কোনও পরিচিত জীবাণু মেলেনি। অথচ উপসর্গে পরিষ্কার, এ কোনও জীবাণুর সংক্রমণ। রোগটা ধরতে পারছি না।” অমিতাভবাবু এ-ও হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, “এই অবস্থায় জ্বর হলে ডাক্তার না-দেখিয়ে নিজে নিজে ওষুধ খেয়ে ফেললে বিরাট ভুল হবে। অনেকে তা করছেনও। তাতে রোগ আরও জটিল হচ্ছে।”
অজানা জ্বর কতটা ছড়াচ্ছে?
ডেঙ্গি কথা
চিকুনগুনিয়া কথা
ডেঙ্গি ভাইরাসবাহী এডিস মশা কাউকে কামড়ালে
তার ডেঙ্গি হয়। এডিস-ই এক ব্যক্তি থেকে অন্যের
মধ্যে রোগটি ছড়ায়।

উপসর্গ
• জ্বর প্রথমে কম, তার পরে হঠাৎ বেড়ে যায়
• প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা, চোখের পিছনে ও গাঁটে ব্যথা
• গায়ে লাল লাল দাগ, চোখ লাল হওয়া
• অনেক সময় পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, বমি
• শরীর থেকে রক্তপাত শুরু হওয়া
• দেহে জলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় দুর্বলতা

চিকিৎসা

চিকিৎসকের পরামর্শে প্যারাসিটামল
খেতে হয়। খেতে হয় প্রচুর জলও।

আশঙ্কা

ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে হেমারেজিক ডেঙ্গি (যেখানে শরীর থেকে রক্তপাত হয়) মৃত্যু ঘটাতে পারে।

চিকুনগুনিয়া ভাইরাসবাহী এডিস মশা কামড়ালে চিকুনগুনিয়া হয়। এডিস-ই এক ব্যক্তি থেকে অন্যের মধ্যে রোগ ছড়ায়।

উপসর্গ
• জ্বর উঠে যায় ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত
• জ্বর থাকে তিন থেকে চার দিন
• মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, সঙ্গে গাঁটে গাঁটে ব্যথা
• গায়ে অনেক সময়ে লাল দাগ বেরোয়
• চোখ লাল হয়ে যায় (কনজাংটিভাইটিস)
• খিদে থাকে না, শরীরে জল কমে যায়

চিকিৎসা

নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। সাধারণত প্যারাসিটামল
দিয়েই চিকিৎসা। বেশি দুর্বল হলে হাসপাতালে
ভর্তি করিয়ে স্যালাইন।

আশঙ্কা

মৃত্যুভয় তেমন নেই। তবে রক্তের ঘনত্ব
বেড়ে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে।
রোগ নির্ণয়
দু’টি ক্ষেত্রে উপসর্গ মিললেই রক্ত পরীক্ষা করা উচিত।
এক বারে ধরা না পড়লে দ্বিতীয় বার।

প্রতিরোধ

দুই রোগের ক্ষেত্রে মশা নিয়ন্ত্রণই একমাত্র প্রতিরোধ।
এখনও পর্যন্ত কোনওটিরই প্রতিষেধক বেরোয়নি।
শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ কলকাতায় একটি শিশু হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর অভিজ্ঞতা, “আমার কাছে জ্বর নিয়ে যে বাচ্চারা আসছে, তাদের উপসর্গ মোটামুটি এক। কিন্তু ৫০ ভাগের ক্ষেত্রে জীবাণুটা ধরা যায়নি। যে ৫০ ভাগের ধরা পড়েছে, তাদের ৯৫ শতাংশের ডেঙ্গি। ৫ শতাংশের চিকুনগুনিয়া।” অজানা শত্রুর সঙ্গে লড়ছেন কী ভাবে? অপূর্ববাবু বলেন, “রোগ ধরা না-পড়লে আগেভাগে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে লাভ নেই। প্যারাসিটামল দিয়েই চিকিৎসা করা উচিত। আর দেখা উচিত, প্রস্রাব যেন ঠিকঠাক হয়। পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি-র বিশেষজ্ঞেরা আক্রান্তদের রক্তের নমুনা নিয়ে গিয়েছেন। ওঁরা কী বলেন, তা জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।”
অমিতাভবাবু, অপূর্ববাবু, দু’জনেই মূলত প্যারাসিটামল দিয়ে চিকিৎসা করছেন। তাতে ফলও মিলেছে বলে ওঁদের দাবি। অমিতাভবাবুর জানান, জীবাণু ধরতে না-পারা ৭১ জনের সকলে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ওঁদের ৪০ জনের চিকিৎসা হয়েছে হাসপাতালে। তাঁর অভিযোগ, “কিছু চিকিৎসক জ্বরের প্রকৃতি বুঝতে না-পেরে প্রথম থেকেই কড়া অ্যান্টিবায়োটিক, এমনকী ব্যথা কমাতে স্টেরয়েডও দিয়ে দিচ্ছেন। তাতে অবস্থা জটিল হচ্ছে। এমনিতে কিন্তু এই অজানা জ্বরে বিশেষ সমস্যা হওয়ার কথা নয়।” অপূর্ববাবুও মনে করেন, চিকিৎসা বিভ্রাটেই ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়া অনেক সময়ে সমস্যার সৃষ্টি করছে। কিছু ডাক্তার জ্বর ও গাঁটে ব্যথা দেখেই কড়া ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিচ্ছেন। তাঁর কথায়, “উল্টোপাল্টা ওষুধ খাওয়ানোয় মুশকিল হচ্ছে। ডেঙ্গির ক্ষেত্রে জ্বর নামার ৪৮ ঘণ্টা পরে আচমকা শারীরিক অসুবিধে দেখা দিচ্ছে। আবার মা-বাবা যখন ভাবছেন ছেলেমেয়ে সুস্থ হয়ে গিয়েছে, তখনই হয়তো পেটে ব্যথা বা বমি শুরু হচ্ছে। এবং সে ক্ষেত্রেও অনেক সময়ে ঠিকঠাক চিকিৎসা হচ্ছে না।”
কলকাতায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড) কিংবা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মতো প্রতিষ্ঠান থাকতেও রোগ নির্ণয়ের জন্য পুণের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে কেন?
নাইসেড ও ট্রপিক্যালের চিকিৎসক-গবেষকেরা বলছেন, পুণের ওই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি-র তৈরি ‘কিট’ দিয়েই সর্বত্র রক্তে ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করা হয়। এখানে তাতেও রোগ শনাক্ত না-হওয়ায় কেন্দ্রীয় নির্দেশমতো রক্তের নমুনা পুণেতে পাঠানো হয়েছে। এখন সরকারি ভাবে তাদেরই জানানোর কথা, তাতে কী ধরা পড়ল।
অজানা জ্বরের কারণ কী হতে পারে? কোনও আন্দাজ? নাইসেডের অধিকর্তা, ভাইরাস-বিশেষজ্ঞ শেখর চক্রবর্তীর জবাব, “অজানা বলে কিছু হতে পারে না। বলা যেতে পারে, রক্তের কিছু নমুনায় ভাইরাসটা ধরা পড়েনি। অনেক ক্ষেত্রে ব্লাড স্যাম্পল কখন নেওয়া হল, তার উপরে রোগনির্ণয় নির্ভর করে। যেমন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রক্ত না-নিলে অনেক সময়ে চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে না। ভেবে দেখতে হবে, এ ক্ষেত্রেও তেমন কিছু হল কি না।” একই সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার নতুন প্রজাতির অস্তিত্বের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন শেখরবাবু। তাঁর মন্তব্য, “চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের জিনগত চরিত্র বদলেছে কি না, তা জানতে আমরা এখানে গবেষণায় হাত দিচ্ছি।”
শেখরবাবুরা গবেষণায় উদ্যোগী হলেও ট্রপিক্যাল কিন্তু হাত গুটিয়ে। অজানা জ্বরের রক্তের নমুনা পুণেতে পাঠিয়েই তারা দায় সেরেছে। কেন?
পূর্বাঞ্চলের প্রাচীনতম রোগ গবেষণাকেন্দ্রটির অধিকর্তা কৃষ্ণাংশু রায়ের ব্যাখ্যা: ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও অজানা জ্বরের জীবাণু শনাক্ত করার মতো কোনও পরিকাঠামো তাঁদের নেই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.