প্রবন্ধ ২...
ওরা সবাই নাকুশি
হারাষ্ট্রের সাতারা জেলার দরিদ্র পাটন গ্রামের ৯১০ জন বাসিন্দার মধ্যে ৯২টি মেয়ের নাম ‘নাকুশি’। (মরাঠি শব্দটির মানে হল ‘অবাঞ্ছিত’।) ওই জেলাতেই, সাতারা শহরের কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্রাম কামঠির ১৫২০ জন বাসিন্দার মধ্যে তিনটি মেয়ের নাম নাকুশি। পর পর অনেকগুলি মেয়ে হয়েছে, তার মধ্যে হয়তো আর একটি ছেলের চেষ্টা করতে গিয়েও কয়েকটি... পরিবার যে এই মেয়েকে চায়নি, তেত্রিশ কোটি ঠাকুরদেবতাসুদ্ধু সারা পৃথিবীকে সে কথা জানানোর সবচেয়ে ভাল রাস্তাই তো মেয়েটির নামে আজীবন ছাপ্পা লাগিয়ে দেওয়া কেউ তোকে চায়নি।
‘সেভ দ্য গার্ল চাইল্ড’ সংগঠন মহারাষ্ট্রের শুধুমাত্র সাতারা জেলারই কয়েকটি গ্রাম থেকে খুঁজে পায় অনেক নাকুশিকে। তার মধ্যে আঠারো বছরের নীচে ২২২ জন নাকুশির কাছে তারা যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় একটি প্রশ্ন: তারা কি তাদের নামটা পছন্দ করে? না, তারা সব সময় মরমে মরে থাকে। এদের মধ্যে যারা ইস্কুলে যায়, তাদের বন্ধুরা টিটকিরি দেয়, পিছনে লাগে। নামটা ছোট করে ‘নাকু’ ‘নাকু’ বলে খেপায়। শুধুমাত্র এই কারণেই কয়েক জন ইস্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। শুধু মেয়েদের সঙ্গে নয়, মেয়েটি খুব ছোট হলে, তার নিজের পছন্দ করার বয়স না হলে, স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। মায়েরা বলেছেন, সন্তানটি চাননি তা মোটেই নয়, সব সন্তানই ভগবানের দান, তাঁদের কাছে সমান ভালবাসার, শুধু মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে বড় ভাল হত, তাঁকে পরিবারে কম গঞ্জনা শুনতে হত। কোথাও নামবদলের কথা বলতে গিয়ে বাবা মা ঠাকুর্দাদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে এই মেয়ের বিয়েতে যখন এক কাঁড়ি টাকা লাগবে, সংগঠন কি তা দেবে?
নাকুশিদের জন্য শুধু পরিবর্তনের বার্তা নয়, একটি লম্বা নামের তালিকাও নিয়ে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবীরা। প্রত্যাশিত ভাবেই, সবচেয়ে বেশি মেয়ে নিয়েছে বলিউড তারকাদের নাম: ঐশ্বর্য আর করিনা। এ ছাড়াও মেয়েদের পছন্দ সাবিত্রী, বৈশালী, সঞ্চিতা। পঞ্চম শ্রেণির জনপ্রিয় ছাত্রী, পড়াশোনা থেকে শুরু করে ইস্কুলের গানের দল, খেলাধুলা, সবেতে এগিয়ে থাকা এক নাকুশি তো রীতিমত দোটানায়, তার পছন্দ ঐশ্বর্য, কিন্তু তার ক্লাসের সবার পছন্দ কোমল, কোন নামটা নেবে সে? অবশেষে অক্টোবরের শেষে মহা ধুমধাম করে জেলা প্রশাসনের কর্তারা ওই ২২২ জন নাকুশির হাতে তুলে দিয়েছেন দীপাবলির সবচেয়ে মহার্ঘ উপহার নতুন একটি প্রিয় নাম এবং সেই নামের প্রয়োজনীয় দলিল। ২০০১ সালের জনগণনার তুলনায় ২০১১ সালে মহারাষ্ট্রে শিশুকন্যার অনুপাত কমেছে বিপজ্জনক ভাবে ৯১৪ থেকে নেমে হয়েছে ৮৮৩, সাতারা জেলার আরও কম, ৮৮১। পরিবার কন্যাসন্তান চায় না। পুত্রের প্রয়োজন ধমের্র নামে, বংশরক্ষার নামে। বাস্তবেও ধরে নেওয়া হয়, কন্যার ভরণপোষণ মানে অন্যের বাগানে জল দেওয়া আর বিয়ের বিরাট অঙ্কের পণ, ছেলেরা দেখভাল করবে সম্পত্তির, বাড়ির মানুষদেরও। তাই চাই না কন্যা। এই আসমুদ্রহিমাচল পুত্রকামনায় মায়েরাও অসহায়, তাঁরা না চাইলেও কন্যারা ‘নাকুশি’র পরিচয়েই জীবন কাটাবে।
এখনও বহু ভারতীয়, ধর্মনির্বিশেষে, বিশ্বাস করেন, সন্তান ছেলে হবে কি মেয়ে, বিজ্ঞানের নয়, জিনের নয়, তাতে হাত রয়েছে একমাত্র কপালের। সাতারার গ্রামে প্রচলিত আছে নাকুশি নাম দিলে ভগবানের দরবারে এই সওয়াল পৌঁছে যাবে যে, ওই মেয়েকে চাওয়া হয়নি, তিনি বিবেচনা করবেন, ফলে পরের সন্তানটি হবে সেই বাঞ্ছিত পুত্র। মেয়েদের কপালে ‘অবাঞ্ছিত’ ছাপ্পাটা মেরেই পরিবার ভগবানের দরবারে সওয়ালের কাজ সেরেছিল, খোদার ওপর খোদকারি করে সেই মেয়ের জন্মের অধিকারটুকু অন্তত কেড়ে নেয়নি। না কি, লিঙ্গনির্ণয়ের প্রযুক্তিটা আয়ত্তে নেই বলেই নাকুশিরা বেঁচে গেছে? রামায়ণের যুগ থেকে চলে আসা পুত্রেষ্টির ফল আজ বুঝছে চিন, অল্প হলেও বুঝতে শুরু করেছে ভিয়েতনাম-কোরিয়া। এ দেশেও বিশেষ করে ১৯৯১ সালের জনগণনা থেকেই আসছে অশনি সংকেত। এ বারের জনগণনা তাকে আরও স্পষ্ট করেছে। তাই শিশুকন্যার কাম্যতা বাড়ানোর নানান প্রয়াসের মধ্যে এটিকেও সাদরে গ্রহণ করেছে মহারাষ্ট্র সরকার।
নামের বাহার নিয়ে বাঙালিদের একটু গর্ব আছে বইকি। সাহেবদের নাম যুগ যুগ ধরে প্রায় একই চলেছে, হিন্দিতে এক এক সময় এক একটা নতুন নামের ঢল নামে, কয়েক হাজার অঙ্কিত বা প্রিয়াঙ্কা রোল বুক ভরিয়ে দেয়। সেখানে একেবারে ধর্মনিরপেক্ষ হয়েও সংস্কৃতের ডানা লাগিয়ে বাঙালিরা ভাসতে থাকেন নতুন নতুন অচেনা নামের তৎসম আকাশে। সেই বাঙালির নিজস্ব নাকুশির ঘরানা কী রকম? আমাদের আছে এখনও এত আন্না (= আর না) আর নয়তো ফেলি যাদের ভাগ্য আমরা জেনেই বসে আছি ‘মেয়ের নাম ফেলি/ যমে নিলেও গেলি/ বরে নিলেও গেলি’। এদের ভবিষ্যৎ তো জানাই আছে, এরা এক্কেবারে খরচের খাতায়, যাওয়াটাই যার ভবিতব্য। কুড়ানি, হারানি, পাঁচি, কালী, খেন্তি (ক্ষান্তি থেকে?) আর আরও সব অবহেলার নামের মেয়েদের, যাদে কোনও শুমারিই করা হয়নি? কিংবা চায়না? এই চায়নারা চিনদেশের ইংরেজি বর্ণস্থাপন নয় নিশ্চয়ই, সম্ভবত ‘চাই না’র প্রকাশ। পশ্চিমবঙ্গেও কি এ রকম একটা শুমারি প্রয়োজনীয় নয়, যাতে আমাদের ঘরের সাংস্কৃতিক কার্পেটের নীচে লুকিয়ে থাকা এই সব নামের জঞ্জাল প্রকাশ করা যায়?
১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ যখন শিশু অধিকারের সনদ গ্রহণ করে, তাতে ভারতও স্বাক্ষর করেছিল। সেখানে একটি শিশুর মৌলিক আর অবিচ্ছেদ্য অধিকারের মধ্যে পড়ে একটি নাম। এই নামটি সে সারা জীবন বহন করবে। এই নামটি দিতে পরিবারকে কোনও বাড়তি খরচের মুখে পড়তে হবে না। কিন্তু সেই নামটিই যদি এমন দেওয়া হয়, যাতে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয় যে সে কেউ না, তাকে কেউ চায়নি, তার চেয়ে বড় মানসিক নিপীড়ন আর কী হতে পারে? তার নামই তো তাকে অহরহ মনে করাবে সে কেউ না, তাই সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে তার কোনও দাবি নেই, থাকতে পারে না। প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য নানা অবহেলায় তাই আমাদের রাজ্যেও শিশুকন্যার অনুপাত ২০০১ থেকে ২০১১’তে ৯৫৭ থেকে ৯৫০-এ নেমে যায়।
আন্না, চায়না, খেন্তি নাম না হলেই কি মেয়েদের প্রতি অবহেলা সব মুছে গেল নাকি? মেয়েদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পুষ্টির ব্যাপারে পরিবারকে উৎসাহিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অন্তত দশ-ক্লাস পাশ করানোর, কম বয়সে বিয়ে রোখার পরিবেশ তৈরি করার দায় আমাদের সকলের। সাইকেল, পড়ার বই, স্কুলের ব্যাগ, পোশাক, খাবার, এই সব কিছুই দরকার। তবে তার সঙ্গেই দরকার একটা প্রিয় নামও, যাতে সেই মেয়ে নিজেকে ভালবাসতে শেখে। তা হলে তার নিজের জন্য সমান অধিকার আদায়ের লড়াইটা আর একটু সহজ হবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.