পালাবদলের অনেক দায়িত্ব। পালন করার বেশি সময় মিলবে, এমন আশা করা ভুল। লোকের দম ফুরিয়ে যায় বড্ড তাড়াতাড়ি। কিছু যে পাল্টানো দরকার, এ ব্যাপারে অনেকের মনে যে সচেতনতা এসেছে, এটা মস্ত প্রাপ্তি। এই বোধটা হারিয়ে যাওয়ার আগে অনেকগুলো জরুরি কাজ করে ফেলা চাই, নইলে পালাবদলের জোয়ার বৃথা যাবে।
হতে পারে যে এই ধরনের একটা আশঙ্কা কারও কারও মনে চাপ সৃষ্টি করছে। সে জন্যই হয়তো পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভা ১৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক অর্ডিনান্স জারি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে লুপ্তপ্রায় লেখাপড়ার ধারা যে এ রাজ্যে ফিরে আসবে না, এ কথা অনেকেরই মনে হচ্ছে।
হস্তক্ষেপের ফলে সর্বনাশ হতে যে বসেছিল, তার সাক্ষী তো আমি নিজেই। তিয়াত্তর সালে কলেজ-শেষের পরীক্ষা দিয়ে সেই যে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম, দেশে-বিদেশে নানা পাড়ায় ঘুরে তারপর এই পাঁচ বছর আগে ফিরে এসেছি এই মাতৃপ্রদেশে। তিয়াত্তর সালে মা কী ছিলেন, আগের ফটো, আর দু’হাজার ছয়ে মা কী হইয়াছেন, পরের ফটো, সে কি আর মিলিয়ে দেখিনি!
নতুন সরকারের অন্য কিছু কিছু উদ্যোগ দেখে যে ভাবে সায় দিতে পেরেছিলাম, এই অর্ডিনান্সের বেলায় সেটা পুরোপুরি কেন পারছি না, তা বুঝিয়ে বলতে একটু সময় লাগবে। যে সরকার পরিবর্তনের দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই সরকারের একটা কাজ তো লক্ষ করা যে দায়িত্ব বলতে কী বোঝায়, পরিবর্তনের কী সংজ্ঞা হওয়ার কথা, এই সব মূল প্রশ্নের আসল বিচারের বড় মাপের দরবার তো সুধীদের আসল কাজের জায়গাতেই যে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিনি রাজ্যের মানুষের চিন্তাশীলদের প্রধান কর্মস্থল হিসেবে। ঘর মোছা বা রাস্তা ধোয়ার জলের গুণমান নিয়ে বেশি মাথা না-ঘামানো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের ব্যাপার। কিন্তু পরিষ্কার জলের যেটা উৎস, সেই বিশ্ববিদ্যালয়কেই যখন পরিষ্কার করতে চাইছেন, তখন তো একটু আটঘাট বেঁধে ভেবে নেওয়া দরকার, ঠিক কী ভাবে সেই পরিষ্ক্রিয়ার কাজটা করলে তার দীর্ঘমেয়াদি ফল ভাল হবে।
বিধানসভা যখন বসছে না, তখন যে-সব জরুরি কাজ থামিয়ে রাখতে নেই, সেগুলোর সূত্রে মন্ত্রিসভা এই অর্ডিনান্স জারি করছেন রাজ্যপাল সই করবেন বলে, পরে অধিবেশন আবার শুরু হলে বিধায়করা দরকার মতো আলোচনা করে তার খুঁটিনাটিতে কিছু রদবদল করে নেবেন, এই রীতি নিয়ে কি আমার খটকা লাগছে তা হলে? না, বিশেষ করে বিধায়কদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেই যে অস্বস্তি বোধ করছি তা নয়। মুশকিলটা কী ধরনের, সেটা দেখতে পাবেন, যদি লক্ষ করেন, এই অর্ডিনান্সের স্বপক্ষে প্রকাশ্যে কী বলা হচ্ছে।
যেমন ধরুন, বলা হয়েছে, এই যে অর্ডিনান্স জারি হচ্ছে, এটা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বা ইউ জি সি-র নিয়মমাফিক। কলেজের বিভাগীয় অধ্যক্ষ প্রভৃতি তাঁদের কলেজ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিষদে প্রতিনিধি পাঠাতে পারবেন, ঠিক যে ভাবে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় চলে, সেই কায়দায়। পশ্চিমবঙ্গের বহু দিনের অচল শিক্ষার চাকা’কে সচল করার পন্থা হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে দিল্লির আদর্শ। এ কথা তো সত্যি যে, এ রাজ্যের অনেক ছাত্র স্কুল পাশ করার পর দিল্লি চলে যায় উচ্চশিক্ষার জন্যে।
উত্তর ভারতের আদর্শের উল্লেখ দেখেছিলাম স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর এক শিষ্যের পত্রালাপেও। স্থানীয় সারস্বত কর্মীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ কেউ এক জন ‘ব্যাকরণের ক্লাসে এই সব বাঙালিসুলভ মুগ্ধবোধ-টোধ তুলে দেওয়া দরকার, স্বামীজি, চলুন আমরা বারাণসীর বিশুদ্ধ ঘরানার সংস্কৃত পঠন-পাঠন চালু করি’ বলে চেঁচামেচি করছেন দেখে স্বামীজি চিঠি লিখে বলেছিলেন, বাপু, তা-ই যদি করতে চাও করো, তথাস্তু, যা করছ মন দিয়ে কোরো। তাঁর বক্তব্যে কিন্তু এই বিশ্বাস ফুটে ওঠেনি যে বারাণসীর প্রিয় সিদ্ধান্তকৌমুদী আমাদের মুগ্ধবোধের চেয়ে শতগুণে শ্রেয়। কথাটা তিনি বলছিলেন সেই শিষ্যের উত্তেজনা কমানোর জন্য। ধরে নিচ্ছি অনুরূপ কারণেই আমাদের রাজ্য সরকার ইউ জি সি-র নির্ধারিত প্রতিমান আর নিয়মাবলিকে কিংবা কলেজ-পরিবৃত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরছেন।
সমস্যার একটা দিক চোখে পড়বে, যদি লক্ষ করি যে, ইউ জি সি বা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু কোনও পর্বেই বিভিন্ন মণ্ডলের সারস্বত কর্মীদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের রীতিনীতির খসড়া চূড়ান্ত করেননি। অন্য লক্ষণীয় দিকটি এই যে, কোনও কোনও ব্যাপারে ইউ জি সি-র নির্দেশ মানতে দেশের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্য; সেই সব বাধ্যতার বন্দোবস্ত করার জন্য মঞ্জুরি কমিশনের আর স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির ব্যবস্থাই যথেষ্ট। তার জন্য স্পষ্টতই রাজ্য সরকারের পৃথক অর্ডিনান্সের প্রয়োজন থাকতে পারে না। অর্থাৎ ধরে নিতে হবে, রাজ্যের মন্ত্রীরা চাইছেন শিক্ষাজগতে আমরা ইউ জি সি-র আবশ্যিক শর্তগুলো পালন করা ছাড়াও বিশেষ কিছু ঐচ্ছিক জিনিস শিখে নিই স্পষ্টতই তাঁরা চাইছেন, দিল্লি থেকে যেন সর্বভারতীয় গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার রীতিনীতির এক রকম সঞ্চার ঘটে এখানকার বিদ্যায়তনের দৈনন্দিন কাজেকর্মে। বহু দিন অনেক বেনিয়ম সহ্য করে বীতশ্রদ্ধ মানুষের সামনে এই আদর্শ তুলে ধরলে খুব বড় ভুল হচ্ছে, এ কথা বলাও শক্ত।
তবু যে কথা বলা জরুরি বলে মনে করছি, তার একটা কারণ, এই বিশেষ কাঁটাকে উপড়ে ফেলতে নতুন সরকার যদি সত্যিই চান, তা হলে আর একখানা কাঁটা দিয়ে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। সমস্যার কারণ স্রেফ দলীয় হস্তক্ষেপ নয়, সরকারের শাসনতন্ত্র-সর্বস্ব হস্তক্ষেপও। দিল্লির কাছে কিছু শেখা দরকার, এ বিষয়ে আমি একমত। কিন্তু মনে হচ্ছে আর একটু পিছিয়ে গিয়ে আমলাতন্ত্রের ছক থেকে কেটে বেরোতে চাওয়া কিছু দিন আগের দিল্লির দিকে তাকালে পারি আমরা।
উনিশশো ছিয়াশি সালে রাজীব গাঁধীর সরকার ওপর থেকে তুঘলকি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার বদলে সারা দেশের দরবারে নতুন শিক্ষানীতির খসড়া দাখিল করে শিক্ষাবিদ এবং সাধারণ নাগরিকদের মন্তব্য চেয়েছিলেন। সেই মন্তব্যের ভিত্তিতে চালু করা হয়েছিল নতুন নীতি। ফল ভাল হয়েছে কি না, মন্তব্যকারীরাই বা কতটা মন দিয়ে ভেবে কথা বলেছিলেন, সে সব বিচার স্বতন্ত্র। আমি কথা বলছি সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রকাশ্য, ‘সবার পরশে পবিত্র করা’ না হলেও অন্তত গ্রহণযোগ্য করার ধরনটা নিয়ে।
গণতন্ত্রের সামাজিক প্রাঙ্গণে শিক্ষাক্ষেত্র কোনও খাপছাড়া জায়গা নয়। সেখানে কিছু সারস্বত কর্মী পঠন-পাঠনের আর গবেষণার দায়িত্ব পালন করেন সকলের হয়ে। যথাযোগ্য বিচার করতে যাঁরা পারেন, সে রকম প্রত্যেক বিচারকের কাছেই তাই সারস্বত কর্মীরা নিজেদের কাজের ভুলচুকের জন্যে জবাবদায়ী। সেই মস্ত দায়িত্ব পালনের পথে যাতে আমরা সত্যি-সত্যিই ফিরতে পারি, তার জন্য ঠিক রাস্তায় চলা সবারই কর্তব্য। এ কাজ সরকারের একার নয়। কিন্তু কোন রাস্তাটা ঠিক, কোন রাস্তাটা ভুল, সেই বিচারের কাজে আমরা সবাই যথাসাধ্য যোগ দিতেই তো চাইব।
রাজ্য সরকার যদি শিক্ষানীতির দু’খানা খসড়া দলিল প্রস্তুত করে কোনও একটা ওয়েবসাইটে টাঙিয়ে দেন একটা ইস্কুলের, একটা উচ্চশিক্ষার তা হলে এই রাস্তা খোঁজার কাজটাতে সবাই যোগ দিতে পারবেন সহজে। সে কথাটার উপরেই জোর দিতে চাইছিলাম। অর্ডিনান্সটা নিয়ে চেঁচামেচি করা উদ্দেশ্য নয়। এই দলিলটা যদি রাজ্যপালের স্বাক্ষরের পর বিধানসভায় কোনও কারণে আলোচিত না-ও হয় তর্কের খাতিরে ধরা যাক হয়তো বিশেষ জরুরি আপত্তি তুলবেন না কেউ, হয়তো আপত্তি করলেও মনোযোগ্য কোনও বিকল্প প্রস্তাব করবেন না তা হলেও বলব, ভাল কথা, একটা সুযোগ ফসকে গেল; যা গেছে তা যাক; কিন্তু পরের বার মন্ত্রিসভা পাঁচ জনের সঙ্গে বসে কাজটা করতে চাইবেন নিশ্চয়ই?
কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক |