হাওড়া জেলার আমতা থানার মানিকুয়া গ্রামে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা ব্যতিক্রম নয়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-গ্রামে দীর্ঘ কাল ‘ষোলো আনা কমিটি’র নামে সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা চালু রহিয়াছে। ইহা নির্বাচিত পঞ্চায়েত নয়, পঞ্চায়েত-পূর্ব যুগের চণ্ডীমণ্ডপও নয়। তবু এই সংস্থা মারফতই গ্রামীণ মাতব্বররা বিভিন্ন বিবাদের নিষ্পত্তি করিয়া থাকেন। তাঁহাদের রায়ই শেষ কথা, যাহার বিরুদ্ধে থানায় কিংবা আদালতে কোনও আবেদন করার অনুমতি নাই। করিলে জরিমানা ছাড়াও সামাজিক বয়কট অর্থাৎ ধোপা-নাপিত বন্ধ করার অধিকার ষোলো আনা কমিটির আছে। মানিকুয়া গ্রামের কমিটির বৈশিষ্ট্য ইহাই যে, এখানে কমিটির স্বেচ্ছাচারকে বৈধতা দিতে ২৮টি অনুচ্ছেদ সংবলিত একটি লিখিত সংবিধান পর্যন্ত রহিয়াছে। ষোলো আনা কমিটিগুলি অভিনব বন্দোবস্ত নয়। চণ্ডীমণ্ডপেরই ধারাবাহিকতা।
এমন মধ্যযুগীয় বন্দোবস্ত কেমন করিয়া আধুনিক গণতন্ত্রে টিকিয়া আছে? বিশেষত সেই রাজ্যে, যেখানে তিন দশকেরও বেশি কাল ধরিয়া নির্বাচিত, প্রতিনিধিত্বমূলক স্বশাসিত সংস্থা পঞ্চায়েতকে বামপন্থীরা বিধিবদ্ধ গ্রামীণ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন? অন্যান্য আরও অনেক কিছুর মতো এ ক্ষেত্রেও শাসক বামপন্থীরা মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের সহিত আপস করিয়া লইয়াছেন। ষোলো আনা কমিটির কর্তৃত্ব উচ্ছেদ করিয়া তাহার স্থলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব কায়েম করার আধুনিক গণতান্ত্রিক তাগিদ সরাইয়া রাখিয়া তাঁহারা নিজেরাই ষোলো আনা কমিটির হর্তাকর্তা হইয়া উঠিয়াছেন। তাই গ্রামীণ মাতব্বরদের জারি করা জরিমানা না দিলে সামাজিক বয়কটের শিকার হওয়ার সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচার এখনও এ রাজ্যের গ্রাম-সমাজে টিকিয়া আছে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ চোখ বুজিয়া থাকে। অথচ ষোলো আনা কমিটি তো কোনও হঠাৎ গজাইয়া ওঠা প্রতিষ্ঠান নয়।
এ ভাবে সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা গড়িয়া তোলার অভ্যাসটি গণতন্ত্রের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু, রাজনীতির কারবারিরা ইহার মধ্যে দোষের কিছু দেখেন না। তাঁহাদের সওয়াল, এ ভাবে যদি স্থানীয় স্তরেই ছোটখাটো বিরোধগুলির মীমাংসা হইয়া যায়, তবে আদালতের বোঝা কমে, থানা-পুলিশও করিতে হয় না। ইহা গণতন্ত্রের যুক্তি নয়। ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সকলেরই আছে। কমিটির বিচার যে প্রায়শ ‘কাজির বিচার’-এ পরিণত হয়, তাহার কারণটিও সহজবোধ্য। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে কোনও কিছুই আর অরাজনৈতিক নয়, সব কিছুই রাজনৈতিক এবং দলীয়। তাই ষোলো আনা কমিটিও প্রকারান্তরে গ্রামীণ সমাজজীবনে দলীয় রাজনীতিকদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার খিড়কি-দুয়ারি প্রয়াস হইয়া ওঠে। আইনের শাসন কায়েম করা যাহার কাজ, সেই প্রশাসন কোনও মতেই এ ধরনের স্বেচ্ছাচারের প্রতি চোখ বুজিয়া থাকিতে পারে না। তাহার তৎপর হওয়ার প্রয়োজন আছে। জেলার পুলিশ সুপার যেমন বলিয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গ ‘মগের মুলুক’ নয়, নিগৃহীতের অভিযোগ পাইলে অবশ্যই তদন্ত করা হইবে? কিন্তু অভিযোগ না পাইলে? গ্রামীণ কায়েমি স্বার্থচক্রের দ্বারা অত্যাচারিত ব্যক্তি যদি অভিযোগ করার মতো সাহস সঞ্চয় করিতে না পারেন কিংবা ভয় দেখাইয়া বা গায়ের জোরে তাঁহাকে অভিযোগ দায়ের করিতে না-দেওয়া হয়, তখন কী করা হইবে? হাত গুটাইয়া বসিয়া পুলিশ ও প্রশাসন সেই মগের মুলুকই প্রতিষ্ঠা হইতে দিবে, নাকি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হইবে? |