ক জন বিধায়ক কোনও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি। আর, মুখ্যমন্ত্রী হইলেন রাজ্যের প্রধান প্রশাসক। গণপ্রতিনিধি তাঁহার অঞ্চলের সমস্যা লইয়া প্রয়োজনে রাজ্যের প্রধান প্রশাসকের দ্বারস্থ হইবেন, তাহাই নিয়ম হওয়া উচিত। কিন্তু, মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে দাঁড়াইয়া আছেন বিরোধী দল সি পি আই এম-এর বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা, স্মিত হাস্যে পরস্পরকে নমস্কার করিতেছেন এই ছবিটি প্রবল ব্যতিক্রমী। ব্যতিক্রমী, কারণ রাজ্যটির নাম পশ্চিমবঙ্গ। শাসক ও বিরোধী এই দুই পক্ষের মধ্যে জলচল থাকিবে না, ইহাই এই রাজ্যে নিয়ম। দুই পক্ষের সম্পর্ক শুধু বিরোধিতার, নেতির।
আজকের শাসকরা এই নেতির পথ পরিক্রমা করিয়াই মসনদে পৌঁছাইয়াছেন। অধুনা বিরোধী পক্ষও একই পথের পথিক। সেই বিরোধিতার সম্পর্ক পশ্চিমবঙ্গকে ক্রমে বিপন্ন করিয়াছে, শিল্পহীনও। নয়াচরের শিল্পতালুক অথবা শালবনির লৌহ ইস্পাত প্রকল্পের জটিলতা কাটিবে, এমন সম্ভাবনা ক্রমে স্পষ্ট হইতেছে। প্রকল্পগুলি নূতন নহে, সবই বামফ্রন্টের আমলের। যে জটে তাহাদের গতি রূদ্ধ হইয়াছিল, তাহাও যে সমাধানাতীত নহে, বর্তমান সম্ভাবনা তাহা প্রমাণ করিতেছে। তবে, বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই এই জট কাটে নাই কেন? কারণ, প্রকল্পগুলি ক্ষুদ্র রাজনীতির পাঁকে বন্দি হইয়া পড়িয়াছিল। তৎকালীন সরকার সচেষ্ট হইলে কি শালবনিতে জমির সমস্যার সমাধান করা যাইত না? দোষ অবশ্য শুধু শাসকপক্ষেরই ছিল না। নন্দীগ্রামে সফল আন্দোলনের পর রাসায়নিক শিল্পতালুক যখন নয়াচরে স্থানান্তরিত হইল, তখন তৎকালীন বিরোধী পক্ষে শুধু তাহার বিরোধিতাই করিয়াছিল। রাসায়নিক শিল্পের পরিবর্তে অন্য কোন শিল্প হওয়া সম্ভব, সেই সংক্রান্ত কোনও মতামত বিরোধী শিবির হইতে পাওয়া যায় নাই। এখন যে বিকল্পগুলির সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, দেড় বৎসর পূর্বে তাহা কি কল্পনাতীত ছিল? না কি, নেতির রাজনীতি সেই বিকল্প চিন্তার পথে অনতিক্রম্য বাধা হইয়াছিল? ভবিষ্যতের পশ্চিমবঙ্গ তাহার অতীতের নিকট এই প্রশ্নগুলির উত্তর দাবি করিবে।
ভবিষ্যতের পশ্চিমবঙ্গ বর্তমানের রাজনৈতিক দলগুলিকে অপরাধী সাব্যস্ত করিবে। কিন্তু, একমাত্র নহে। পশ্চিমবঙ্গকে এমন বন্ধ্যা করিয়া তোলার দায় মুখ্যত এই রাজ্যের বাসিন্দাদের। রাজনীতি সমাজের প্রতিফলনমাত্র। বঙ্গসমাজ বিশ্বাস করিয়াছে, নেতির পথই রাজনীতির প্রকৃত পথ রাজনৈতিক দলগুলি সেই বিশ্বাসের সম্মান রাখিয়া নেতির পথে হাঁটিয়া গিয়াছে। আধুনিক বঙ্গ রাজনীতিতে এমন কোনও নেতা নাই, যিনি মানুষকে পরিচালনা করিতে পারেন, যথার্থ পথে লইয়া যাইতে পারেন। বর্তমানের নেতারা অনুসরণকারীমাত্র তাঁহারা জনতার চাহিদা বুঝিয়া রাজনীতির জোগান দিয়াছেন। নেতারা অক্ষম, কিন্তু তাঁহাদের অক্ষমতায় জনতার দোষ লাঘব হয় না। যে সিঙ্গুরের আন্দোলনকে কেন্দ্র করিয়া বঙ্গ রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুনর্জন্ম হইয়াছিল, তাহা নেতিবাচক রাজনীতির উদাহরণ। কিন্তু সেই নেতিবাচকতায় মানুষ রুষ্ট হয় নাই, সেই রাজনীতির কাণ্ডারিদের প্রত্যাখ্যান করে নাই, বরং বরণ করিয়া লইয়াছে। তবে, এখনও বুঝি আশা আছে। এক দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকাংশে নেতি ছাড়িয়া ইতির পথে হাঁটিবার চেষ্টা করিতেছেন, আমরা বনাম ওরা-র পথ পরিহার করিয়া চলিতে চাহিতেছেন। অন্য দিকে শালবনি বা নয়াচরে অচলাবস্থা দূর করিবার যে চেষ্টা চলিতেছে, তাহা এখনও ‘বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা’-র সম্মুখীন হয় নাই। তবে কি রাজ্যে সত্যই পরিবর্তন আসিল? এখনই বলা কঠিন। তবু আশা থাক। পরিবর্তন সচরাচর অপ্রত্যাশিত বেগেই ঘটে। সেই পরিবর্তনের সূচনালগ্নটি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় ‘টিপিং পয়েন্ট’ হিসাবে পরিচিত কিছু অমোঘ উপাদানের সংযোগে পরিবর্তনের গতি অর্জনের মুহূর্ত। ভবিষ্যৎ বলিবে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ তেমনই এক মুহূর্তে দাঁড়াইয়া আছে কি না। |