|
|
|
|
ছাত্র ভর্তিতে বন্ধ লটারিও |
ফেল রদে সিঁদুরে মেঘ দেখছে শিক্ষাজগৎ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
প্রাথমিকে পাশ-ফেল উঠে গিয়েছে বামফ্রন্টের আমলেই। আরও এক ধাপ এগিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা তুলে দিচ্ছে রাজ্যের নতুন সরকার। সেই সঙ্গে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি প্রথারও বিলোপ ঘটছে। বৃহস্পতিবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ২০০৯ সালে সংসদে পাশ হওয়া শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী শিশুদের স্কুলে ভর্তির সময় প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে লটারিও বন্ধ হলে কোন পদ্ধতিতে ভর্তি হবে, তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।
গত মঙ্গলবারেই এক আলোচনাসভায় রাজ্যের বেশির ভাগ শিক্ষক সংগঠন জানিয়ে দিয়েছিল, তারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা রদের বিরোধী। তাদের মতে, দুর্বল পড়ুয়াদেরও পরের ক্লাসে তুলে দিলে আখেরে তাদের এবং গোটা শিক্ষা ব্যবস্থারই ক্ষতি হবে। কিন্তু শিক্ষক সংগঠনগুলির মতামতকে খুব একটা আমল না-দিয়ে রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা তুলে দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল।
অক্টোবরে দিল্লিতে এক বৈঠকে যোগ দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছিলেন, বর্তমান রাজ্য সরকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। তা হলে সরকার হঠাৎ একেবারে উল্টো সিদ্ধান্ত নিল কেন?
ব্রাত্যবাবুর জবাব, “মুখ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন পার্থবাবু। তিনি বলেন, “পরীক্ষা থাকবে। কিন্তু কাউকে আটকে রাখা যাবে না।” তাঁর কথায়, রাজ্য সরকার মেধা ও উৎকর্ষে বিশ্বাসী। পরীক্ষা রাখা দরকার দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য। যেমন, সাপ্তাহিক পরীক্ষায় পাশ-ফেল থাকে না। |
|
সাংবাদিক বৈঠকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও ব্রাত্য বসু। ছবি: দেবাশিস রায় |
শিক্ষার অধিকার আইনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা না-রাখার কথাই বলা হয়েছে। শিক্ষকদের অনেকে মনে করেন, এর পিছনে যুক্তি রয়েছে। কিন্তু তার জন্য দরকার যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষক এবং সুষ্ঠু পরিকাঠামো। তার ব্যবস্থা না-করে পাশ-ফেল ব্যবস্থা তুলে দিলে আখেরে ক্ষতিই হবে।
স্কুলশিক্ষা দফতর গঠিত পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান সুনন্দ সান্যালও সরকারের এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করছেন না। তিনি বলেন, “পাশ-ফেল তুলে দেওয়াটা উচিত হবে না। কেন সরকার এই সিদ্ধান্ত নিল, বুঝতে পারছি না।” প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকারের বক্তব্য, “এই সিদ্ধান্তটা ভাল হল না। পড়ুয়ারা কেমন লেখাপড়া শিখছে, সেটা তারা নিজেরাও বুঝবে না, তাদের বাবা-মায়েরাও কিছু জানতে পারবেন না। আমার ধারণা, সরকারকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে।”
তাদের আপত্তি সত্ত্বেও রাজ্য সরকার পাশ-ফেল ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অনেক শিক্ষক সংগঠনই ক্ষুব্ধ। বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কার্তিক সাহা বলেন, “আগের সরকার নিজেদের সিদ্ধান্ত সকলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে রাজ্যের সর্বনাশ করেছে। এই সরকারও দেখছি, সে-ভাবেই কাজ করছে! অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দিয়ে মাধ্যমিক স্তরের পঠনপাঠনের চরম সর্বনাশ করছে রাজ্য সরকার।”
নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি (এবিটিএ)-র সাধারণ সম্পাদক উৎপল রায় মনে করেন, এতে পড়াশোনার মান পড়ে যাবে। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল না-থাকলেও চলে। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তা তুলে দিলে সমস্যা। কারণ, দু’বছর পরে ওই পড়ুয়াদেরই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে হবে।” মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আগের সরকার চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দিয়েছিল। তার পরিণাম কী ভয়াবহ হয়েছে, তা কারও অজানা নয়। তাই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য নতুন সরকারকে অনুরোধ করছি।”
এ দিকে, স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি প্রথা বিলোপের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে পার্থবাবু বলেন, “আমরা লটারি প্রথার বিরোধী।” ব্রাত্যবাবুর মতে, লটারি এক রকম জুয়া। মেধা থাকলেও লটারিতে ভর্তির সুযোগ না-ও মিলতে পারে। আবার মেধার বিচারে পিছিয়ে থাকা এক জন লটারিতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। শিশুমনে এর প্রভাব পড়ে। আমরা সেটা বন্ধ করতে চাই।
শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী ভর্তির জন্য শিশুদের প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়াও নিষিদ্ধ। লটারিও রদ হয়ে গেল। তা হলে ভর্তির মাপকাঠি কী হবে?
শিল্পমন্ত্রী জানান, কী ভাবে ছাত্র ভর্তি হবে, স্কুলগুলিই তা ঠিক করবে। তার একটা প্রতিলিপি শুধু শিক্ষা দফতরে পাঠাতে হবে। ছাত্র ভর্তি নিয়ে সরকার কোনও ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না। যদি এই নিয়ে কোনও অনিয়মের অভিযোগ শিক্ষা দফতরে জমা পড়ে, তখনই সরকার বিষয়টি দেখবে।
শিল্পমন্ত্রী এ কথা বললেও সাংবাদিক বৈঠকের পরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “আমি, মুখ্যসচিব ও স্কুলসচিব আলোচনা করে ছাত্র ভর্তি নিয়ে একটি নির্দেশিকা তৈরি করব। স্কুলে স্কুলে তা পাঠিয়ে দেওয়া হবে।” স্কুলশিক্ষা দফতর এর আগে জেলায় জেলায় সার্কুলার পাঠিয়ে জানিয়েছিল, লটারির মাধ্যমেই ছাত্র ভর্তি করা হবে। ইতিমধ্যে মন্ত্রিসভায় লটারি প্রথা বাতিলের সিদ্ধান্ত হওয়ায় ভর্তির পদ্ধতি নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। |
|
|
|
|
|