|
|
|
|
বাড়তি ক্ষমতা বিডিওদের |
উন্নয়নের সমন্বয়ে প্রশাসনিক কমিটি |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
উন্নয়নের কাজে আরও ‘গতি এবং সমন্বয়’ আনতে গোটা রাজ্যেই মহকুমাশাসক (এসডিও) এবং বিডিও’দের বাড়তি ক্ষমতা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উন্নয়নের কাজকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ করার লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ বলে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ‘অচল’ হয়ে-পড়া রাজ্যের প্রায় ৫০ ভাগ পঞ্চায়েত এলাকায় উন্নয়নের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবেন বিডিও-রা। পঞ্চায়েতে কোনও ‘অচলাবস্থা’ তৈরি হলে বিডিও-রা ‘প্রয়োজনে’ হস্তক্ষেপ করতে পারবেন। জঙ্গলমহলের ‘অচল’ পঞ্চায়েতগুলির জন্য যে সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। উন্নয়ন এবং সরকারি কাজে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে ত্রিস্তরীয় প্রশাসনিক কমিটি হবে জেলাশাসক, মহকুমাশাসক এবং বিডিও-দের নিয়ে। জেলা স্তরে জেলাশাসক, মহকুমা স্তরে মহকুমাশাসক এবং ব্লক স্তরে বিডিও ওই নজরদারি কমিটির মাথায় থাকবেন।
গ্রামাঞ্চলে উন্নয়নের গোটা প্রক্রিয়াই যে হেতু ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে রূপায়িত হয়, তাই সেই ব্যবস্থাকে ‘রাজনীতির রং’-এর বাইরে আনতে চাইছেন মমতা। পঞ্চায়েতে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেই যাবতীয় কাজ করার যে ‘মডেল’ চালু আছে, তাতে দুর্নীতি এবং ‘দলবাজি’ আটকানো যায় না এই যুক্তি দেখিয়েই ভিন্ন ‘মডেল’ আনতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা বাদে বাকি জেলাগুলির মহকুমাশাসক ও বিডিও-দের নিয়ে বৃহস্পতিবার কলকাতার টাউন হলে প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্টই বলেছেন, পঞ্চায়েত এবং গ্রাম সংসদগুলি ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠান থাকুক। কিন্তু উন্নয়নের কাজে সেখানে যেন রাজনীতি না-হয়। বিডিও-দের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, ‘রাজনীতির ঊর্ধ্বে’ উঠে এবং ‘স্বচ্ছতা’ বজায় রেখে কাজ করুন।
পঞ্চায়েতে উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ করতে মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ নিয়ে এ দিন থেকেই অবশ্য রাজনৈতিক বিতর্ক’ই শুরু হয়ে গিয়েছে। বিরোধী বাম শিবিরের অভিযোগ, পঞ্চায়েতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপরে ‘আমলাতান্ত্রিক নজরদারি’র ব্যবস্থা চালু হবে এর ফলে। কিন্তু মমতার যুক্তি, পঞ্চায়েতে কোনও সমস্যা দেখা দিলে লোকে সচরাচর বিডিও-দের ধরে। তাই তাঁদের হাতেই বেশি ‘ক্ষমতা’ থাকা উচিত। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কোনও ‘সমস্যা’ হলে তাঁদের ‘তিরস্কার’ করার জন্য জনতাকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়। সরকারি আধিকারিকদের ক্ষেত্রে প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবে। তা ছাড়া, জনপ্রতিনিধিরা যে হেতু দলীয় টিকিটে নির্বাচিত হন, তাই দলের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। সরকারি আধিকারিকদের দায়বদ্ধতা থাকে সরকারের প্রতিই। তাই তাঁদের ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা সরকারের পক্ষে তুলনায় সহজ।
বিরোধী নেত্রী থাকার সময় মমতা বারেবারেই বলতেন, বিডিও, মহকুমাশাসক, জেলাশাসকদের
হাতে উন্নয়নের কোনও ক্ষমতাই নেই। সব ক্ষমতা ‘দলতান্ত্রিক’ ভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছে শাসক পক্ষ। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা এখন আমলাদেরই ‘ক্ষমতা’ দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। এবং তা করতে গিয়ে রেয়াত করছেন না তাঁর নিজের দলকেও। কারণ, রাজ্যের গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির মধ্যে একটি বিরাট অংশই এখন তৃণমূলের হাতে। আগামী পঞ্চায়েত ভোটে বহু আসনে তারা প্রার্থী দিতে পারবে না বলে বামফ্রন্টই মনে করছে। এই পরিস্থিতিতে আমলাদের হাতে বাড়তি ক্ষমতা দিতে গিয়ে তাঁর নিজের দলের গুরুত্বও যদি সঙ্কুচিত করতে হয়, তাতে যে ‘প্রশাসক’ মমতা পিছপা নন তাঁর এই সিদ্ধান্তে সেই মনোভাবই স্পষ্ট।
তবে মমতার দলেরই একাংশের ধারণা, মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি বড় বেশি আমলা এবং প্রশাসন-নির্ভর হয়ে পড়ছেন। বেশি ‘আমলানির্ভর’ হয়ে পড়া যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভরাডুবির অন্যতম কারণ ছিল, তা-ও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে উন্নয়নের প্রত্যাশাপূরণ না-হলে মানুষের যাওয়ার জায়গা বলতে প্রশাসনই থাকে। তাই ‘প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে’র একটা ‘কার্যকরী ব্যবস্থা’ থাকা দরকার। |
|
কলকাতার টাউন হলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিডিও এবং মহকুমাশাসকদের বৈঠক। নিজস্ব চিত্র |
বামফ্রন্ট জমানার দু’টি ‘উল্লেখযোগ্য সাফল্যে’র অন্যতম হিসাবে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ধরা হয়। কিন্তু যে কোনও ব্যবস্থাতেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন ঘুণ ধরে, বাম আমলের শেষ দিকেও পঞ্চায়েতগুলি তেমন ‘দলবাজির আখড়া’য় পরিণত হয়েছিল বলে অভিযোগ। ত্রাণ বিলি নিয়েও ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ আসত। সেই ভেঙে-পড়া ব্যবস্থাকেই নতুন করে সাজাতে চাইছেন মমতা। এবং সেই লক্ষ্যে তিনি যে ‘মডেল’ নিয়েছেন, তা নিয়েই রাজনৈতিক বিতর্ক বাধছে। মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের জেরেই প্রশ্ন উঠেছে, এর ফলে কার্যক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং আমলাদের মধ্যে সংঘাত দেখা দেবে না তো? মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এই আশঙ্কা দূর করতে এ দিনের বৈঠকের পরে আশ্বাস দিয়েছেন, “জেলায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সঙ্গে এই ত্রিস্তর প্রশাসনিক কমিটির কোনও সংঘাত হবে না। যদি হয়, তখন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা হবে।”
উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘আমলাতান্ত্রিক মডেলে’র আমূল বিরোধিতা করছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। তাদের মতে, উন্নয়ন একটি ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’। তা ছাড়া, দুর্নীতি বা ‘দলতন্ত্র’ আটকাতে পঞ্চায়েত স্তরে জনপ্রতিনিধিদের উপরে আমলাদের নজরদারি চালাতে হলে বিধায়ক, সাংসদদেরও সেই একই প্রক্রিয়ায় আনতে হয়! বিরোধী দলনেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “সরকার রিভার্স গিয়ারে চলছে! ইতিহাসের চাকা কখনও পিছন দিকে ঘোরানো যায় না। বাম আমলে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের নীতি ছিল। এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপরে আমলাতান্ত্রিক নজরদারি চাপানো হচ্ছে। এ সবই গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রে উল্টো যাত্রা!” পঞ্চায়েত স্তরে ‘গণতন্ত্রকে খর্ব করা’র চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাম শরিক সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুকুমার মজুমদারও।
মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরে সরকারের এক মুখপাত্র জানান, আগের মতো এখনও পঞ্চায়েত গ্রামোন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করবে। কিন্তু কোথাও ‘অচলাবস্থা’ তৈরি হলে বিডিও, এসডিও-রা হস্তক্ষেপ করবেন। এই নির্দেশ আগে ছিল না। গ্রামাঞ্চলে পরিকল্পনা তৈরির পাশাপাশি আর্থিক অনুমোদনের দায়িত্ব পালন করে পঞ্চায়েত সমিতির সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটি। কিন্তু যেখানে পঞ্চায়েত কাজ করছে না, সেখানে প্রশাসন ও আর্থিক দুই দায়িত্বই বিডিও-দের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। প্রসঙ্গত, পঞ্চায়েতে আর্থিক কাজকর্মের জন্য ফিনান্সিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের ব্যবস্থা অবশ্য বর্তমান আইনেই আছে।
টাউন হলের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর পরিষ্কার নির্দেশ, যেখানে পঞ্চায়েত বন্ধ রয়েছে অথবা কাজ করছে না, সেখানে জনকল্যাণমূলক কাজের দায়িত্ব নেবেন বিডিও-রা। যাঁদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁদের চোখ দিয়েই সরকার প্রশাসনকে দেখে। ব্লক স্তরে তাঁদেরই ‘নেতৃত্ব’ দিতে হবে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করতে মুখ্যমন্ত্রী এ মাসে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান, বীরভূম, হাওড়া ও হুগলিতে যাবেন। পরের মাসে দুই দিনাজপুর, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও মালদহে যাবেন বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি মানতে রাজি নন সিপিএম নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সাফল্য মেনে নিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী, কয়েকটি রাজ্যও বামেদের পথ গ্রহণ করেছিল। সংবিধান সংশোধন করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। গণতান্ত্রিক উপায়ে বিকেন্দ্রীকরণের এই ‘মডেল’ ভাঙতে যাওয়ার চেষ্টা ‘যুক্তিহীন’। বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুর কথায়, “আমলাদের বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই। তাঁরা সরকারের আবশ্যিক অংশ। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের উপরে তাঁদের বসিয়ে দেওয়া যায় না। দুর্নীতির দায়ে এখন যাঁরা তিহাড় জেলে আছেন, তাঁদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, আমলা সবাই তো আছেন!” প্রাক্তন পঞ্চায়েতমন্ত্রীর আরও মন্তব্য, “দলের জন্য আনুগত্য বিধায়ক, মন্ত্রী, সাংসদ সকলেরই থাকে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও একটি দলের হয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তা হলে তাঁদের সকলের উপরে নজরদারির ব্যবস্থা করতে হয়! জনপ্রতিনিধির কাজে সন্তুষ্ট না-হলে ভোট দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার তো মানুষের হাতে আছেই!”
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের শেষে প্রশাসনের নিচু তলার ‘স্তম্ভ’দের অধিকাংশ দৃশ্যতই ‘আপ্লুত’ ছিলেন। পঞ্চায়েতমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব-সহ একাধিক সচিবের সামনে খোলামেলা সমস্যার কথা বলতে পেরে তাঁরা খুশি। মমতা বলেন, “৫০ জন আলোচনা করেছেন। বৈঠক সফল।” মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বৈঠকে জানান, ত্রিস্তরীয় কমিটি গঠন নিয়ে দু’এক দিনের মধ্যে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হবে। প্রতি মাসে কমিটি বৈঠক করে রিপোর্ট দেবে। বিডিও’দের অনেকেই উন্নয়নের কাজে আরও ক্ষমতা এবং নিরাপত্তারক্ষী পেতে সওয়াল করেন। মুখ্যমন্ত্রীও যথাসম্ভব আশ্বাস দেন। |
|
|
|
|
|