সলমন বাট, মহম্মদ আসিফ, মহম্মদ আমেরদের বিচার যখন চলছিল, আমি তখন চীনে ছিলাম। কিন্তু বিচারের খবরাখবর পাচ্ছিলাম সব সময়। এখন আমি দুবাই বিমানবন্দরে বসে। গভীর রাতে ইসলামাবাদ পৌঁছব। আর আমি নিশ্চিত যে, আগামী কয়েক দিনে এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাল রকম সরগরম হবে পাকিস্তান।
প্রথম প্রতিক্রিয়াটা দিতে গিয়ে আমি দুঃখ পাচ্ছি দু’টো কারণে। এক, এই তিন ক্রিকেটারের পরিবারের কথা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সলমন বাট অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। কিন্তু আসিফ-আমেরকে খুব খারাপ অবস্থা থেকে উঠে আসতে হয়েছে। এই খবরে বিশাল ধাক্কা খাবে ওদের পরিবার। আর দ্বিতীয়ত, ক্রিকেটার আমেরের প্রতিভা প্রথমবার দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। দুর্ভাগ্য পাক ক্রিকেটের, আমেরের এমন পরিণতি হল। ব্যাপারটা কী মনে হচ্ছে জানেন? একজন তরুণ ক্রিকেটার এমন একটা আবহাওয়ায় হাজির, যেখানে বাকি সবাই ওর মজ্জায় ঢুকিয়ে দিল যে, অপরাধ করলেই তুমি টাকা পাবে। আমেরের অসামান্য প্রতিভা ছিল। এমনকী ওয়াসিম আক্রমকেও আঠারো বছরে আমার এতটা দুর্দান্ত লাগেনি, যেটা আমেরকে লেগেছিল।
যা-ই হোক, মনটা খারাপ হয়ে থাকলেও আমি মনে করি এই সিদ্ধান্তে পাকিস্তান ক্রিকেটের ভালই হবে। ক্রিকেটকে পরিচ্ছন্ন রাখতে এর চেয়ে বড় পদক্ষেপ তো ক্রিকেট-প্রশাসকরা আর নেননি। দেশবাসী হিসাবে আমাদের ভাবা উচিত নয় যে পাক ক্রিকেটারদের বলির পাঁঠা করা হল।
ক্রিকেট বিশ্বেরও বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ানোর এ বার সময় এসেছে। আমাদের বোঝা উচিত, গড়াপেটা ধরা প্রায় অসম্ভব, বিশেষ করে স্পট ফিক্সিং। ব্যাটসম্যান যদি একটা ‘মেডেন’ ওভার বোলারকে দেয়, তা হলে কী করে বুঝবেন যে সেটা বোলারের কৃতিত্ব, নাকি ব্যাটসম্যান টাকা খেয়েছে? বোলার ‘নো বল’ করলেও বা কী ভাবে বুঝবেন যে, ‘নো-বল’টা সত্যিই হয়েছে, নাকি তার পিছনে কাজ করছে কোনও অপরাধী মানসিকতা? হ্যান্সি ক্রোনিয়ে ধরা পড়েছিল পুলিশ হঠাৎই ওর কথাবার্তা শুনে ফেলায়। আর এরা যে ধরা পড়ল, তার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য স্টিং অপারেশনের। কিন্তু কপালের জোরে কখন এ সমস্ত জিনিস ধরা পড়বে, তার উপর নিশ্চয়ই ভরসা রাখতে পারে না আইসিসি এবং বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ড। আমার মনে হয়, গড়াপেটা ধরার সেরা উপায়টা হল ক্রিকেটারদের অ্যাকাউন্টের উপর নজর রাখা। রাজনীতিবিদরা যে ভাবে করে, ক্রিকেটারদেরও ঠিক তেমনই উচিত নিজেদের সম্পত্তির হিসেবপত্র পরীক্ষার জন্য ছেড়ে দেওয়া। ক্রিকেটকে পরিচ্ছন্ন করার কাজটা তা হলেই ঠিকঠাক শুরু করা যাবে।
আর পাকিস্তান ক্রিকেট? আমার মনে হয় গোটা ক্রিকেট-সিস্টেমটাকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দেওয়া উচিত। বোর্ড প্রেসিডেন্ট কে হবেন, সেটা বছরের পর বছর দিব্যি বেছে চলেছেন দেশের প্রেসিডেন্ট। আর দেশের প্রেসিডেন্ট বোর্ডে হস্তক্ষেপ করায় বোর্ড প্রধান হয়ে যাচ্ছেন স্রেফ তাঁর হাতের পুতুল। আজ আমাদের এই অবস্থা কারণ আগের ঘটনাগুলো সুবিধার বিচারে দেখা হয়েছিল। ন্যায়-অন্যায়ের বিচারে ভাবা হয়নি। পাকিস্তানে ক্রিকেট কী ভাবে চলে, সেটা খুঁটিয়ে দেখা উচিত। আর এখনই তার সেরা সময়।
আমার সন্দেহ আছে পাকিস্তানের আমজনতা এই তিন জনের প্রতি কোনও সহানুভূতি দেখাবে কি না। কারণ একটার পর একটা দুর্নীতি দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে দেশটা। অণ্ণা-ঢেউ যেমন ভারতে আছড়ে পড়েছে, তেমনই পাকিস্তানে আছড়ে পড়েছে দুর্নীতি-বিরোধী ঢেউ। আর এই ঘটনা দেশের তরুণদের সম্ভবত আবার বোঝাবে যে, অপরাধ করে কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। জীবনের সব ক’টা ক্ষেত্রেই পরিচ্ছন্নতাটা বজায় রাখা দরকার।
ম্যাচ গড়াপেটা নিয়ে এই পুরো ব্যাপারটাই আসলে খেলাটার আত্মায় ক্ষয় ধরিয়ে দিচ্ছে। আমাকেও অনেকে জিজ্ঞেস করছেন, আচ্ছা, আপনাদের সময় এই জিনিস ঘটত? সত্যি কথা বলতে, ঘটত কী ঘটত না, সেটা বলা খুব মুশকিল। অন্যান্য দেশেও হয়তো ঘটে থাকতে পারে। আমার মতে, ম্যাচ ফিক্সিং এবং একটা পর্যায় পর্যন্ত স্পট ফিক্সিং ঘটানো সম্ভব নয় অধিনায়কের মদত ছাড়া।
আসিফ, সলমনের ক্রিকেটে ফেরার রাস্তাটা যে চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেল তা নিয়ে আর সন্দেহ নেই। আমের হয়তো শুধু আবার খেলতে পারে। এটা ঠিক যে, পাঁচ বছর লম্বা সময়। এই অপবাদ ও কী ভাবে সামলাবে সেটা দাঁড়িয়ে থাকবে ওর মানসিক গঠনের উপর। তবু বলব, আমেরের মধ্যে যা প্রতিভা দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে এমন গভীর সঙ্কট সামলে ও হয়তো একদিন আবার দেশের জন্য খেলবে। |