এক দিকে পরিবার, অন্য দিকে গোটা ক্রিকেট দুনিয়া। পাকিস্তানের তিন ক্রিকেটারের শাস্তির ঘোষণা হওয়ার পরই দেশে তাঁদের পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। কারও বাবা মনে করছেন, তাঁর ছেলেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ফাঁসানো হয়েছে। কারও মা-র হা হুতাশ, ছেলেকে আর দেখতে পাবেন তো? এই শোকের ছায়ার মধ্যেই আবার ক্রিকেট মহল মনে করছে, খেলাটার শাপমোচনের জন্য সলমন, আসিফ, আমেরদের এই শাস্তি দরকার ছিল।
জুলফিকার (সলমন বাটের বাবা): আমার ছেলেকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে। এই মামলায় আসলে সত্যি কী ঘটছে, তা তুলে ধরার জন্য আমি নির্দিষ্ট নথিপত্র আর প্রমাণ পেশ করব।
নাসিম আখতার (মহম্মদ আমেরের মা): আমার ছেলে নির্দোষ। যা করেছে অধিনায়কের কথাতেই করেছে। দু’দিন আগেই ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। এমনিতে আমি খুব অসুস্থ। ছেলে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমার সঙ্গে আর দেখা হবে কি না, জানি না।
রুবাব (সলমন বাটের বোন): আমার মায়ের শরীর খুব খারাপ। সলমনের স্ত্রীর বাচ্চা হওয়ার পর থেকে ওরা কেউ খায়নি, শুধু কাঁদছে। প্রচুর টেনশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ও আমার একমাত্র ভাই। ও আমাদের কাছে সব। একা বিদেশে রয়েছে। আমরা কেউ ওর সঙ্গে নেই। তাই আরও কষ্ট হচ্ছে। |
রামিজ রাজা: তিন ক্রিকেটারের পরিবারের কাছে এই রায় খুব কঠোর। কিন্তু ন্যায়বিচার হয়েছে। ক্রিকেট থেকে দুর্নীতি দূর করতেই হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এটা করার সাহস না পায়।
পাক বোর্ড: দেশের হয়ে খেলা নিয়ে গর্বিত হওয়ার বদলে এই ক্রিকেটাররা নিজেদের সমর্থকদের হতাশ করার রাস্তা বেছে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, নিজেদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। ক্রিকেটের অসম্মান করেছে। ওদের শাস্তি নিয়ে পাকিস্তানে কোনও সমবেদনা নেই।
ওয়াকার ইউনিস: ঘটনাটা ঘটার সময় আমি দলের সঙ্গেই ছিলাম। ওটা ছিল ক্রিকেটের খুব কুৎসিত একটা দিক। ইংল্যান্ডের আইন বেশি জানি না, কিন্তু ক্রিকেটারদের জেল হওয়া শুধু ক্রিকেট নয়, পাকিস্তানের পক্ষেও খুব দুঃখের। ওরা যে সত্যিই জড়িত, সেটা আমি ভাবতে পারিনি। আগে জানলে বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে গোটা ব্যাপারটা হয়তো অন্য ভাবে সামলানো যেত।
ইওয়ার সঈদ (বিতর্কিত সিরিজের পাক ম্যানেজার): ম্যানেজার হিসাবে ওই সফরে প্রত্যেক ক্রিকেটারকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ফোকাসটা ক্রিকেট এবং বলের উপর রাখো। কিন্তু কেউ কেউ শোনেনি। পাকিস্তানি প্লেয়ার এবং পাকিস্তান ক্রিকেট এ ভাবে ফৌজদারি মামলায় জড়িয়েছে ভাবলে ভীষণ হতাশ লাগছে। কিন্তু দোষ করলে শাস্তি তো পেতে হবেই।
রশিদ লতিফ: আজ এই ক্রিকেটাররা কাঁদছে। কিন্তু স্পট ফিক্সিং করার আগেই ওদের ভাবা উচিত ছিল। আজ পাক ক্রিকেটের একটা কালো দিন। পাক ক্রিকেটার হিসেবে আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিনও। কিন্তু দেশ এবং ক্রিকেটের অসম্মান করার জন্য ওদের এই শাস্তি প্রাপ্য।
মাইকেল ভন: আশা করি ক্রিকেট বিশ্বে এই ঘটনার প্রভাব পড়বে। যে ভাবে পুরো ঘটনাটা সামলানো হয়েছে, তাতে আমি খুশি। আমার মনে হয় আরও অনেক ক্রিকেটারই গড়াপেটায় জড়িত আছে। শুধু এই তিন জনই নয়, বাকিদের ধরার জন্যও আরও বেশি চেষ্টা করতে হবে।
ডিকি বার্ড: ভাবতে পারিনি এই দিনটা দেখার জন্য বেঁচে থাকব। আমাদের খেলাটার এই দুর্দশা মেনে নিতে পারছি না। গড়াপেটা ক্রিকেটের ক্যানসারের মতো। খেলাটাকে শেষ করে দেবে।
মাজহার মাহমুদ (স্টিং অপারেশনে যুক্ত সাংবাদিক): ক্রিকেটের জন্য দুঃখের দিন। কিন্তু তদন্তমূলক সাংবাদিকতা দিয়ে যে ভাল করা যায়, সেটা প্রমাণ হল। আদালতের আজকের রায় ক্রিকেটকে অনেক পরিচ্ছন্ন খেলা করে তুলল।
জগমোহন ডালমিয়া (প্রাক্তন আইসিসি প্রেসিডেন্ট): এ রকম ঘটনা টিম কখনওই সমর্থন করতে পারে না। ঘটনার খুঁটিনাটি আমি জানি না। সত্যি যদি এমন ঘটে থাকে, তা হলে এমন শাস্তি পাওয়াই উচিত।
মইন খান: পাক ক্রিকেটের জন্য খুব দুঃখের দিন। কিন্তু আমার মনে হয় এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বক্রিকেট নিয়ে প্রশাসকদের নতুন করে ভাবা উচিত।
জাহির আব্বাস: এই ঘটনার জন্য আজকের দিনটা পাকিস্তানের কাছে লজ্জাজনক হয়ে থাকল। কে ভাবতে পেরেছিল যে স্পট ফিক্সিংয়ের জন্য ক্রিকেটারদের জেলে যেতে হতে পারে?
হারুন লর্গ্যাট: আমরা বারবারই বলেছি, দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না। এ ক্ষেত্রে পুলিশ এবং আদালতের সঙ্গে আইসিসি যে ভাবে সহযোগিতা করেছে, তাতে বুঝিয়ে দেওয়া গিয়েছে ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করার যে কোনও চেষ্টা আমরা আটকাবই।
নাসের হুসেন: যা ঘটেছে, সেটা নিয়ে আনন্দ করতে পারছি না। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গড়াপেটা ব্যাপারটা একটা বিস্ফোরণের দিকে যাচ্ছিল। এই শাস্তিটা বোধহয় ক্রিকেটের দরকার ছিল।
|
কী বললেন বিচারক কুক |
“এক সময় যা একটা খেলা ছিল তা এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। সবার চোখে ক্রিকেটের ভাবমূর্তি এবং সততা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এদের মধ্যে অনেক তরুণ রয়েছে যারা তোমাদের নায়ক হিসেবে দেখত। যারা তোমাদের মতো প্রতিভাবান হতে, তোমাদের মতো সর্বোচ্চ স্তরে ক্রিকেট খেলার জন্য খুব বড় মূল্য দিতেও রাজি ছিল।” “এর পর যখনই ক্রিকেট ভক্তরা, যাঁরা পয়সা দিয়ে খেলা দেখেন, তাঁরা কোনও চাঞ্চল্যকর ঘটনা দেখলে ভাববেন এটা সত্যিই ঘটেছে? না কি গড়াপেটা? আমরা সত্যিকারের ব্যাট-বলের লড়াই দেখছি? না কি কোনও সাজানো ঘটনা? যাকে সৎ প্রতিযোগিতা মনে করা হচ্ছে সেটা তা না-ও হতে পারে।” “পাকিস্তানের জাতীয় খেলা ক্রিকেট। সে দেশের জাতীয় দলের সমর্থকেরা তোমাদের কাজে প্রতারিত হয়েছে। শুধু তোমাদের সমর্থক নয়, সমস্ত ক্রিকেট ভক্তের সঙ্গে তোমরা প্রতারণা করেছ। ক্রিকেটারদের পাওনা টাকা বা পুরস্কার অর্থ পাওয়া সত্ত্বেও টাকার লোভে তোমরা এই কাজ করেছ।” “এটা ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ সংবাদপত্রের স্টিং অপারেশন হলেও তাতে তোমাদের দোষ একটুও কমে না। তোমাদের অপরাধ এত বড় মাপের যে কারাদণ্ড ছাড়া তার উপযুক্ত শাস্তি নেই।”
|
পাক ক্রিকেটে কেলেঙ্কারি |
১৯৯২: লর্ডসে এক দিনের ম্যাচে ওয়াসিম আক্রম ও ওয়াকার ইউনিস বল বিকৃতি ঘটিয়েছেন সন্দেহে বল বদলে দেন আম্পায়াররা।
১৯৯৮: ক্রাইস্টচার্চে ওয়াসিম আক্রমের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে গড়াপেটাতে বাধ্য করানোর অভিযোগ আতাউর রহমানের। পরের বছর বিশ্বকাপ ফাইনালে হারায় অধিনায়ক আক্রমের বিরুদ্ধে ফের অভিযোগ।
২০০০: ম্যাচ গড়াপেটা নিয়ে বিচারপতি মালিক কায়ুম কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে আজীবন নির্বাসিত সেলিম মালিক ও আতাউর রহমান।
২০০০: দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এক দিনের ম্যাচে বল বিকৃতির দায়ে ওয়াকার ইউনিস এক ম্যাচ নির্বাসিত। বল বিকৃতির জন্য শাস্তি সেই প্রথম।
২০০২: জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে টেস্টে বল বিকৃতির দায়ে দুই ম্যাচ নির্বাসিত শোয়েব আখতার।
২০০৬: ওভাল টেস্টের চতুর্থ দিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বল বিকৃতির অভিযোগে ইংল্যান্ডকে ৫ পেনাল্টি রান দেন আম্পায়াররা। প্রতিবাদে মাঠে নামতে অস্বীকার পাকিস্তানের। ইংল্যান্ডকে বিজয়ী ঘোষণা করেন আম্পায়াররা। ক্রিকেটের ইতিহাসে যা নজিরবিহীন।
২০০৬: ডোপ পরীক্ষায় ধরা পড়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে বাদ শোয়েব আখতার এবং মহম্মদ আসিফ।
২০০৭: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় ড্রেসিংরুমে মহম্মদ আসিফকে ব্যাট দিয়ে মেরে পাঁচ ম্যাচ নির্বাসিত শোয়েব আখতার। তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
অগস্ট, ২০১০: লর্ডস টেস্টে ইচ্ছাকৃত নো বল করার অভিযোগ সলমন বাট, মহম্মদ আসিফ এবং মহম্মদ আমেরের বিরুদ্ধে। ইংল্যান্ডের আদালতে তিন জন দোষী সাব্যস্ত ১ নভেম্বর, ২০১১। ৩ নভেম্বর জেল এবং জরিমানা। |
|