পদত্যাগপত্র জমা দিলেন আরামবাগ মহকুমার একমাত্র সিপিআই পরিচালিত পঞ্চায়েত সালেপুর ১-এর প্রধান তারারানি সিংহ। ‘সঙ্কটজনক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে’ তাঁর পক্ষে পঞ্চায়েত পরিচালনা করা সম্ভব নয় বলে বিডিও অফিসে জমা দেওয়া ওই পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেছেন তারারানিদেবী। তাঁর বক্তব্য, “শারীরিক ও মানসিক ভাবে আমি বিপর্যস্ত।”
বৃহস্পতিবার পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে তারারানি বলেন, “বিধানসভা ভোটের ফল বেরনোর পর থেকেই পঞ্চায়েত পরিচালনা ক্রমশ জটিল হচ্ছে। প্রতি দিন ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে। অপদস্ত করা হচ্ছে। উন্নয়নে বাধা দেওয়া হচ্ছে। পঞ্চায়েতের স্বাভাবিক পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে না।” পদত্যাগী প্রধানের অভিযোগ, “সহকর্মী সদস্যেরাও নিয়মিত অফিসে আসতে পারছেন না। কখনও অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কখনও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কখনও আবার গালিগালাজ করা হচ্ছে। অনশনও চলছে।”
পঞ্চায়েতের এই ‘সংকটজনক’ পরিস্থিতির জন্য কাউকে অবশ্য সরাসরি দায়ী করেননি তারারানিদেবী। যদিও অভিযোগের আঙুল যে তৃণমূলের দিকেই, সে কথা স্পষ্ট। বস্তুত, বিধানসভা ভোটের পর থেকেই আরামবাগ মহকুমা জুড়ে বিভিন্ন পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে কাজকর্মে বাধা দানে অভিযুক্ত তৃণমূল। বহু ক্ষেত্রেই প্রধান, পঞ্চায়েত সদস্যেরা দীর্ঘ দিন কাজে যোগ দিতেই ভয় পাচ্ছিলেন। সর্বদল বৈঠক ডেকে, প্রশাসন-পুলিশের হস্তক্ষেপে কোথাও কোথাও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ডামাডোল লেগেই আছে বিভিন্ন এলাকায়। আরামবাগ ব্লকের ১৫টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ইতিমধ্যেই মলয়পুর ১ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান-সহ ১২ জন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। মহকুমার ৬টি ব্লকের মধ্যে গোঘাটের দু’টি ব্লক ছাড়া বাকি চারটি ব্লকে পঞ্চায়েত সদস্যদের অনেকেই পর্যায়ক্রমে পদত্যাগ করছেন। যদিও সকলেই ‘ব্যক্তিগত কারণ’ বা ‘অসুস্থতা’কেই লিখিত ভাবে এর কারণ বলে উল্লেখ করছেন। কিন্তু তৃণমূলের লাগাতার ‘আন্দোলন’ এবং ‘জুলুমবাজি’ই যে তার কারণ, অনেকেই সে কথা আড়ালে স্বীকার করেছেন।
এ দিকে, নিয়মিত পরিষেবা না পেয়ে গ্রামেরও লোকও খেপে উঠছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে কার্যত ল্যাজে-গোবরে অবস্থা বিভিন্ন পঞ্চায়েতের প্রধান ও সদস্যদের। নানা সময়ে হুমকির অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা। যদিও তৃণমূল নেতৃত্ব আগাগোড়াই বলে আসছেন, কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা হচ্ছে না। দলের কর্মীদের সংযত থাকতে বলা হয়েছে। আরামবাগের পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির সবগুলিই বাম পরিচালিত (সালেপুর বাদে সবগুলিতেই ক্ষমতায় সিপিএম)। প্রধান ও সদস্যেরা এত বছর ধরে নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে ছিলেন বলে অভিযোগ তৃণমূল নেতৃত্বের। সে জন্যই অফিসে আসতে প্রধানেরা ভয় পাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন তৃণমূলের নেতারা।
আরামবাগের বিডিও মৃণালকান্তি গুঁই বলেন, “প্রধানের পদত্যাগপত্র পেয়েছি। তিন দিনের মধ্যে নোটিস করে তাঁকে শুনানির দিন জানিয়ে দেওয়া হবে। শুনানির পরেই সিদ্ধান্ত হবে, ওঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণযোগ্য কিনা।” তবে, সালেপুর ১-এর প্রধান এই প্রথম ‘সঙ্কটজনক পরিবেশ-পরিস্থিতির’ কথা লিখিত ভাবে উল্লেখ করায় প্রশাসনও উদ্বিগ্ন। বিডিও বলেন, “আমরা নির্দিষ্ট করে জানতে চাইব, উনি ঠিক কী বলতে চেয়েছেন। সেই মতো ব্যবস্থা হবে।”
সালেপুরের ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতা সুফল চানক বলেন, “পঞ্চায়েতের সমস্ত প্রকল্পের টাকা-পয়সার হিসেব চেয়েছিলাম আমরা। প্রধান হিসাবে উনি (তারারানিদেবী) তা দিতে পারেননি। দুর্নীতি হয়েছে বলেই পদত্যাগ করতে চেয়েছেন।”
সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক বিনয় দত্ত বলেন, “মহকুমার সমস্ত পঞ্চায়েতে ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে তৃণমূল। সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেছে সর্বত্র। মহিলা প্রধান নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। মুখ্যমন্ত্রী যে সব কথা বলছেন, তাতে প্রশ্রয় পেয়েই ওদের দলের লোকজন এ সব করছে।” অন্য দিকে, আরামবাগের তৃণমূল বিধায়ক কৃষ্ণপদ সাঁতরার বক্তব্য, “পঞ্চায়েতের কাজে হস্তক্ষেপের অভিযোগ ঠিক নয়। বরং আমরা সহযোগিতাই করছি।”
তারারানিদেবী বলেন, “আর পারছি না। আমি বিধ্বস্ত।” |