|
|
|
|
|
|
|
রেখায় রেখায় |
পম্পা বিশ্বাস |
কিছু সৃষ্টি করার দিন কি তা হলে শেষ? মাসখানেক ধরে মগজে যেন কিছুই আর খেলতে চাইছে না। শরীর ঠিকই আছে, কিন্তু মাথাটা ‘নেই’ হয়ে গেছে। এ রকম হল কেন? কোন পথে খালি হয়ে যাচ্ছে মাথাটা?
উত্তর দেওয়ার কেউ নেই।
এই তো ঘরের কোণে চির-পুরনো কাঠের টেবিলটা। এই তো বিকেলের লাল-হলুদ আলো এসে পড়েছে তাতে। হাতে ব্লেড আর আলপিন নিয়ে বসে আছি নিথর। নতুন কোনও আঁকিবুকি কেটে উঠতে পারছি না টেবিলে।
অবশ্য টেবিলটায় আর অল্প জায়গাই ফাঁকা রয়েছে। সবটাই প্রায় আগের আঁকা রেখায় রেখায় ছয়লাপ। কাঠের উপর দীর্ঘ কুড়ি বছরের ময়লা পালিশ হয়ে গিয়েছে। তাই টেবিলের তল, অর্থাৎ ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড কোথাও তেলতলে, কোথাও খসখসে। কোথাও কালচে, কোথাও ঘেস্টে। টেবিল জুড়ে সরু-মোটা রেখার জটিল জট। আমারই আঁকা। রেখাগুলো অফ হোয়াইট কিংবা হলদেটে। কোথাও কোথাও চায়ের তামাটে রং বসে গিয়েছে।
ছবিতে সমুদ্র, অনন্ত ঢেউ, জট পাকানো জলস্রোত হয়তো। মাছের মতো কিংবা না-মাছ গোত্রের কিছু অদ্ভুত জলজ প্রাণী। জলের উপর পালতোলা অতি নৌকিক কিংবা অবনৌকিক কোনও জল যান। যে রকম খুশি ভাবনা করা চলে।
এত দিন তো শুধু ভাবনাই করিনি, এঁকেওছি বটে। এখন কিন্তু আর পারছি না। আগে নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ব্লেড আর পিন চালিয়েছি টেবিলের পিঠে। রূপকথা, যন্ত্রণা, আনন্দ, কান্না সব কিছু দিয়ে তৈরি হয়েছে রেখাগুলো। অনেক সময় মনে হয়েছে, যেন একটুকরো গাঢ় রঙের মখমলের উপর সাদাটে সুতোর এমব্রয়ডারি উঠেছে স্বতশ্চল সূচে। শুরু নেই, শেষ নেই, সবটাই শুধু বয়ে যাওয়া। প্রবাহ আর প্রবাহ।
আর এখন? এখন এই প্রবাহ স্তব্ধ। জোর করে তো হাত চালানো সম্ভব না। মাথাটা আর হাতকে সাহায্য করছে না। এই তো টেবিলের পায়ার কাছে নামিয়ে রাখা চলটা-ওঠা প্লেটে পড়ে থাকা পাঁউরুটির টুকরো নিয়ে যাচ্ছে ইঁদুরটা। মেঝেতে এক বার পা ঠোকা উচিত ছিল। কিন্তু ঠুকলাম না। পা দুটো এখন কংক্রিটে বাঁধানো। তাই বলছি, প্রবাহ স্তব্ধ।
বিকেলের লাল আভাটা মরতে মরতে একদম মরে যাচ্ছে। ব্লেড, আলপিন নিয়ে বসে থেকে থেকে হতাশ আমি। আর বোধ হয় কোনও লাভ নেই। এই চেষ্টা আজকের মতো শেষ। দেখি, কাল যদি কিছু বেরোয়। এই চিন্তাটা আতঙ্কের। শুধু মনে হয়, কেন হল না, কেন হল না? কাল হবে তো? যদি না হয়! টেবিলের ড্রয়ার খুলে ব্লেড-আলপিন সব রেখে দিলাম আজকের মতো।
যে ব্লেড, যে আলপিন অনেক ছবি এঁকেছে, সেগুলো পুরনো হলে, ভেঙে গেলে বা জং ধরলে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয়, ক্রিয়েটিভ ব্লেডটা, ক্রিয়েটিভ আলপিনটা মরে গেল! পরের ছবিগুলো ভাল হবে তো?
জানি, সৃজনশীলতা ব্লেডে-আলপিনে থাকে না, থাকে মাথায়। তবুও মাঝে মাঝে বস্তুগুলোকে বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয়। আর এখন তো নিজের মাথা সম্বন্ধে যথেষ্টই সন্দেহ জাগছে।
অবশ্য মাথায় নতুন কিছু জন্ম দেওয়ার দায়বদ্ধতা না থাকলে মনে এক ধরনের স্বস্তি আসে। নিজের কাছে নিজে নিরবয়ব হয়ে যাওয়ার আরাম আছে বেশ। ভুলতে হবে নিজেকে। তবেই শান্তি। অসম্ভব শান্তি।
ইঁদুরটা আবার এসেছে প্লেটের কাছে। ঘরের আবছা অন্ধকারে একটা গাঢ়তর চলমান পুঁটলি যেন। তাড়ালাম না। কী আর হবে তাড়িয়ে। ওর দাঁতে নষ্ট হওয়ার মতো কী বা আছে আর! থাক না, ঘুরুক ফিরুক। এটা ছিঁড়ুক। কিছু এসে যায় না তাতে।
|
|
হঠাৎ লোডশেডিং। ওঃ, খুব খুশি হলাম। সবে ভাবছিলাম, এ বার কি আলোটা জ্বালা উচিত? যাক, নিশ্চিন্ত। এক্ষুনি সুইচ অন করতে হবে না তা হলে। প্রতি সন্ধ্যায় সুইচ টিপে আলো জ্বালি আর ভাবি, এই কাজটা আর কত দিন করতে হবে? রোজ একই কাজ, একই কাজ। সুইচটার উপর ঘেন্না ধরে গেল। আলো না জ্বেলে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে অদ্ভুত এক আরাম। কিন্তু দিদির জন্য সে উপায় নেই। অফিস থেকে ফিরে আলো জ্বালানো হয়নি দেখলে একেবারে কেলেঙ্কারি। প্রবল চটে যাবে দিদি। ও মনে করে, অন্ধকার জিইয়ে রাখাটা ওর বিরুদ্ধে আমার ষড়যন্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করতে থাকে। সেই সঙ্গে নিজের চোদ্দো পুরুষও উদ্ধার হয়ে যায়। রাগের চোটে তা খেয়াল থাকে না। দিদির আক্ষেপ, দিদির ঘাড়ে চেপে বসে আছি আমি। কারও কোনও কম্মে যখন লাগছিই না, তখন বাঁচা কেন? মরে গেলেও তো পারি। আমাকে গেলানোর জন্য নিজের ভবিষ্যৎ গড়া হল না। এত বড় বোন ঘাড়ের উপর... তাই, সম্ভাব্য পাত্ররা সব পালিয়ে গেল। এই সব, এই সব। কত কথা! রাগের চোটে আজকাল দিদির হাই প্রেশার। ভাবভঙ্গি কদাকার। আমিও দিদির মৃত্যু কামনা করি নিয়মিত। দিদি মরে গেলে বড় শান্তি পাব। শান্ত পরিবেশটা দিদি ছিঁড়ে খুঁড়ে দিচ্ছে। অনেক নিষেধ, অনেক নিয়মকানুন জারি আছে। যেমন, কিছুতেই যেন ভদ্র পাড়ায় দিদির মুখ না ডোবাই। কেউ না আমাদের পাগলছাগল ভাবে।
তবু ভাগ্য ভাল, আঁক কাটার টেবিলটা কেড়ে নেওয়া হয়নি। কয়েদির শিল্পচর্চার স্বাধীনতা আর কী। টেবিলের কথায় আবার রেখার কথা মন জুড়ে বসছে। বছর দুই আগে একটা সময় এসেছিল... ভীষণ উর্বর। যা কিছু দেখতাম, সবই রেখায় আঁকা হয়ে যেত মনের পর্দায়। বুকের মধ্যে জাগত তীব্র এক মোচড়। এই মোচড়টা যে দিন প্রথম অনুভব করলাম, সেই দিনটা ছিল অসাধারণ। কমলা রঙের রোদে চারিদিক পরিপক্ক। বসেছিলাম মিনি বাসের কেবিনে।
বাসটা চলছে। উঠল ব্রিজের উপর। অমনি হঠাৎ দেখলাম, মিনি বাসের তলা থেকে কতকগুলো ট্রাম লাইন লাফিয়ে বেরিয়ে আসছে। আর আসছেই। রোদ ঠিকরানো কাঁপা কাঁপা এক গুচ্ছ রেখা। ব্রিজের ঢিপি পিঠের উপর উঠে রেখারা অন্য দিকে নেমে যাচ্ছে। বাসের তলায় লাইন গুচ্ছের ছড়িয়ে থাকা অংশ। উপরে উঠে গোছাটা সংবদ্ধ ভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে। গোছবদ্ধ অংশটা যেন বড় তালুওয়ালা কোনও মানুষের এক মুঠির মধ্যে ধরে যাবে, এমন অবস্থা।
আমার ভেতর তখন থরথর কম্পন। কিছু একটা তোলপাড় ঘটে যাচ্ছে। গড-গিফটেড হলাম নাকি? কোনও সাধারণ প্রাপ্তি নয় এটা। প্রবল চূড়ান্ত এক পাওয়া। বুঝলাম আমার চোখের দৃষ্টি, দেখার ধরন সব বদলে যাচ্ছে। অন্য কেউ বোধ হয় এ ভাবে দেখতে পাচ্ছে না। এ দিকে আলো ঠিকরানো উজ্জ্বল লাইনগুলো আঁকাবাঁকা ভাবে আমার হার্ট, ব্রেন, কিডনি, লিভার ভেদ করে চলে যাচ্ছে। প্রথমে ছ্যাদরানো, পরে গুচ্ছিত এই প্রবাহে পুরনো সব দেখা ভেসে গেছে। এখন এই দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা সমস্ত রেখার দাসানুদাস আমি। আমার প্রভু কোনও এক নির্দেশ, যা আমাকে এই ভাবে দেখতে বাধ্য করছে। যা আমার মাংস ভেদ করে শিরা-ধমনির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। থামানোর শক্তি আমার নেই। ব্যাপারটা আমার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের ধার ধারে না। বুকের মধ্যে কোনও এক জাদুকর ঢুকে অদ্ভুত এক শাসনতন্ত্র চালু করেছে।
এ দিকে দিদি এসে গেছে। মুখটা নিশ্চয়ই রোজকার মতোই রাগী রাগী। সব সময় রেগে রেগে রাগের ভাবটা মুখের পেশিগুলোকে পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে। ভুরু ঘন ঘন কুঁচকে যায়। চোখের কোনাগুলো পাখির পায়ের দাগে ভরে থাকে। হাসি খুবই কম।
তবে অনেক দিন বাদে বাদে যেন দিদিকে একটু অন্য রকম ঠেকে। একটু যেন হাসি হাসি ভাব। বুঝতে পারি, কারও সঙ্গে হয়তো খানিক বন্ধুত্ব মতো হতে চলেছে। কোনও কলিগই হবে। কিংবা যাতায়াতের পথে হঠাৎ পরিচয় হয়েছে এমন কেউ। এমনিতেই দিদির চড়া সাজ। খুশির সময় তা আরও বাড়ে। তখন হাল্কা ভুরু গাঢ় কাজল পেন্সিলে আঁকা। চোখের কোনা দু’টি কাজলে টেনে তোলা। ঘাড়-গলা ঘামে-পাউডারে লেপালেপি। পেন্ট করে মুখ কিছুটা সাদাটে। একটু রুজের ছোঁয়া। চুল কলপে কালো এবং তেল চুকচুকে। ঠোঁটে লিপস্টিক। নখে নেলপালিশ যেমন-তেমন ভাবে। বড় গলার হাত কাটা ব্লাউজ। কখনও কখনও রংজ্বলা বা ঘামের দাগ ধরা। বগলে এক থোকা মাংস। তাতে পাউডারের ছোঁয়া। কোমরে দু’থাক চর্বি। শাড়িটা এঁটে সেঁটে উঁচু করে পরা। তাই পায়ের গোড়ালিশুদ্ধ খটখটে এক জোড়া হিল দেখা যায়। পাট পাট, পিন করা আঁচল। কিন্তু ঢাকতে পারে না কিছুই।
এক দিন দিদির ফিরতে বেশ দেরি হয়েছিল। দরজা খুলতেই দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে, আনন্দ চাপার কোনও চেষ্টা না করেই গেয়ে উঠল আশা ছিল ও ও ভালবাসা ছিল ও ও ও...
তার পরেই খাসখ্যাসে গলায় বলল সিনেমায় গিয়েছিলাম। খাব না আজ। তুই খেয়ে নে। অনিলদা-টা এমন নাছোড় না, মোগলাই পরোটা খাইয়েই ছাড়ল!
অনাবিল হাসি দিদির।
মোগলাই পরোটা খাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে অবশ্য দিদির খুশি খুশি ভাবটা চলে গেল। অন্ধকার হয়ে এল মুখ। মেজাজ আগের চেয়ে অনেক তিরিক্ষে। রোজই বলতে লাগল মর না মর। আর কত দিন বসে বসে আমার অন্ন ধ্বংসাবি? ঝি-গিরি করেও তো লোকে নিজের পায়ে দাঁড়ায়। অপমানের ভাত গিলতে লজ্জা করে না?
এ দিকে বেশ কিছু দিন ধরেই অভাব বাড়ছিল। আসলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। কিন্তু দিদির মাইনে এক কড়িও বাড়ল না। খাবারের মেনু দিন দিন অসম্ভব খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। শেষে দিদি মাঝে মাঝে ডিম-আমিষ, আমি একেবারে নিরামিষ। এর মধ্যে দিদি অসুস্থ হয়ে পড়ল। দিদিকে অফিসে দেওয়া নেওয়া করতে হচ্ছিল। চাকরিটা তো বাঁচাতে হবে। তাই এই একটানা প্রাণপণ লড়াই। ঠিক এই কঠিন সময়েই আমি রেখাগুলো পেয়েছিলাম।
এই প্রাপ্তির পর থেকে স্বপ্নগুলোও ফুটে উঠত রেখায়। কোনও কিছু কল্পনায় এলে তা আসত সুবিন্যস্ত রেখাশৈলীতে। হাতের কাছে ছিল ব্লেড আর আলপিন। তাই দিয়েই টেবিলের ক্যানভাসে আঁকা শুরু। আঃ, কী যে আনন্দ! কী যে মুক্তি!
আমাদের এই পৈতৃক টেবিলটা বেখাপ্পা বিশাল। বেশ লম্বা মতো। অনেক এঁকেছি, তবু এখনও খানিকটা অংশ ফাঁকা আছে। বুক মোচড়ানো অনেক মুহূর্ত কেটেছে। জীবন্ত রেখারা জাল বুনেছে নানা ছবির। কিন্তু এখন কি ধীরে ধীরে ভিতরের তাড়নাটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে? যা এমনি এসেছিল, তা কি এমনিই চলে যাচ্ছে? তবে কি এমন একটা সময় আসবে, যখন মনে হবে ছবিগুলো অন্য কেউ এঁকেছে? দেবদত্ত ক্ষমতা কি আবার ফেরত চলে যেতে পারে? বিনা গুণে পেয়েছি বলে কি তা বিনা দোষে চলে যাবে? এই সব ভাবনা ক’দিন ধরে মাথাটা ওঃ মাথাটা কুরে কুরে খাচ্ছে।
|
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|