স্কুলপড়ুয়াদের জোর করে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হবে না, এমন কোনও ‘নিশ্চয়তা’ দিতে পারছে না রাজনীতির কারবারিরা! বন্ধ-অবরোধ বন্ধ হওয়ার মতো এই বিষয়েও রাজনৈতিক সহমতের প্রবল অভাব! অভিভাবক এবং স্কুল কর্তৃপক্ষকে না-জানিয়ে বেহালার একটি স্কুলের পড়ুয়াদের বৃহস্পতিবার একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে যতই ধুন্ধুমার কাণ্ড হোক, আদালত যতই রিপোর্ট তলব করুক, বামপন্থী দলগুলির তাতে কিছু যায় আসে না।
যে ভাবে স্কুল এবং অভিভাবকদের অন্ধকারে রেখে বৃহস্পতিবার ওই পড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই ঘটনাকে অবশ্য কোনও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বই সমর্থন করছেন না। কিন্তু তা-ই বলে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্কুলপড়ুয়াদের সামিল করা হবে না, এমন কোনও ‘আশ্বাস’ও তাঁরা দিচ্ছেন না। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁরা নিজেদের কর্মসূচিতে স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে যান না। কিন্তু রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, স্কুলপড়ুয়াদের রাজনীতির আঙিনার মধ্যে সামিল করার প্রচেষ্টাকে ১৯৮৫ সালে ‘কিশোর বাহিনী’র ‘পুনর্জাগরণ’ ঘটিয়ে এ রাজ্যে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছিল সিপিএম। তাই এই বিষয়ে ‘পুনর্বিবেচনা’র দায়িত্ব তাদেরই। আর সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, বৃহস্পতিবার কলকাতায় যে ঘটনা ঘটেছিল, তেমন কাণ্ড কখনওই তাঁরা ঘটাননি। তাই ‘সংশোধনে’র প্রশ্নও আসে না।
অভিভাবক মহলের বড় অংশের প্রশ্ন, রাজনীতির যে সব বিষয়ের বিন্দুবিসর্গও স্কুলপড়ুয়াদের বোঝার কথা নয়, সেই সব কর্মসূচিতে তাদের টেনে নিয়ে যাওয়ার অর্থ কী? রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্কুলের শিশুদের ‘সংগঠিত আকারে’ সামিল করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন এখানেই। কিন্তু সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের মতে, “আমাদের কর্মসূচিতে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির স্কুলছাত্রদের সামিল করা হয়েছে অনেক সময়। ওই বয়স থেকে ছেলেমেয়েদের কোনও বিষয় ধরতে পারার ক্ষমতা আসে। তবে কখনওই কাউকে না-জানিয়ে ছাত্রছাত্রীদের জোর করে কোথাও নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী আমরা নই।” যদিও রাজ্যবাসীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, নাগাসাকি বা হিরোসিমা দিবসে ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী’ মিছিলে শিশু-পড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যার সঙ্গে ওই পড়ুয়াদের ‘ধরতে পারা’র কোনও সম্পর্ক নেই!
বৃহস্পতিবারের ঘটনায় অভিযুক্ত এসইউসি-র সংগঠন ডিএসও ওই কাণ্ডের জন্য আদৌ ‘লজ্জিত’ বা ‘অনুতপ্ত’ নয়। তাদের বরং পাল্টা অভিযোগ, ‘চক্রান্ত’ করে ছাত্রদের অপহরণের ‘গুজব’ রটানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কি অভিভাবক বা স্কুল কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি নিয়েছিলেন? ডিএসও-র রাজ্য সম্পাদক কমল সাঁইয়ের দাবি, “আমাদের কর্মসূচির আগে অভিভাবক, শিক্ষক এবং ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। যারা সহমত হয়, তারাই অংশ নেয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রত্যেক অভিভাবকের অনুমতি নেওয়া সম্ভব নয়! আর স্কুল কর্তৃপক্ষও কখনও ছাত্রছাত্রীদের মিছিলে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারেন না।” ১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলনে নুরুল ইসলাম, আনন্দ হাইত বা সাম্প্রতিক কালে নন্দীগ্রামে দুই স্কুলছাত্র বিশ্বজিৎ মাইতি ও এমদাদুল হকের মারা যাওয়ার দৃষ্টান্ত তাঁরা টেনেছেন।
স্কুলপড়ুয়াদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সামিল করার ‘প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্য’ যাদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত, সেই সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই ‘ধারা’র মধ্যে কোনও ‘অন্যায়’ দেখছেন না। এসএফআইয়ে সদস্যপদ দেওয়া হয় ১২ বছরের পর থেকে। ঋতব্রত বলছেন, “এ দেশেই তো ‘মক পার্লামেন্ট’ হয় স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সূতিকাগৃহ যদি স্কুল হয়, তা হলে রাজনীতিক হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যায়টা কোথায়? তবে জোর করে কোথাও নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন নেই।” অভিভাবক এবং স্কুলপড়ুয়াদের কপালে যে দুর্ভোগই থাকুক, রাজনীতি আছে রাজনীতিতেই! |