স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক মিছিলে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে আইন প্রণয়ন করতে চাইছে রাজ্য সরকার। বেহালার স্কুলের ঘটনার নিরিখেই রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে বলে শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর।
শুক্রবার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, বেহালার ঘটনা নিয়ে রাজ্য সরকার কড়া অবস্থান নিচ্ছে। ঠিক হয়েছে, পুলিশি তদন্তের পাশাপাশি শিক্ষা দফতরও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবে। বৃহস্পতিবার রাতেই বেহালা থানায় এক অভিভাবক অপহরণের মামলা দায়ের করেছেন। তা নিয়ে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। আলাদা তদন্ত করছে শিক্ষা দফতরও।
বেহালার ঘটনাটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কলকাতা হাইকোর্টও। রাজ্য সরকারের কাছে এ নিয়ে রিপোর্ট তলব করেছে তারা। শুক্রবার প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল এবং বিচারপতি অসীম রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ আগামী শুক্রবার রাজ্যের স্কুলশিক্ষা দফতরের সচিবকে হলফনামা দিয়ে ওই ঘটনার বিশদ বিবরণ জানাতে বলেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার কী ব্যবস্থা নিল, হলফনামায় জানাতে হবে তা-ও। এ দিন কলকাতা হাইকোর্টে স্কুল ছাত্রদের দৈহিক শাস্তি বন্ধ করা নিয়ে জনস্বার্থের মামলার শুনানি ছিল। সেই মামলার শুনানির সময়ই আবেদনকারী তাপস ভঞ্জ ডিভিশন বেঞ্চকে সাহাপুর স্কুলের বৃহস্পতিবারের ঘটনা বিশদে জানান। তিনি বলেন, এই ঘটনা দৈহিক শাস্তির থেকেও ভয়াবহ। অভিভাবকদের না জানিয়ে নাবালক পড়ুয়াদের মিছিলে নিয়ে যাওয়া হল। অভিভাবকেরা নিশ্চিন্ত, তাঁদের ছেলেরা নিরাপদে স্কুলে রয়েছে। অথচ তখন তারা সর্ম্পূণ অপরিচিতদের সঙ্গে বাড়ি ও স্কুল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। |
বৃহস্পতিবার রাতেই বেহালা থানায় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রাজেশ গুড়িয়ার মা মামণি গুড়িয়া অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। কিন্তু তাতে কোনও ব্যক্তি বা দলের নাম ছিল না। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী, মিছিলে যাওয়া ছাত্র, তাদের অভিভাবক এবং স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে পুলিশ। তার ভিত্তিতেই তারা ‘অপহরণকারী’দের চিহ্নিত করতে চাইছে। কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ-পশ্চিম শাখা) সুব্রত মিত্র বেহালা থানাকে দোষীদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “ছাত্রেরা যে এসইউসি-র ছাত্র সংগঠন ডিএসও-র সমাবেশে গিয়েছিল, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ঠিক কার উস্কানিতে ছাত্রেরা স্কুলে না গিয়ে মিছিলে গিয়েছিল, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
ঘটনাটি নিয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়ে এ দিন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা দফতর ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে। শুক্রবারই পরিদর্শকদের একটি দল পাঠানো হয়েছিল স্কুলে। তাঁরা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট দিয়েছেন। কিন্তু আমি ওঁদের বলেছি, অভিভাবকদের বক্তব্যও শুনতে হবে।” আজ, শনিবার পরিদর্শকদলটি ফের ওই স্কুলে গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট জমা দেবে বলে জানিয়েছেন ব্রাত্যবাবু।
তিনি বলেন, “রিপোর্টে যদি কারও গাফিলতি প্রমাণিত হয়, তা হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, ছাত্রদের জোর করে মিছিলে নিয়ে যাওয়া রুখতে একটি আইন তৈরি করা যায় কি না, সে ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী উদ্যোগী হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলতে শুরু করেছেন।
স্কুল কিন্তু ঘটনার দায়িত্ব নিতে চাইছে না। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুন্সী মহম্মদ মনসুর বলেন, “স্কুলে ঢোকার আগেই ছাত্রেরা মিছিলে চলে গিয়েছিল। তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ ওই সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।” স্কুলের খুব কাছ থেকে ছাত্রদের ম্যাটাডর ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ কিছুই জানতে পারলেন না কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেবল তাই নয়, এ দিন স্কুলের পড়ুয়াদের কারও কারও কথায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, স্কুলের মধ্যে ঢুকেই মিছিলের উদ্যোক্তারা ছাত্রদের নিয়ে গিয়েছেন। মিছিলে যোগ দেওয়া ওই স্কুলের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র বলে, “বৃহস্পতিবার পৌনে ১১টা নাগাদ স্কুলে ঢুকি। দেখি, চার দাদা ও এক দিদি উঠোনে দাঁড়িয়ে। তাঁদের মধ্যে থেকেই এক জন আমাদের বলেন, ‘কী রে, মিছিলে যাবি না?’ আমরা প্রশ্ন করি, স্যারেরা কী বলবেন। ওঁরা বলেন, ‘স্যারেদের জানানোরই দরকার নেই। ওঁরা হাজিরা খাতায় ‘প্রেজেন্ট’ করে দেবেন।” ওই ছাত্রটি জানায়, সওয়া ১১টায় প্রার্থনা শুরুর আগে ক্লাসঘরেও গিয়েছিলেন বাইরে থেকে আসা ওই দাদা-দিদিরা। আগেও তাঁদের স্কুল চত্বরে দেখা গিয়েছে। এ দিন স্কুলে গিয়ে জানা যায়, ৭১২ জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র ১১২ জন এসেছে। বৃহস্পতিবার ডিএসও-র মিছিলে গিয়েছিল, এমন কয়েক জন এ দিন উপস্থিত ছিল। কেন উপস্থিতি এত কম? প্রধান শিক্ষক বলেন, “ছাত্র-অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্কের রেশ সম্ভবত কাটেনি। সেই কারণে হাজিরা কম হতে পারে।” ছাত্রদের উপস্থিতি কম হওয়ায় এ দিন ‘টিফিন’-এর সময় ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। তার পরে স্কুলের পরিচালন সমিতির সদস্যেরা আলোচনায় বসেন। সমিতির সম্পাদক অনন্ত অধিকারী বলেন, “নয় সদস্য নিয়ে গঠিত একটি কমিটি বিষয়টি তদন্ত করবে। শনিবার ওই কমিটি মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্র ও রসায়নের শিক্ষক সুদীপ্ত মণ্ডলকে ডেকে পাঠিয়েছে।” বুধবার ডিএসও-র লিফলেট হাতে পেয়ে ওই শিক্ষকই ছাত্রদের মিছিলে যাওয়ার কথা বিবেচনা করতে বলেছিলেন। |