মুখোমুখি...
নামী পরিচালক বলেছিলেন সোহিনী কেন
ত্রিকা: ‘নায়িকা’ মোটা, তার ওপর সে এক জন মধ্যবিত্ত, মধ্যবয়স্কা গৃহিণী। ছবি ছ’সপ্তাহ হাউসফুল। আপনি তো ‘নায়িকা’ বা ‘হিট’ ছবির সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছেন...
সোহিনী: হা হা হা... সে রকম নয়, তবে এতে আমার খুব আনন্দ হয়েছে। এ রকম একটা সময়, যেখানে চেহারা বা গ্ল্যামারকে অনেকটাই প্রাধান্য দেওয়া হয়, সেখানে এ রকম একটা ছবি হিট হল আর সবাই এত ভালবাসল...তার মানে এখনও বোধহয় ‘আদার থিংস’ ম্যাটার।

পত্রিকা: সেই ‘আদার থিংস’ কী কী?
সোহিনী: ‘ইচ্ছে’র ক্ষেত্রে যেটা ম্যাটার করেছে সেটা গল্প এবং পরিচালনা। কারণ পরিচালক বুদ্ধি করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে কাকে এই ভূমিকায় মানাবে। শুধুমাত্র চেহারা ভেবে কিন্তু তিনি অভিনেতা বাছেননি। আমাকে কাস্ট করবার জন্য শিবুকে (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) এবং নন্দিতাদিকে (রায়) অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে...

পত্রিকা: যেমন?
সোহিনী: সবাই, এমনকী এক নামী পরিচালকও বলেছিলেন, সোহিনী কেন? আরও তো গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী আছেন। সেটা করলে অবশ্য শিবু অনেক বেশি প্রযোজকও পেত। এমনকী, এক অভিনেত্রী, আমি নাম করছি না, একই সঙ্গে এই রোলটা করতে এবং প্রযোজনাও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শিবু সেটা হতে দেয়নি। সেটা করলে আমার মনে হয় ছবিটার বা চরিত্রটার উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হয়ে যেত। এই অনেস্টির জন্যেই আমি কাজটা করেছি।

পত্রিকা: সে যাই হোক, ‘ইচ্ছে’র মতো একটা ছবি এতটা সাফল্য পাবে আশা করেছিলেন?
সোহিনী: এটা একটা দুর্দান্ত ব্যাপার। আমরাই শিবুকে বলেছিলাম, হবে না, ছেড়ে দে। কিন্তু ওর জেদ, একটা সিনেমা বানাবে যেখানে কোনও স্টার থাকবে না, একটা গল্প থাকবে। শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বাসটাই লেগে যায়। আমি চাই যে ‘ইচ্ছে’ বাংলা সিনেমা পাল্টে দিক। ‘ইচ্ছে’ এমন একটা বদল আনুক যেখানে চিত্রনাট্য, অভিনয়, পরিচালনা... এর বাইরে কিছু লাগবে না। সাজানো বাগান তৈরি করে, সব কিছু নিখুঁত, সাঙ্ঘাতিক মেক-আপ, গানের সুর এক্কেবারে ঠিক জায়গায় লাগিয়ে, রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করে...আমার মনে হয় না সব সময় এই ফর্মুলা কাজ করে। তাই যদি হবে, তা হলে ঋত্বিক ঘটক, ঋত্বিক ঘটক হতেন না। ওঁর বেশির ভাগ ছবিই তো সে অর্থে নিখুঁত নয়। আমরা যে এই একটা ধারণার মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম যে ছবি মানেই ঝকঝকে-তকতকে, সুন্দর চেহারা, সুন্দর ঘরের পর্দা, দক্ষিণ কলকাতার ব্লাউজের ছাঁট...এটা জীবন নয়। জীবনে সবাই এক সুরে কথা বলে না। মানুষ যখন চিৎকার করে তার গলা ভেঙেচুরে যায়, যখন কাঁদে অনেক সময় তার মুখ থেকে লালা ঝরে পড়ে। সব কিছুকেই আমি পালিশ করে দেব, তা হয় না। বলছি না যে পর্দায় বাথরুম করতে হবে। কিন্তু যা লোকে দেখে একাত্মবোধ করবে, সে রকম ছবি লোকের ভাল লাগে । ‘ইচ্ছে’ সেটা প্রমাণ করেছে।

পত্রিকা: প্রসেনজিৎ ছবিটা নিয়ে তো উচ্ছ্বসিত টুইট করেছেন...
সোহিনী: হ্যা। এটা আমাদের কাছে খুব বড় পাওনা। উনি নিজে থেকে টিকিট কেটে হলে গিয়ে দেখেছেন। পরে ওঁর সঙ্গে ফোনেও কথা হয়েছে।

পত্রিকা: ‘ইচ্ছে’র নায়িকা মমতার মধ্যে অসহায়তার সঙ্গে একটা হিংস্রতাও আছে। সেই অর্থে এই সময়ে বাংলা ছবির মায়ের ধারণাও আপনি বদলেছেন... মা মানেই কাঁদো কাঁদো, স্বার্থহীন কেউ নাও হতে পারে...
সোহিনী: প্রাথমিক ভাবে গল্পটার জন্যেই এটা হয়েছে। একই সঙ্গে মা, সে আবার প্রেমিকা, যার অধিকারবোধ প্রবল। আবার তার মমত্বও আছে। সে তার সমস্ত দমিত কামনা নিয়ে ছেলের মধ্যে দিয়ে বাঁচতে চাইছে। এই জন্যই আমার মনে হয়েছিল, এটা একটা দুর্ধর্ষ চরিত্র। অনেকেই ভাবে, চেপে ধরার মধ্যেই বোধহয় ভালবাসা আরও দেখানো যায়। আমি খানিকটা নিজেকেও মমতার মধ্যে দেখতে পাই। মনে হয় আমাকে যে রকম দেখতে সেই ব্যাপারটাও এই চরিত্রটা করতে সাহায্য করেছে। আমাদের অনেক মায়েরাই তো এই রকম। নিজের দিকে তাকান না...আমার যা স্ট্রাকচার সেটা সাহায্য করেছে পার্টটা করতে। মমতা যদি ভুরু-প্লাক করা, ভীষণ সুন্দর স্কিনের মহিলা হত তা হলে মমতার চরিত্রটা মমতার মতো হত না।
‘ইচ্ছে’র দৃশ্যে
পত্রিকা: ‘মমতা’কে কতটা আপনার মা (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত)-র মতো লাগল?
সোহিনী: মা একদম মমতার মত নন। আমার মা ৫৭ বছর বয়সে সাঁতার, ড্রাইভিং শিখেছেন। ওঁর স্পিরিট-ই হল হাল না ছাড়ার। এটা জোর গলায় বলতে পারি যে মা-ই আমাকে এক জন মুক্তচিন্তার মানবী হতে শিখিয়েছেন। সেই জন্যেই আমি যা করি সেটা বিশ্বাস করে করতে পারি। মা যদি মমতা হতেন, তা হলে মমতার ছেলে শমীকের মতো আমারও জীবনটা গোড়াতেই নষ্ট হয়ে যেত।

পত্রিকা: জাতীয় পুরস্কারের প্রায় এক দশক পর ‘ইচ্ছে’। এত লম্বা গ্যাপ কেন?
সোহিনী: আমি নিজেকেও ভালবাসি। আমার একটা বিশেষ চেহারা আছে, সেটাকে আমি যা-তা ভাবে ব্যবহার করতে দেব না। আর চেহারা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? মূল ব্যাপারটা তো অভিনয়। সেখানে যে চরিত্রটা করব তাতে যদি বিশ্বাস রাখতে না পারি তা হলে অভিনয়টা করব কী করে?

পত্রিকা: মুম্বইতে চেষ্টা করেননি? সেখানে তো অন্য রকম রোলের চরিত্র পেতে পারতেন...
সোহিনী: না, করিনি। তার প্রধান কারণ হল নান্দীকার। একটা গাছ কিন্তু তার জায়গা পাল্টে বড় হয় না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সে বাড়ে। আমার বিশ্বাস, আমার যদি কিছু ভাল হওয়ার থাকে তা হলে আমি যেখানে আছি, সেখানেই আমার হবে। আমি মুম্বইতে থাকতে পারতাম না, বা খুঁটে খেতে পারতাম না, তা নয়। কিন্তু আমি নান্দীকারের এবং কলকাতার সঙ্গে খুব বেশি করে জড়িত। এটা ছেড়ে গেলে আমি ঠিক থাকতে পারতাম না।

পত্রিকা: গৌতম হালদারের সঙ্গে আপনার ডিভোসের্র কারণে দর্শক দু’জন দুর্দান্ত অভিনেতার একসঙ্গে কাজ করা থেকে বঞ্চিত হল...
সোহিনী: কী করা যাবে! বিবাহবিচ্ছেদের কারণ একেবারে সঠিক ভাবে বলা মুশকিল। কোনও একটা কারণ বলা যায় না। তার মানে এই নয় যে আমি ওঁকে ছোট করছি। আমার ওঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। ওঁর সঙ্গে আমার থিয়েটারের মতবাদ মেলেনি। আমি মনে করি থিয়েটার একটা যুগ্ম শিল্প, সেখানে আমি আর আমার জুনিয়র শিল্পী শম্ভু সমান। আমার মনে হয়েছে আমি যে ধরনের মেয়ে, যে মতবাদে বিশ্বাস করি, সেখানে ওঁর সঙ্গে একটা বিরাট পার্থক্য ছিল। অনেকে সেটা মানিয়ে নিয়ে থেকে যায়। কিন্তু আমার এমন কিছু পিছুটান ছিল না যার জন্য থেকে যেতে পারতাম। তখন আমি ওখান থেকে বেরিয়ে, চাকরি করে, কিছুটা সময় খুঁটে খেয়েছি। আমার মা-বাবার সঙ্গেও খানিকটা সমস্যা হয়েছিল এটা নিয়ে।

পত্রিকা: সমস্যা মানে?
সোহিনী: যে আমি এ রকম একটা বিরাট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। তবে ওঁরা কোনও দিন আমাকে চাপ দেননি যে এ সমস্ত সত্ত্বেও ফিরে যেতে হবে। আমাদের একসঙ্গে থাকাটা ভাগ্যে ছিল না।

পত্রিকা: এ রকম শোনা গিয়েছিল যে গৌতম দলের মধ্যে একনায়কতন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন?
সোহিনী: একেবারেই না। মিথ্যে কথা। যাঁরা নান্দীকারে আছেন, বাচ্চা থেকে বড় তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারবেন। একটা ব্যাপার মনে রাখা ভাল, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর সময় নান্দীকার থেকে চার জন ভাল অভিনেতা বেরিয়েছেন...গৌতম হালদার, সোহিনী সেনগুপ্ত, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত এবং দেবশঙ্কর হালদার। আমাদের সময় কে বেরিয়েছে? তার মানে নিশ্চয় কোথাও আমাদের একটা সমস্যা আছে। কোথাও আমরা আমাদের পরের প্রজন্মকে চেপে ধরে রেখেছি। বাবা না থাকলে, আমরা এই যে এত বাইরে অভিনয় করতে যাই, বা সফল হয়েছি, সেটা সম্ভব হত? বাবা যদি আজ চাইতেন চেপে দিতে, খুব সহজেই পারতেন। আজ আমরা যেটুকু হয়েছি পুরোটাই কিন্তু এই দু’টো মানুষের জন্যে: রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এবং স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।

পত্রিকা: ছবিতে আপনার পছন্দের চরিত্র না পেলে আপনি করবেন না। কিন্তু এই মুহূর্তে নান্দীকারে আরেক জন দুঁদে অভিনেতা আছেন, দেবশঙ্কর হালদার...
সোহিনী: আমার থেকেও দুঁদে...

পত্রিকা: তো আপনার সঙ্গে ওঁর কোনও দিন ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়নি?
সোহিনী: দেবুদার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাতের কোনও জায়গাই নেই। ওঁর জন্যে আমি যে কোনও রকম স্যাক্রিফাইস করতে পারি...

পত্রিকা: অ্যাঁ?
সোহিনী: একদমই। কারণ উনি জানেন কী ভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়। দেবুদা অদ্ভুত মানুষ। ওঁর সম্বন্ধে বলতে গেলে আরেকটা ইন্টারভিউ দিতে হয়। কী ভাবে উনি প্রতিকূল অবস্থাতেও নিজেকে তৈরি করেছেন। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার...নান্দীকারে আমি বা দেবুদা যে কোনও দু’মিনিটের রোলও করতে পারি, কিন্তু বাইরে সেটা কখনওই করব না। উনি আমার থেকে অনেক বড় এবং শক্তিশালী অভিনেতা। এখন দেবুদার অভিনয়ের পাশে নিজেকে কিছুটা তৈরি করতে পেরেছি। দেবুদা অনেক বেশি বুদ্ধিমান এবং পরিণতমনস্ক। সুতরাং ওঁর সঙ্গে সম্পর্কটা ব্যক্তিত্বের সংঘাতের নয়, গুরু-শিষ্যের। জীবনে এবং অভিনেত্রী হিসেবেও।

পত্রিকা: ‘ইচ্ছে’তে আপনার স্বামীর ভূমিকায় ব্রাত্য বসু। ‘কন্যাদান’ নাটকেও আপনারা জনপ্রিয় জুটি। বাংলা ছবি একটা নতুন জুটি পাচ্ছে নাকি?
সোহিনী: (হাসতে হাসতে) ব্রাত্যদার সঙ্গে কাজ করতে খুব মজা লাগে। ওঁকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি তো। আমাকেও উনি খুব স্নেহ করেন। আমাদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা, মজা-ইয়ার্কি চলে। মানে খুব স্বচ্ছন্দ একটা সম্পর্ক। মানে উনি শি-ক্ষা-ম-ন্ত্রী, এই ব্যাপারটা তো একেবারেই নেই। বরং এটা নিয়ে আমাদের বেশ রসিকতাই হয়েছে...হে হে, তুমি শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছ।

পত্রিকা: জাতীয় পুরস্কার থেকে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি সবই পেয়েছেন। তবু সোহিনী সেনগুপ্ত বাঙালির রোজকার জীবনে কই?
সোহিনী: আমি নিজের মতো থাকতে ভালবাসি। এটাকে অসভ্যতা বলবেন কি না জানি না; তবে মনে করি না যে, পার্টিতে গেলে, প্রচুর পিআর করলে আদপে কোনও কাজ হয়। আমার অত ধকও নেই, অত জামা-কাপড়ও নেই। অভিনয়টা আমি গ্ল্যামার বা পয়সার জন্যে করি না। এটা একেবারেই আমার মনের খোরাক। অবশ্য হ্যাঁ, আমি একটা স্কুলে চাকরি করি। তা না হলে হয়তো আমাকে পয়সার জন্যে মেগা সিরিয়াল করতে হত। তার থেকে এই বেশ ভাল আছি। আমার স্কুলের বাচ্চাদের, তাদের মা-বাবাদের, কলিগদের, বন্ধুদের সঙ্গে, আমার পাড়ায় অনেক স্বচ্ছন্দ একটা জীবন যাপন করি। থিয়েটারের জগতে এমন কেউ নেই যাঁরা আমাকে ভালবাসেন না। এর বেশি কিছু চাওয়ারও নেই আমার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.