কখনও ঝিরিঝিরি, কখনও আবার নাগাড়ে বর্ষণ। ভাদ্রের বৃষ্টিতে জঙ্গলমহলের কুমোরটোলায় আশঙ্কা ও বিষাদের আবহ। জঙ্গলমহলের ধারাবাহিক অশান্তির আঁচ লেগেছিল গত দু’বছরের শারদোৎসবে। গত দু’বছর জঙ্গলমহলের পুজোর উদ্যোক্তারা বাজেটে কাটছাঁট করায় মৃৎশিল্পীরাও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। আর এ বার, গত তিন সপ্তাহের বৃষ্টিতে বিলম্বিত হচ্ছে প্রতিমা তৈরির কাজ। পরিস্থিতি এমনই যে, প্রতিমার অনেক বায়নাই ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন শিল্পীরা। বৃষ্টি ও আর্দ্র আবহাওয়ায় প্রতিমার মাটি শুকোনোর জন্য ব্লু-ল্যাম্প ব্যবহার করতে হচ্ছে মৃৎশিল্পীদের। ব্লু-ল্যাম্প জ্বালানোর জন্য খোলাবাজার থেকে চড়াদামে কেরোসিন কিনতে হচ্ছে। ফলে প্রতিমা তৈরির খরচ বেড়ে যাচ্ছে। মৃৎশিল্পীরা জানাচ্ছেন, এ ভাবে আকাশের মুখভার থাকলে এ বারও তাঁদের লাভের আশা নেই। প্রতিমার বৃষ্টিভেজা ঠেকাতে পলিথিন কেনার বহরও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কুমোরটোলায়। |
ঝাড়গ্রাম শহরের বিশিষ্ট মৃৎশিল্পী শিবশঙ্কর সিংহের আক্ষেপ, “গত বছর ৫৫টি বিশ্বকর্মা বানিয়েছিলাম। এ বার মাত্র ৩০টা অর্ডার নিয়েছি। গতবারের থেকে দুর্গাপ্রতিমাও কম বানাচ্ছি। এ বার ভাদ্রমাসে এমন বর্ষার পরিস্থিতি হওয়ায় বেশি প্রতিমা বানানোর ঝুঁকি নেওয়া যাচ্ছে না।” মূর্তি গড়া শিবশঙ্করবাবুর বংশানুক্রমিক পেশা নয়। স্রেফ নেশা থেকেই মৃৎশিল্পকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন শিবশঙ্করবাবু। প্রায় তিরিশ বছর মূর্তি তৈরির পেশায় যুক্ত শিবশঙ্করবাবু জানালেন, “প্রতিমা তৈরির সরঞ্জামের অগ্নিমূল্যের পাশাপাশি বৃষ্টির জন্য নির্মাণ-খরচ বেশি হওয়ায় গ্রামাঞ্চলের অনেক শিল্পীই এ বার বেশি বায়না নিচ্ছেন না। গ্রামগঞ্জের উদ্যোক্তারা শহরের কুমোরটোলায় প্রতিমা বায়না করতে আসছেন। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরাও তাঁদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি।”
শহরের আর একটি কুমোরটোলার প্রবীণ শিল্পী হারাধন দাস বললেন, “অশান্তির কারণে গত দু’বছর ব্যবসায় মন্দা গিয়েছে। এ বার তা পুষিয়ে নেব ভেবেছিলাম। কিন্তু বিধি বাম। দিনরাত ব্লু-ল্যাম্প জ্বেলে প্রতিমা শুকোতে হচ্ছে। প্রতিমা-তৈরির খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সহযোগী শিল্পীদের পারিশ্রমিক মিটিয়ে মূর্তি তৈরির খরচ উঠবে কি না সেটাই এখন চিন্তা।” হারাধনবাবুও এ বার গত বছরের তুলনায় কম মূর্তি বানাচ্ছেন। জঙ্গলমহলের শিল্পীদের বক্তব্য, এমনিতেই প্রতিমা তৈরির সরঞ্জামের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বৃষ্টির জন্য নির্মাণ-খরচ অনেক বেশি পড়ছে। তাই, গ্রাম-শহরের কুমোরটোলার শিল্পীরা বেশি বায়না নিতে চাইছেন না। নয়াগ্রাম ব্লকের খড়িকামাথানি অঞ্চলের ভাতভাঙা গ্রামের মৃৎশিল্পী সুশঙ্কর আচার্য বলেন, “বৃষ্টির জন্য খুবই সমস্যায় পড়েছি। গতবার ৪৫টি বিশ্বকর্মা ও দু’টি দুর্গাপ্রতিমা বানিয়েছিলাম। এ বার মাত্র ২৫টি বিশ্বকর্মার অর্ডার নিয়েছি। আর দুর্গাপ্রতিমা একটি। এ রকম আবহাওয়ায় সময় মতো প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ করব কী ভাবে জানি না।” সুশঙ্করবাবুর মতো ছোট মৃৎশিল্পীদের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে শরৎকালের বৃষ্টিই! |