...গন্ধ এসেছে: প্রসস্থ

থিমে কুলিটাউন

সাবধান, স্কন্ধকাটা ভূতটা কিন্তু যখন তখন বেরিয়ে আসতে পারে!
চমকে উঠলেন? দুগ্গা ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে এমন ভূতের পাল্লায় আর কেই বা পড়তে চায় বলুন? তবে আলো-আঁধারি রাস্তায় কাঠের তৈরি ভাঙাচোরা হানাবাড়িতে ঢুকলে এমনটাই ঘটবে।
বালির নিশ্চিন্দা পশ্চিমপাড়া সর্বজনীন পুজো কমিটির এ বারের থিম ‘হানা বাড়ি’। ভাঙাচোরা সিঁড়ি বেয়ে বিভিন্ন ধরনের ভূতের সঙ্গে সখ্য করেই উঠতে হবে বাড়ির দোতলায়। সেখানে আচমকাই খুলে যাবে ঘরের বন্ধ দরজা। ভিতরে দেখা যাবে দু’হাতের দুর্গাপ্রতিমা।
তবে শুধু ভূতের খপ্পরেই পড়া নয়, পুজোর চার দিন আদিবাসী গ্রাম, তালপাতার ভেঁপু, কাঠের ঢোল, মাদুরকাঠি, কাচের টুকরোর ছোঁয়ায় বদলে যেতে চলেছে উত্তর হাওড়ারচেনা ছবিটা। ভাঙা রাস্তা, জলমগ্ন এলাকা, আবর্জনার স্তূপ সবই উধাও। আসলে ম্যাজিক একটাই, ‘থিম’।
যেমন, ডবসন রোডের ‘গোলমোহর সর্বজনীন শারদোৎসব কমিটি’র ভাবনায় আদিবাসী গ্রাম। গ্রামের মন্দিরে, কুঁড়েঘরে, চাষের খেতে থাকছে জীবন্ত মডেল। মেঠো পথে ঘোরার সময় বাড়তি পাওনা বাউল গান। গ্রামের আটচালার মণ্ডপে থাকবে বাংলার পুতুলের আদলে প্রতিমা। থাকছে মেলা।
থিমের ম্যাজিকে প্রতি বার চমক দেয় সালকিয়ার ত্রিপুরা রায় লেনের ‘আলাপনী’। তাদের ৬৪তম বর্ষের ভাবনা ‘নানা রঙের ছোট্টবেলা। আলাপনীর মিলন মেলা।’ রিমোট নিয়ন্ত্রিত এবং চাইনিজ খেলনার দৌলতে কার্যত হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো দিনের খেলনাগুলি। প্রবীণেরা এখন আর নতুন প্রজন্মের হাতে তালপাতার ভেঁপু, সেপাই, বাঁশের মুখোশ, চরকা, কাঠের ঢোল তুলে দিতে পারেন না। শিশুরা এখন কম্পিউটারে গেমস খেলে। হারিয়ে যাওয়া সেই শৈশবকেই চার দিনের জন্য মণ্ডপে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চালাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। মণ্ডপের নাটমন্দিরে মডেলের মাধ্যমে দেখা যাবে কয়েকটি শিশু বিভিন্ন ঠাকুর সেজে খেলা করছে। ছোটদের বইয়ের প্রচ্ছদের কোলাজ দিয়ে তৈরি মণ্ডপের দেওয়ালে সাজানো থাকবে পুরনো দিনের খেলনা।
কেদারনাথ মন্দিরের আদলে মণ্ডপ বানাচ্ছে ক্ষেত্র মিত্র লেনের ‘সালকিয়া তরুণ দল’। খেজুর গাছের ছাল, সিন্থেটিক তুলো দিয়ে তৈরি হচ্ছে পাহাড়, বরফ। ৭৪ বছরের এই পুজোয় বহরমপুরের সাবেক প্রতিমা। কেদারনাথ ঘুরে সালকিয়ার ঘিঞ্জি অলিগলি দিয়ে সহজেই পৌঁছনো যাবে কৈলাসে শিবের দেশে। তবে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে এই কৈলাসে বরফ মিলবে না। শিবলিঙ্গের অর্ধেকটাই মাটির নীচে। এমনই থিম তৈরি করছে সালকিয়া স্কুল রোডের ‘সালকিয়া ছাত্র ব্যায়াম সমিতি’। শিবলিঙ্গের বাইরের গায়ে বিভিন্ন চিত্রকলার কারুকার্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে মহাদেবের বিভিন্ন রূপসজ্জা। শিবলিঙ্গের ভিতরে প্লাই, বাঁশের মাধ্যমে অসমিয়া ভাবনায় মহাদেবের বিভিন্ন রূপসজ্জা ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। সেখানেই থাকবে দুর্গা মূর্তি।
বল্লাল ঢিপি তৈরি করে দর্শক টানার ঠান্ডা লড়াইয়ে পিছিয়ে নেই সালকিয়ার রামলাল মুখার্জি লেনের ‘অগ্রদূত’ পুজো কমিটি। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজপ্রসাদের ৪৫টি ভাঙাচোরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় দেওয়ালের কুলঙ্গিতে দেখা মিলবে ভাঙাচোরা দেবদেবীর মূর্তি। ভগ্নপ্রায় নাটমন্দিরে দর্শন মিলবে ধাতুর তৈরি দেবী মূর্তির। মণ্ডপে ঢোকার মুখে একটি প্রস্তর ফলক থেকে বল্লাল সেনের ঢিপি সম্পর্কে জানা যাবে।
মানুষ, জীবকুল কেউই গাছ ছাড়া বাঁচতে পারে না। কিন্তু কিছু অসাধু মানুষ ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য গাছ কেটে সবুজ ধ্বংস করছে। বিপন্ন হচ্ছে মানুষ ও জীবকুলের অস্তিত্ব। সেই কারণেই ‘সালকিয়া শৈলেন্দ্র বসু রোড সর্বজনীন মহাপূজা কমিটি’র পুজোয় বনদেবীর কাছে নিজেদের আকুতি জানাতে সামিল হচ্ছে পাঁচটি কাটা গাছ। দরমা, প্যারিস, রং দিয়ে তৈরি পাঁচটি গাছই এই কমিটির পুজোর মণ্ডপ।
বিভিন্ন আকারের কাচের টুকরো দিয়ে ৫৫ ফুট উচ্চতার ইস্কনের মন্দির বানাচ্ছে দশরথ ঘোষ লেনের ‘বামুনগাছি রিক্রেয়েশন ক্লাব’। কাচের টুকরোর তৈরি দেবদেবীর মূর্তি দিয়ে সাজানো হবে মন্দিরের অভ্যন্তর। চমক থাকছে চন্দননগরের আলোকসজ্জায়।
বেনারস রোড ‘স্বামীজি নগর সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’র ৫০ বছরের মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে অসমের বাঁশ, মাটির প্রদীপ, কুলো, ধামা দিয়ে। কড়ি, শাখা-পলার কারুকার্য ও বাঁশের উপর আঁকা পটচিত্র দিয়ে সাজানো হচ্ছে মণ্ডপ। মণ্ডপে ঢোকার মুখে কাঠের তৈরি ঘোড়ার গাড়িতে দেখা যাবে বাংলার কাঠের পুতুলের আদলে তৈরি প্রতিমা। তবে মূল মণ্ডপে থাকছে ডাকের সাজের প্রতিমা।
মাদুরকাঠি দিয়ে ওড়িশার চন্দনেশ্বর শিবমন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি করে তাক লাগাতে চলেছে জগদীশপুরের ‘দেবীরপাড়া ৩ নম্বর ভারতমাতা পুজো কমিটি’। মণ্ডপে সিংহের উপরে ভারতমাতা দুর্গার দুই হাতে থাকবে পদ্মফুল ও জাতীয় পতাকা। প্রতিমা কাঠের।
দরমা, মাটির হাঁড়ি, প্রদীপ, সরা, বাটি দিয়ে কাল্পনিক শিবমন্দি বানাচ্ছে বালির ‘ষষ্ঠীতলা সেবা সমিতি’। মণ্ডপের ভিতরের সজ্জায় শিবের ত্রিশূল, ডুগডুগি এবং অন্যান্য উপকরণ থাকছে। খড়ের চালা, ধূপধুনোর গন্ধ, মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে মণ্ডপে তৈরি করা হবে আধ্যাত্মিক পরিবেশ।
গোটা হাওড়া শহরটাই এ বারের থিম সালকিয়া বাবুডাঙার ‘ব্যানার্জিবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’র। উদ্যোক্তারা জানান, বহু পুরনো কুলিটাউন হাওড়ার বিভিন্ন রাস্তা, ঐতিহাসিক নিদর্শন সম্পর্কে অনেকেই বিশদে জানেন না। বিভিন্ন মডেলের মাধ্যমে অজানা সেই তথ্যই ফুটিয়ে তোলা হবে মণ্ডপে। উদ্যোক্তাদের দাবি, চমক থাকছে সুবীর পালের তৈরি কৃষ্ণনগরের প্রতিমাতেও।

ছবি: রণজিৎ নন্দী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.