...গন্ধ এসেছে
ফিরছে সহজ পাঠ
-ও এক অন্বেষণ।
শারদোৎসবে নিছক থিম পুজোর ইঁদুর দৌড় নয়, হারিয়ে যাওয়া স্থাপত্য থেকে অজানা সব লোকশিল্পকে তুলে ধরা। কোথাও আবার যন্ত্রণা মুছে দিতে কৌতুকই বিষয়। পাশাপাশি, সবুজায়ন থেকে পুরান, এক কথায় উত্তর শহরতলি শারদোৎসবে যেন তুলে ধরেছে এক অ্যালবাম। যার পাতায় পাতায় বিষয় কিংবা উপস্থাপনায় বৈচিত্র ধরা দিয়েছে।
বরাহনগর থেকে কামারহাটি এলাকায় সে ছবিই ধরা পড়বে। আলমবাজারের কাছে কালাকার পাড়ার পুজোর বিষয় গোপাল ভাঁড়ের রথযাত্রা। এখানে এলে দেখা যাবে এক নয়, বিভিন্ন রূপে গোপাল ভাঁড়ের কর্মকাণ্ড। উদ্যোক্তাদের দাবি, দুঃখ-যন্ত্রণার ভিড়ে কৌতুক কোথাও হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই গোপাল ভাঁড়কে ফিরিয়ে আনা। কাল্পনিক রথযাত্রার আড়ালে সামাজিক সমস্যা সমাধানের প্রয়াস। মাটির কুঁজো, হাড়ি, কলসি, পুতুল ও বিভিন্ন খেলনা দিয়ে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। কার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রতিমা। উদ্যোক্তাদের দাবি, পুতুল থেকে শুরু করে গোপাল ভাঁড়ের মূর্তিগুলি চলমান।
বরাহনগরে থিম পুজোর মধ্যে কর্মী সঙ্ঘ অন্যতম জনপ্রিয় নাম। পাহাড়ি এলাকা এবং সেখানকার একটি মন্দিরকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে পরিকল্পনা। ভারতমাতার আদলে প্রতিমা। উদ্যোক্তারা জানান, ঝাড়খণ্ডের একটি পাহাড়ের উপর একটি মন্দিরকে অনুসরণ করেই এই পরিকল্পনা।
শুধু নতুনত্বের সন্ধানই নয়, দুঃস্থ লোকশিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোও লক্ষ্য। তাই লেকভিউ পার্ক সর্বজনীনের উদ্যোক্তারা এ বার নারকেল গাছের ফেলে দেওয়া অংশগুলিকে দিয়ে মণ্ডপ ও প্রতিমা তৈরি করছেন। কাটোয়ার শিল্পীরা এই কাজ করছেন। উদ্যোক্তারা জানান, তাঁদের থিম: মণ্ডপে ষোলো আনা, পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। গাছের গুঁড়ি কেটে কেটে মূর্তি থেকে মণ্ডপের অন্য ভাবনাগুলি ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। বর্ধমানের ছোট ছোট পুতুলও মণ্ডপসজ্জায় ব্যবহার করা হবে।
বরাহনগরের মিলনগড় সর্বজনীনের পুজোয় এ বারের থিম আরণ্যক। জঙ্গল ও আদিবাসী জীবনই বিষয়। তালপাতা, দিনাজপুরের বাঁশ, সুপুরি গাছকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে সেই জঙ্গলের জলছবি। সুপুরি দিয়ে তৈরি অসংখ্য পাখি এই জঙ্গলে দেখতে পাওয়া যাবে। সেই ভাবনা ফুটিয়ে তুলতে আবহ নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা থাকছে এই মণ্ডপে। আলোকসজ্জাতেও চমক থাকবে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের।
অন্য দিকে, বরাহনগরের মুন্সিরবাগান সর্বজনীনের পুজোও গত কয়েক বছরে চমক দিয়েছে। ছোট্ট একফালিতে গত বার তারা পুতুলের পসরা সাজিয়েছিল। এ বারের ভাবনায় থাকছে ঘট। মণ্ডপ থেকে প্রতিমায় সেই ঘটের নানা আদল ফুটে উঠছে। উপকরণ মূলত মাটি ও খড়। মণ্ডপে মাটির চালের উপরে থাকছে মধুবনি চিত্রকলা। প্রতিমাও সেই আদলে তৈরি হচ্ছে।
সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে নেতাজি কলোনি (লো ল্যান্ড) সর্বজনীনের পুজোয় এলে স্বর্ণমন্দির দেখতে পাওয়া যাবে। ঘোষপাড়া বন্ধুদল এ বার দিল্লির অক্ষরধাম মন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি করছে। দক্ষিণ ভারতের চামুণ্ডা মূর্তির আদলে তৈরি পিতলের মূর্তি। তাদেরও এ বার সুবর্ণজয়ন্তী। বরাহনগরে ফকির ঘোষ লেনও পুজোর পরিচিত নাম। তাদের এ বারের ভাবনায় হুগলির আটপুরের মিত্তির বাড়ির পুজো। মণ্ডপ থেকে প্রতিমায় তারই প্রতিফলন দেখা যাবে বলে জানান উদ্যোক্তারা। দেবীগড়ের পুজোয় এ বার গ্রাম্য প্রকৃতিকে তুলে ধরা হবে।
থিমের মধ্যে না গিয়েও লেকপল্লি স্পোর্টিং ক্লাব এ বার দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে চলেছে। তাদের পরিকল্পনায় বিধানসভা। ঘোষপাড়া সম্মিলনী, ফরোয়ার্ড কলোনি, শান্তনীড় হাউসিং এস্টেট, উত্তরায়ণ-সহ আবাসনের উদ্যোক্তারাও এ বার দর্শনার্থী টানবেন বলে আশা।
পুজোর প্রস্তুতিতে সেজে উঠেছে বেলঘরিয়া-কামারহাটি এলাকা। বেলঘরিয়ার অন্যতম দু’টি বড় পুজো ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের কাছে মানসবাগ ও পঞ্চাননতলা বাণীমন্দির। ৬৪তম বর্ষে মানসবাগের এ বারের থিম বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাঙালির বিভিন্ন ব্রত ও আচার-উপাচারের নিদর্শন নিয়ে সাজছে মণ্ডপ। বারকোশ, বাঁশ, কুলো, মাদুর, ঘণ্টা ইত্যাদি দিয়ে মণ্ডপ সাজিয়ে তুলতে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন শিল্পী ও কারিগরেরা। ৫২তম বর্ষে বাণীমন্দিরের এ বারের থিম দারু শিল্প। কাঠ খোদাই করে তৈরি করা পুতুল দিয়ে মণ্ডপ করছেন কাটোয়া ও হাওড়ার দুই শিল্পী। বিশেষ আকর্ষণ কাঠের দুর্গা প্রতিমা।
৭২তম বর্ষে আড়িয়াদহের বিন্ধ্যবাসিনীতলা রোডের প্রগতি সঙ্ঘের থিম বনভূমি সংরক্ষণ ও বিশ্ব উষ্ণায়ন। তাই গাছের উপর মণ্ডপ। প্রতিমার অধিষ্ঠানও সেখানে। বি টি রোডের ধারে ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের কাছে শ্রীকৃষ্ণনগর জাগরণী সঙ্ঘও প্রতি বার থিম পুজো করে। এ বার এই পুজোর ২৭ বছর। এখানেও থিম সবুজায়ন। তবে সঙ্গে থাকছে ‘হেরিটেজ’ মণ্ডপ। নাম দেওয়া হয়েছে, ফিরে দেখা। প্রিন্সেপ ঘাটের আদলে এই মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব সীসাবিহীন রঙের প্রতিমা থাকছে সামঞ্জস্য রেখে।
আড়িয়াদহ-কামারহাটির নৈশ প্রহরী ক্লাবের ২৭ বছরের পুজোয় থিম প্লাস্টিক বর্জন। সারা বছর ধরেই এই ক্লাবের সদস্যরা প্লাস্টিক বর্জন নিয়ে সচেতনতা তৈরির কাজ করেন। তাই এই থিমটা সহজাত। এখানকার প্রতিমা সাবেক, কিন্তু মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে বাঁশশিল্পের উৎকর্ষ তুলে ধরতে। মণ্ডপের চারপাশে থাকছে বাঁশের মডেল। আড়িয়াদহের রামগড়-জয়শ্রীনগর অ্যাসোসিয়েশনের ৪৭ বছরের পুজোয় মণ্ডপের থিম সূর্য।

ছবি: সুদীপ ঘোষ।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.