|
|
|
|
কলেজ-কর্তার গুলিবিদ্ধ দেহ নিজের গাড়িতে, খুন চালকও |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
বৃহস্পতিবার রাত তখন একটা।
নিঝুম রাস্তায় ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে
দাঁড়িয়ে একটা গাড়ি। চার দিকের সব ক’টা ‘ইন্ডিকেটর ল্যাম্প’ জ্বলছে-নিভছে। অনেক দূর থেকেও নজরে আসে।
অনেকক্ষণ একই ভাবে গাড়িটা দাঁড়িয়ে কেন?
টহলরত পুলিশকর্মীরা সন্দিগ্ধ হয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন ব্যাপারটা দেখতে। দেখে চমকে ওঠেন তাঁরা। গাড়ির ভিতর চাপ চাপ রক্তের মধ্যে পড়ে রয়েছে দু’-দু’টো মৃতদেহ!
ঘটনাস্থলটি বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের উত্তর বাদরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে। পুলিশ জানিয়েছে, নিহতেরা হলেন সুপ্তেন্দু দত্ত (৪৭) ও তাঁর গাড়ির চালক সুশান্ত ঘোষাল (২৭)। দু’জনকেই গুলি করে খুন করা হয়েছে। চুঁচুড়ার খাগড়াজোল নারকেলবাগানের বাসিন্দা সুপ্তেন্দুবাবু একটি বেসরকারি ম্যানেজমেন্ট ও তথ্য-প্রযুক্তি কলেজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সল্টলেক ও শিলিগুড়িতে কলেজটির শাখা আছে। চুঁচুড়ায় আর একটা শাখা তৈরি হচ্ছে। এই ঘটনায় ওই কলেজেরই সহকারী হিসাবরক্ষক অসিত রায়কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আটক করেছে শুক্রবার সকালে। তাঁর বাড়ি দমদমের সুভাষনগরে। |
|
|
সুপ্তেন্দু দত্ত |
সুশান্ত ঘোষাল |
|
পুলিশ-সূত্রের খবর: বৃহস্পতিবার বিকেলে সুপ্তেন্দুবাবু গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন। প্রথমে যান কলকাতায়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, সুপ্তেন্দুবাবুর কলেজের হিসাবরক্ষক ক’মাস আগে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন, তাই এক জন হিসাবরক্ষক নিয়োগের জন্য এ দিন সুপ্তেন্দুবাবু কলকাতায় আসেন। আসার পথে সুপ্তেন্দুবাবু অসিতবাবুকেও বাড়ি থেকে তুলে নেন। অসিতবাবুকে জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে, বৃহস্পতিবার বিকেলের পরে অফিস সংক্রান্ত নানা কাজে বেশ কয়েকটি জায়গায় তাঁরা গিয়েছিলেন। রাত দশটা নাগাদ অসিতবাবুকে সুভাষনগরের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যান সুপ্তেন্দুবাবু।
তার পরে?
পুলিশের বক্তব্য: অসিতবাবু জানিয়েছেন, রাত এগারোটা নাগাদ সুপ্তেন্দুবাবুর স্ত্রী মৌসুমিদেবী তাঁকে ফোন করে স্বামীর খোঁজ চান। মৌসুমিদেবী তাঁকে বলেন, সুপ্তেন্দুবাবুর মোবাইলে তিনি বারবার ফোন করছেন, অথচ ফোন বেজেই যাচ্ছে। অসিতবাবু জানিয়ে দেন, রাত দশটা নাগাদ সুপ্তেন্দুবাবু তাঁকে বাড়িতে নামিয়ে চুঁচুড়া রওনা হয়ে গিয়েছেন। ‘বাড়িফেরতা’ সেই ব্যক্তিরই হদিস মিলল মাঝরাতে, গাড়ির ভিতরে নিহত অবস্থায়।
পুলিশ বলছে, রাত একটা নাগাদ বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের বাদরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি কালচে-নীল ইন্ডিকাকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টহলদারি দলের সন্দেহ হয়। গাড়ির মুখ ছিল দক্ষিণেশ্বরের দিকে। কাছে গিয়ে পুলিশকর্মীরা দেখেন, গাড়ির ভিতরে গুলিবিদ্ধ দু’টো দেহ। সামনে, চালকের পাশের আসনে পড়ে থাকা মধ্যবয়সীর বুকের বাঁ দিকে গুলির ক্ষত। ড্রাইভারের সিটের ঠিক পিছনের আসনে ধরাশায়ী যুবকটির ডান দিকের কপাল ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে গুলি। |
|
সুপ্তেন্দুবাবুর শোকার্ত পরিবার। ছবি: তাপস ঘোষ |
চালকের পাশের আসনের দেহটি সুপ্তেন্দুবাবুর, অন্যটি তাঁর ড্রাইভার সুশান্তবাবুর। ঘটনাস্থলে আর কী মিলেছে?
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, গাড়ির ভিতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল চানাচুর, অর্ধেক খাওয়া দু’টো ভুট্টা, একটা জলের বোতল। আর একটা বোতলে ছিল জল মেশানো মদ। পিছনের আসনে ও সামনের গিয়ারবক্সে ছিল চাপ চাপ রক্ত। ড্রাইভারের সিট ছিল ছেঁড়া। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, খুনের সময়ে ধস্তাধস্তি হয়েছে। তবে গাড়ির বিশেষ ক্ষতি হয়নি।
এ দিন দুপুরে সিআইডি এবং জেলা পুলিশের কর্তারা ঘটনাস্থলে যান। ফরেন্সিকদল নমুনা সংগ্রহ করে। সুপ্তেন্দুবাবুর মোবাইলের ‘কল লিস্ট’ পরীক্ষা করা হচ্ছে।
পুলিশ-সূত্রের খবর: আশপাশের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রাতে তাঁরা কোনও গুলির আওয়াজ পাননি। বাবুলাল দাস নামে স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, “মাঝে মাঝে রাতে টায়ার ফাটার আওয়াজ পাই। কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। কোনও শব্দ কানে আসেনি।”
তা হলে কি দু’জনকে অন্য কোথাও খুন করে গাড়িটা ওখানে ফেলে গেল আততায়ীরা?
স্বভাবতই প্রশ্নটা উঠছে। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সুশান্তবাবুর কপালের গুলির ক্ষত আর সুপ্তেন্দুবাবুর বুকের ক্ষতের প্রকৃতি একই রকম। যদিও গাড়ির মধ্যে কার্তুজের খোল মেলেনি। পুলিশের বক্তব্য, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে (খুব কাছ থেকে) গুলি করা হলে চামড়ায় যেমন পোড়া দাগ থাকার কথা, এখানেও তা ছিল। আর তাতেই পুলিশের অনুমান, খুব কাছ থেকেই দু’জনকে গুলি করা হয়েছে। হতে পারে, গাড়ির ভিতরে বসেই!
কিন্তু খুনিরা গাড়িতে উঠল কী করে? |
|
পুলিশের অনুমান, আততায়ীরা সুপ্তেন্দুবাবুর পরিচিত। চানাচুর, ভুট্টা বা জল মেশানো মদ তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তদন্তকারীরা প্রাথমিক ভাবে যে তত্ত্ব দিচ্ছেন, তা হল: গাড়িতে বসে সবাই মিলে মদ্যপান চলছিল। একটা সময়ে চালককে পিছনের সিটে পাঠিয়ে আততায়ীরা গাড়ির দখল নেয়। তাদের সঙ্গে আর একটা গাড়ি ছিল। সুপ্তেন্দুবাবুদের খুন করার পরে ইন্ডিকাটি নির্জন জায়গায় রেখে ওই গাড়ি চেপেই তারা পালিয়েছে।
কিন্তু ওঁদের মারা হল কেন?
বস্তুত খুনের ‘মোটিভ’ নিয়ে পুলিশ এখনও অন্ধকারে। সুপ্তেন্দুবাবুর কোনও কিছুই খোয়া যায়নি। তাই নিছক ছিনতাইয়ের জন্য এই কাজ করা হয়নি বলে পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “খুনের কারণ স্পষ্ট হয়নি। সুপ্তেন্দুবাবুর পরিচিত অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।” সুপ্তেন্দুবাবুর কলেজের আগের হিসাবরক্ষক কেন কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন, পুলিশের কাছে তা-ও স্পষ্ট নয়। শুধু জানা গিয়েছে, সুপ্তেন্দুবাবু বেশ ক’দিন ধরে নতুন হিসাবরক্ষকের খোঁজ করছিলেন। দেখা হচ্ছে, তিনি টাকা লেনদেন সংক্রান্ত কোনও ঘটনা কিংবা ধার-দেনায় জড়িয়েছিলেন কি না।
সুপ্তেন্দুবাবুরা দু’ভাই। অন্য ভাই দীপ্তেন্দুবাবু স্ত্রী ও মাকে নিয়ে চুঁচুড়ার বাড়ির একতলায় থাকেন। দোতলায় স্ত্রী ও দু’বছরের কন্যাকে নিয়ে থাকতেন সুপ্তেন্দুবাবু। সপ্তাহ তিন আগে সুপ্তেন্দুবাবুর বাবা মারা গিয়েছেন। মৌসুমিদেবী এ দিন বলেন, “নতুন অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিতে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। সন্ধের পরে মোবাইলে বারবার ফোন করেও সাড়া মেলেনি। ভোরে দমদম থানা থেকে জানাল, ওঁদের দুর্ঘটনা ঘটেছে। পরেই টেলিভিশনেও দেখলাম।” সপ্তেন্দুবাবুর স্ত্রী জানিয়েছেন, খুনের কারণ তিনিও আন্দাজ করতে পারছেন না। বিহ্বল মা পুষ্পাদেবী বলেন, “ক’দিন আগে স্বামী চলে যান। ছেলেকেও হারালাম।”
হুগলির চুঁচুড়ার পিপুলপাতিতে সুশান্তবাবুর বাড়িও শোকস্তব্ধ। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। পাড়ার লোক জানান, এলাকায় সুশান্তবাবুর সুনাম ছিল। ওঁদের
ধারণা, আততায়ীরা প্রমাণ লোপাটের জন্যই সুশান্তবাবুকে খুন করেছে।
রাজ্যের তথ্য-প্রযুক্তিমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন জানান, যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু করতে তিনি ডিজি-কে বলেছেন। পার্থবাবুর কথায়, “ডিজি জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমি বলেছি, দরকারে যেন সিআইডি-কে দিয়ে তদন্ত করানো হয়। রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে কোনও রকম নমনীয় মনোভাব দেখাতে রাজি নয়।” |
|
|
|
|
|