আচমকা বন্ধ-অবরোধ বন্ধে ইতিমধ্যেই ‘সক্রিয়’ তিনি এবং তাঁর দল। এ বার কলকাতাকে রাজনৈতিক হোর্ডিং-মুক্ত করতে এবং শহরের কেন্দ্রস্থলে রাস্তা আটকে মিটিং-মিছিল বন্ধেও উদ্যোগী হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এখনও পর্যন্ত ঠিক আছে, আগামী ১৬ তারিখ, শুক্রবার ওই বিষয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলের মতামত নিতে মহাকরণে সর্বদল বৈঠক হবে। এর জন্য ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজনৈতিক দলগুলিকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়। প্রসঙ্গত, বন্ধ-অবরোধ বন্ধেও মুখ্যমন্ত্রী সর্বদল বৈঠক ডাকার কথা জানিয়েছেন রাজ্য বিধানসভার সদ্যসমাপ্ত অধিবেশনে। বস্তুত, বিধানসভায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে ‘হাতজোড়’ করে বন্ধ এবং অবরোধের রাস্তা থেকে সরে আসার অনুরোধ করেছিলেন মমতা। তবে তাঁর ওই উদ্যোগ নিয়ে ইতিমধ্যেই ‘বিরূপ’ মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করেছে প্রধান বিরোধীদল সিপিএম। ইতিমধ্যেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছেন, “বন্ধ বা ধর্মঘট বন্ধ করার পরিকল্পনা এক অলীক কল্পনা!” বিমানবাবুর কথা থেকে এটা স্পষ্ট যে, বন্ধ বন্ধ করা সংক্রান্ত সর্বদল বৈঠকে গিয়েও তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবের বিরোধিতা করবেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও ‘ব্যক্তিগত ভাবে’ বন্ধের রাজনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু তিনি আলিমুদ্দিনকে বাগে আনতে পারেননি। মমতার সে সমস্যা নেই। তাঁর কাছে কালীঘাট এবং মহাকরণ সমার্থক। তবে শহরকে রাজনৈতিক হোর্ডিং মুক্ত করা বা মিটিং-মিছিলের জন্য কোনও একটি জায়গা নির্দিষ্ট করার বিষয়ে বিরোধী শিবির তাঁর সঙ্গে একমত হবে বলেই আশা করছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতার সর্বদল বৈঠক ডাকার অবশ্য আরও একটি কারণ রয়েছে। বৈঠকে ঐকমত্য না-হলে তিনি এটা বলতে পারবেন যে, তাঁর ‘সদিচ্ছা’ ছিল। কিন্তু অন্যান্য দলের আপত্তিতে তা করা গেল না। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দলগুলির ‘স্বরূপ’ সাধারণ মানুষের কাছে ধরা পড়বে।
নির্দিষ্ট স্থান কোথায় হবে?
মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ইতিমধ্যেই প্রস্তাব গিয়েছে ধর্মতলায় শহিদ মিনারের পাদদেশের কথা জানিয়ে। প্রাথমিক ভাবে প্রস্তাবটি মমতার পছন্দ। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজস্ব পছন্দ কারও উপর চাপিয়ে দিতে চান না। এমনকী, সরকার যদি ওই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তা-ও তারা নিজেরাই নিতে পারে। কিন্তু এই সরকার সহমতের ভিত্তিতে চলতে চায় বলেই মুখ্যমন্ত্রী সর্বদল বৈঠক ডেকে ওই জায়গাটি এবং পুরো বিষয়টি সম্পর্কে সকলের মতামত চাইছেন। বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলি একমত হলে কলকাতা পুরসভা বা রাজ্যের নগরোন্নয়ন দফতর শহিদ মিনারের পাদদেশে জায়গাটি নির্দিষ্ট করে সেটি পাকাপাকি ভাবে মিটিং করার উপযুক্ত করে তৈরি করে দেবে।”
শহিদ মিনারের পাদদেশের কথা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব করেছেন তাঁর দলের এক সাংসদ। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারের উদাহরণ দিয়েছেন। ওই সাংসদ শুক্রবার বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি জায়গাটি সম্পর্কে উৎসাহী। রাজনৈতিক দলগুলি একমত হলে জায়গাটি সভা-সমাবেশের জন্য নির্দিষ্ট করে সেখানেই যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি করা হবে। তার জন্য কলকাতা পুলিশের কাছে নিয়মমাফিক দরখাস্ত করতে হবে। ‘আগে এলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে সভার অনুমতি দেওয়া হবে।”
রাজনৈতিক দলগুলি সাধারণত সমাবেশের জন্য বাস-ট্রাক-ম্যাটাডরে করে লোক আনে। মেট্রো চ্যানেল বা রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে সেই যানগুলিও অনাবশ্যক জায়গা জুড়ে থাকে। শহিদ মিনারের পাদদেশে সভা হলে ওই সব যানবাহনের জন্য মেয়ো রোডের ধারে পার্কিং-এরও ব্যবস্থা করতে চায় রাজ্য সরকার। সভা শেষের পর সেখান থেকেই জমায়েতের লোকজন আবার ফিরে যেতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে মিছিল বা বাড়তি যানবাহনে শহরের গতিও রুদ্ধ হবে না। তা ছাড়া, সমাবেশের জায়গাটিও শহরের কেন্দ্রস্থলেই হবে।
কলকাতা পুলিশের তথ্য বলছে, গত ৯ অগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক মাসে ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেল (মেট্রো সিনেমার বিপরীতে) এবং রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ছোটবড় মিলিয়ে মোট ২৭টি সভা হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশই শহরের কেন্দ্রস্থলে ‘অনাবশ্যক যানজটে’র কারণ হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও সেই তথ্য রয়েছে। কিন্তু শহরের কেন্দ্রস্থল যানজট-মুক্ত করার বিষয়ে তাঁর ভাবনাকে আরও ‘ত্বরাণ্বিত’ করেছে বৃহস্পতিবার এসইউসি-র ছাত্র সংগঠন ডিএসও-র মিছিল। ওই মিছিলে স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে (যা নিয়ে ইতিমধ্যেই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী) মমতা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। পাশাপাশিই, তিনি জেনেছেন, ডিএসও-র মিছিলে আবার অবরুদ্ধ হয়েছিল শহরের ব্যস্ত এলাকা। তার পরেই এ দিন মুখ্যমন্ত্রী সর্বদল বৈঠক ডাকার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন।
ওই বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রী সরকারের তরফে আবেদন জানাবেন, যাতে শহরকে রাজনৈতিক হোর্ডিং-মুক্ত করে শহরবাসীকে ‘দৃশ্যদূষণে’র হাত থেকেও মুক্তি দেওয়া যায়। নিজেই উদাহরণ তৈরি করতে চেয়ে ভবানীপুর উপনির্বাচনে তাঁর প্রচারে কোনও দেওয়াল লিখন না-করার নির্দেশ দলের নেতাদের দিয়েছেন মমতা। ঠিক যে ভাবে তিনি নিজেও বন্ধ বা অবরোধের রাজনীতি থেকে গত প্রায় তিন বছর সরে এসেছেন। এমনকী, তাঁর তৎকালীন জোটসঙ্গী এসইউসিআই বন্ধ ডাকলেও তা সমর্থন করেননি!
বিরোধী নেত্রী থাকার সময়েই মমতার সম্যক ‘উপলব্ধি’ হয়েছিল যে, বন্ধ এবং অবরোধে সাধারণ মানুষ নাকাল হন এবং ওই ধরনের আন্দোলনে জনসমর্থন মেলে না। যে কারণে তিনি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ‘অনুমতি’ ছাড়া রাজ্যের কোথাও বন্ধ-অবরোধের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। ‘প্রশাসক’ হওয়ার পর মমতার সেই উপলব্ধি স্বভাবতই আরও জোরালো হয়েছে। ঘনিষ্ঠ মহলে যে কারণে তিনি একাধিক বার বলেওছেন, “পশ্চিমবঙ্গ মানেই সেখানে যখন-তখন সব কিছু অচল হয়ে যায় এই ধারনাটা ভাঙতে হবে! সারা দেশকে এবং দেশের বাইরেও এই বার্তা দিতে হবে যে, রাজ্যটা সচল রয়েছে! আর কাজের দিন ধর্মতলার মোড়ে মিটিং-মিছিল করে সাধারণ মানুষকে নাকাল করে কি কোনও আন্দোলন হয়? নাকি তেমন আন্দোলনকে মানুষ সমর্থন করেন?” দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “আমাদের নেত্রীর আশা, মুখে বললেও আচমকা বন্ধ বা অবরোধের রাজনীতি যে এখন অচল, তা সিপিএমের নেতারাও বোঝেন। আর তাঁদের যদি সমাবেশ করার জন্য কোনও একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, তাতে তো আপত্তি করার কিছু আছে বলে মনে হয় না!” একই ভাবে, তৃণমূলের নেতাদের অধিকাংশের আশা, কলকাতাকে রাজনৈতিক হোর্ডিং-মুক্ত করার বিষয়েও দলগুলি একমত হবে। এক নেতার কথায়, “এখন তো প্রচারের বিভিন্ন মাধ্যম হয়েছে। আর সিপিএমের নেতারা তো ফেসবুক বা ওই ধরনের মাধ্যমে প্রচারে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ। বিশাল বিশাল হোর্ডিং টাঙিয়েই কি প্রচার করতে হবে?”
ঘটনাচক্রে, যে মেট্রো চ্যানেলে সভা-সমাবেশে নিষিদ্ধ করতে চেয়ে মমতা উদ্যোগী হচ্ছেন, সেখানেই সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে এক টানা ২৬ দিন অনশন করেছিলেন তিনি নিজেই! সে সময়ে ধর্মতলায় যানজট ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। মমতা সেখানেই সমাবেশে বন্ধে উদ্যোগী হচ্ছেন জেনে তাঁর দলের এক সাংসদ মুখ্যমন্ত্রীকে বলার চেষ্টা করেছিলেন, ওই জায়গাটি মমতার কাছে ‘স্মৃতি-বিজড়িত’। কারণ ওখানে অনশন থেকেই তাঁর ‘রাজনৈতিক উত্থান’। কথা শেষের আগেই তাঁকে থামিয়ে দিয়েছেন মমতা।
এখন তিনি ‘প্রশাসক’। |