চুক্তি হলে কোন খাতে বইবে ‘জীবনরেখা’?
উত্তরবঙ্গকে ‘নতুন করে’ গড়তে চেয়ে যে উন্নয়ন ভাবনা নিয়ে এগোচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেখানে তিস্তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু চাষবাসেই এই নদীর ভূমিকা সীমাবদ্ধ নেই। পানীয় জল থেকে পর্যটন, চা শিল্প থেকে পাট, হিমঘর থেকে ছোট কারখানা প্রায় সবেরই ভরসা তিস্তা। নদী বিশেষজ্ঞেরা তাই তিস্তাকে বলছেন উত্তরবঙ্গের ‘লাইফ লাইন’। জীবনরেখা। এলাকার শিল্পমহল বলছে, শিল্প বাড়লে তিস্তার গুরুত্ব আরও বাড়বে। তাই নতুন জলবণ্টন চুক্তির পরে তার জল কখন, কী ভাবে বিলি হবে, তা নিয়ে এই মুহূর্তে উত্তরবঙ্গ জুড়ে কৌতূহল তূঙ্গে।
বিশেষত, মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর বাতিল হওয়ার খবরে জল্পনার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে উদ্বেগও। আশঙ্কা, এই চুক্তির ফলে আগামী দিনে উত্তরবঙ্গের পাহাড় থেকে ডুয়ার্স, তরাই থেকে ইসলামপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ গুরুতর সমস্যায় পড়বেন না তো? তিস্তা সেচ প্রকল্প সূত্রেই জানা যাচ্ছে, প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে আটকে থাকা প্রকল্পটির কাজ দ্রুত শেষ করার উপরে জোর দিয়েছে সদ্য ক্ষমতায় আসা তৃণমূল জোট সরকার। ওই প্রকল্প সম্পূর্ণ হলে যে বিপুল পরিমাণ সেচ ও পানীয়
জল প্রয়োজন হবে, তা ভারতে ধরে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি বলে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন। এর মধ্যেই বিষয়টি মহাকরণেও
জানানো হয়েছে।
যেমন, উত্তরবঙ্গের অন্যতম নদী বিশেষজ্ঞ সুবীর সরকার বলেন, “আন্তর্জাতিক নদী হলেও তিস্তা যে হেতু উত্তরবঙ্গের ‘লাইফ লাইন’, তাই এর জল নিয়ে চুক্তি করার আগে বহু বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া দরকার।” যেমন? সুবীরবাবুর বক্তব্য, “তিস্তা সেচ প্রকল্পের কাজ বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ করলে যে পরিমাণ জল প্রয়োজন হবে, তা ধরে রাখাটা নিশ্চিত করা জরুরি। তা ছাড়া নানা কারণে সিকিম ও দার্জিলিং হিমালয়ের জলবায়ুর বিচিত্র পরিবর্তন হচ্ছে। তিস্তায় জলপ্রবাহও কমছে। চুক্তির সময়ে এ সব বিষয় মাথায় রাখা জরুরি।” এর পরেই সতর্ক করে দিয়ে সুবীরবাবু বলেন, “না হলে আগামী দিনে এই প্রাণরেখা শীর্ণ হয়ে পড়লে তার জল ভাগাভাগি করা নিয়ে অনেক সমস্যা তৈরি হতে পারে।”
চুক্তির প্রাক্কালে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় উঠে আসছে। তা হল, উত্তরবঙ্গের পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সে নানাবিধ শিল্প ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে তাকে ‘সুইৎজারল্যান্ড’-এর আদলে গড়ার কথাও বারেবারেই বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সে সব শিল্প-প্রকল্প গড়ার ক্ষেত্রে জলের জন্য কিন্তু মূলত তিস্তার উপরেই নির্ভর করতে হবে। তাই শিল্পমহল মনে করছে, মুখ্যমন্ত্রীর ওই ঘোষণা বাস্তবায়নের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা যাতে আগামী দিনে তিস্তা জল চুক্তির জন্য কোনও ভাবে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, সেটাও ভাবতে হবে।
|
ফেডারেশন অফ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, নর্থ বেঙ্গলের (ফোসিন) সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, “কোচবিহার থেকে জলপাইগুড়ি, মালবাজার থেকে কালিম্পং, শিলিগুড়ি থেকে রায়গঞ্জ, বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচুর শিল্প তৈরির প্রস্তাব শুনতে পাচ্ছি। তা বাস্তবায়িত হলে প্রচুর জল লাগবে। যা কি না একমাত্র তিস্তা ক্যানাল থেকেই মিলতে পারে। সে জন্য আগুপিছু ভেবেই সব হওয়া জরুরি।”
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিভাগ সূত্রের খবর, গত দু’দশকে তিস্তার জলপ্রবাহ অনেকটাই কমেছে। অববাহিকা এলাকায় ভূমিক্ষয় বেড়েছে। উত্তরবঙ্গের অভয়ারণ্য ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সিংহভাগই তিস্তার উপরে নির্ভরশীল। তিস্তার জলধারণ ক্ষমতা বাড়াতে রাজ্য সরকারকে নিয়মিত নানা খাতে বহু কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। আগামী দিনে ওই খরচের পরিমাণ আরও বাড়বে। তিস্তার জল চুক্তি হলে বাংলাদেশের যে পরিমাণ জল পাওয়ার কথা, তা তাকে দিতেই হবে। সে ক্ষেত্রে জলধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর খরচ ভাগাভাগি কী ভাবে হবে, সেই বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আরও একটি বিষয় নিয়ে চিন্তিত নদী-বিজ্ঞানীরা। তা হল, নানা বাধায় মুলতুবি হয়ে থাকা ব্রহ্মপুত্র-লিঙ্ক ক্যানাল প্রকল্পের কাজও শীঘ্রই শুরু হবে। ওই প্রকল্পে ব্রহ্মপুত্রের জল তিস্তার মাধ্যমে গঙ্গায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তাতে গঙ্গার নাব্যতা বাড়বে। ব্রহ্মপুত্রর জল তিস্তায় এসে মিশলে স্বাভাবিক ভাবেই তিস্তায় জলের পরিমাণ বেড়ে যাবে। সেই সময়ে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির ফলে বাংলাদেশ আরও বেশি পরিমাণে জলের দাবি উঠলে তা সামাল দেওয়ার বিষয়টি চুক্তিতে কী ভাবে রয়েছে, তা নিয়েও আগ্রহী বিশেষজ্ঞরা।
|