রাজ্যের ‘স্বার্থে’র কথা বলে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি
থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরে দাঁড়ানোয় আর এক প্রস্ত ‘বিড়ম্বনা’য় পড়ল সিপিএম!
তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে বাংলাদেশ সফর থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ‘রাজনৈতিক প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে’ মমতা দ্রুত ধরে ফেলেছেন রাজ্যের জনতার মন। স্বভাবতই সেই প্রশ্নের বিরোধিতা করা সম্ভব হচ্ছে না সিপিএমের পক্ষে। মনমোহনের সঙ্গে বাংলাদেশ গিয়ে মমতা তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি করে এলে পরে সিপিএম মমতার বিরুদ্ধেই রাজ্যের ‘বঞ্চনা’র অস্ত্র ব্যবহার করতে পারত। অভিযোগ তুলতে পারত, মমতা নিজের রাজ্যের ‘স্বার্থ’ দেখলেন না। কিন্তু মমতা রাজ্যের সেই স্বার্থের কথাই আগাম তুলে বিষয়টি থেকে সরে দাঁড়ানোয় সেই সুযোগ পাচ্ছে না সিপিএম। বরং, রাজনৈতিক তাগিদে বাম আমলে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে না-এগোনো এবং জ্যোতি বসুর আমলে রাজ্যের স্বার্থ পুরোপুরি না-দেখেই গঙ্গার জলবণ্টন নিয়ে চুক্তি সংক্রান্ত প্রশ্ন সামলাতে হচ্ছে সিপিএমকে।
বিষয়টির মধ্যে ‘বিড়ম্বনা’ আছে বুঝেই দিল্লিতে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট রবিবার তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে বিশেষ মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, তিস্তা চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বিজেপি-র সঙ্গে আলোচনা করেছে। সিপিএমের সঙ্গে করেনি। চুক্তিতে কী আছে, তা না-জেনে কিছু বলা সম্ভব নয়। জলবণ্টন, ট্রানজিট খুলে দেওয়ার মতো বিষয়ে বাম-শাসিত রাজ্য ত্রিপুরার স্বার্থও জড়িত এবং স্বভাবতই সিপিএমের পক্ষে এর থেকে হাত ধুয়ে ফেলা সম্ভব নয়। কারাট অবশ্য সে সবের মধ্যে যাননি। সিপিএম ভেবেছিল, পশ্চিমবঙ্গের নতুন সরকার কী চুক্তি করে, দেখে নিয়ে তবে তারা এই নিয়ে ময়দানে নামবে। কিন্তু মমতার পদক্ষেপে সেই ‘কৌশল’ খাটল না বলেই রাজনৈতিক শিবিরের অভিমত। ‘বিড়ম্বনা’ সামাল দিতে রাজ্য সিপিএম অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন তুলছে, মমতা সরে দাঁড়ালেই কি রাজ্যের স্বার্থ বজায় থাকবে? মমতার ‘আপত্তি’র পরেও চুক্তি করে আসা তো প্রধানমন্ত্রীর এক্তিয়ারভুক্ত!
কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রশাসনিক মহলের একাংশের মতে, বিধানসভা
নির্বাচনের আগে এ রাজ্যে, বিশেষত উত্তরবঙ্গের ভোটব্যাঙ্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে আশঙ্কা করেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার শেষ পর্যন্ত জলবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু সিপিএমের ব্যাখ্যা, জলবণ্টন নিয়ে জটিলতার কারণ ‘রাজনৈতিক’ নয়। বিষয়টি ছিল ভৌগোলিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনায় এই নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি বিগত বাম সরকার। তিস্তাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের চলতি প্রকল্পগুলির জন্য পর্যাপ্ত জলের সরবরাহ নিশ্চিত করে তবেই বাংলাদেশের সঙ্গে জলবণ্টন চুক্তি করা উচিত বলে মনে করে সিপিএম। তাদের দাবি, এই বিষয়টি নিয়ে ফয়সালা না-হওয়ার জন্যই বামফ্রন্ট সরকারের জমানায় বহু বার আলাপ-আলোচনা হয়েও শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি হয়নি।
বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার যে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে বাংলাদেশ সফর থেকে সরে দাঁড়ালেন, সেই একই প্রশ্ন ছিল সিপিএমেরও। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে সিপিএম এবং মমতার অবস্থানে বিশেষ ফারাক নেই। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, “তিস্তা প্রকল্পকে জাতীয় প্রকল্প হিসাবে ঘোষণার দাবি আমাদের ছিল বহু দিনের। শেষ পর্যন্ত আমরা যখন ইউপিএ-র সমর্থক ছিলাম, সেই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার ওই দাবি মেনে নেয়। এর পরে চালু প্রকল্পগুলির জন্য জলের সরবরাহ বজায় রাখাই অগ্রাধিকার ছিল। বাংলাদেশ জল পাক, তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এ দিকে চালু প্রকল্পগুলি ব্যাহত করে কিছু করা কী ভাবে সম্ভব?” মমতার প্রশ্ন রাজ্যের এই স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়া নিয়েই। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ঠিক কী আলোচনা হয়েছিল এবং কোন জায়গায় সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা না জেনে বাইরে থেকে সেই ব্যাপারে মতামত দেওয়া সম্ভব নয় বলে করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সতর্ক তারা। প্রকাশ্যে অন্তত সকলেই মন্তব্য এড়িয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে বিরোধীরাও চুপ। তাদের তরফে রাত পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। মমতার সফর বাতিলের খবর শুনে হতাশ সাধারণ মানুষও।
ঢাকার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসবে শুনে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় জ্যোতি
বসু ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচক্ষণতা ও দক্ষতা তাঁদের দুই বাংলায় জনপ্রিয়তা দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদ ও সীমান্ত সমস্যা মেটাতে দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় মমতার ভূমিকা ও উপস্থিতি খুবই জরুরি ছিল।” এক সরকারি কর্তার কথায়, “ মমতা দিদি এলে না এলে ছিটমহল হস্তান্তর নিয়ে যে আশা দেখা দিয়েছে, তা ধাক্কা খেতে পারে।”
|