অণ্ণা হজারে পর্বের পরে ফের বিপাকে মনমোহন সিংহের সরকার।
আজ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ মারফত প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়কে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি প্রস্তাবিত ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির বিরোধী। ফলে আগামী মঙ্গলবার তাঁর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে ঢাকা যাওয়া সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরেই তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হওয়ার কথা।
মমতার বক্তব্য, তিনি বাংলাদেশের বিরোধী নন। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও অত্যন্ত মধুর। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যবাসীর স্বার্থ দেখা তাঁর অগ্রাধিকার। মমতার এই ‘বিদ্রোহের’ পরে কংগ্রেসের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, অণ্ণার পরে আরও এক বার দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ব্যর্থ। পূর্ব নির্ধারিত সূচি মেনে মনমোহন ৬ তারিখ বাংলাদেশ যাবেন ঠিকই। মমতার আপত্তি সত্ত্বেও তিস্তা-চুক্তিও করবেন। কিন্তু গোটা বিষয়টির উপরে যে একটা কালো ছায়া পড়ে গেল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা ছাড়া, জল যখন পশ্চিমবঙ্গ থেকেই বাংলাদেশে যাবে, তখন মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির পর চুক্তি কতটা কার্যকর হবে, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।
আজ প্রায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মমতার বার্তা আসে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। আর তার পরেই শোরগোল পড়ে যায়। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে বোঝানোর চেষ্টা করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ-সহ অনেকেই। মমতাকে বলা হয়, তাঁর আশঙ্কা অমূলক। এই চুক্তির ফলে রাজ্যের স্বার্থ কোনও ভাবেই ক্ষুণ্ণ হবে না। কিন্তু সেই যুক্তি মমতা মানেননি। |
রাজ্য সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন মমতার সঙ্গে বৈঠকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, চুক্তির চূড়ান্ত খসড়ায় তা মানা হয়নি। রাজ্য সরকার প্রাথমিক ভাবে যে পরিমাণ জল দিতে চেয়েছিল, মমতা-মেনন আলোচনার পর তার থেকে কিছু বেশি জল দেওয়ার ব্যাপারে দু’পক্ষ সহমত হয়। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় দেখা যাচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি জল দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে। কেন্দ্রের অবশ্য যুক্তি, এই জল আসবে সিকিমের বরাদ্দ থেকে। যা মানতে মমতা নারাজ।
মমতার আরও অভিযোগ, তিস্তা-চুক্তি নিয়ে কেন্দ্র তাঁর সঙ্গে প্রায় কোনও আলোচনাই করেনি। গোড়ায় চুক্তির খসড়াও দেখানো হয়নি। অথচ এর আগের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের সঙ্গে তাদের সবিস্তার আলোচনা হয়েছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত বুদ্ধবাবুকে বুঝিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। দু’দেশের স্টিয়ারিং কমিটির বেশ কয়েক দফা বৈঠকের পরে জলবণ্টন সূত্র মেনেও নিয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু নির্বাচন এসে পড়ায় তা ঘোষণা করা হয়নি। (যদিও সিপিএম নেতারা এ কথা মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, জলবণ্টন নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁদের সরকারের ঐকমত্যই হয়নি।) অনেকের মতে, এই জলবণ্টনের বিরূপ প্রভাব ভোট-বাক্সে পড়তে পারে বলে বামফ্রন্টেরও আশঙ্কা ছিল।
তিস্তা-চুক্তি নিয়ে মমতার সঙ্গে প্রথম থেকেই
আলোচনা না করাটা যে সরকারের মস্ত ভুল, তা স্বীকার করছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই। বস্তুত, এই চুক্তির বিষয়ে মমতা জানতে পারেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর কাছ থেকে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনীতি বিষয়ক কমিটির বৈঠকের আগে দীনেশের কাছে পাঠানো অজস্র কাগজের মধ্যে তিস্তা-চুক্তিও ছিল। দীনেশ সেটি দেখে মমতাকে সবিস্তার জানান। মমতা তাঁকে বলেন, এর ফলে রাজ্যের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। অতএব আপনি কমিটির বৈঠকে সরব হোন।
বৈঠকে দীনেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রণববাবুর তীব্র কথা কাটাকাটি হয়। প্রণববাবু দীনেশকে বলেন, এর ফলে রাজ্যের বঞ্চিত হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া, আপনি আন্তর্জাতিক চুক্তির বিষয়টি বুঝতেই পারছেন না। এটা একটা জাতীয় বাধ্যবাধকতা। দীনেশও পাল্টা বলেন, এত জল দিলে রাজ্যের ক্ষতিই হবে। আর বিষয়টা যদি জাতীয় স্বার্থে এক তরফা ভাবে কেন্দ্র করতে চায়, তা হলে আপনারা বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে রেখেছেন কেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই চুক্তি মানতে পারবেন না। আর তৃণমূলের মন্ত্রী হিসেবে আমি এর প্রতিবাদ করবই।
অবস্থা বুঝে এর পর দিনই শিবশঙ্কর মেননকে মমতার সঙ্গে কথা বলতে পাঠান প্রধানমন্ত্রী ও প্রণববাবু। মেনন মমতাকে বলেন, আগে চুক্তিটা হয়ে যাক। তার পর আপনি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে আপনার আপত্তির কথা জানাবেন। বলবেন এতটা জল দেওয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রীও আপনাকে চিঠি দেবেন। গোটা বিষয়টা তখন ঠিক হবে। কারণ, এটা একটা অন্তর্বর্তী চুক্তি। মমতা তাতে রাজি হননি। তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে তো আপনারা চুক্তিটাই সৎ ভাবে করছেন না। তখন জলবণ্টন নিয়ে মেনন ও মমতার মধ্যে একটা রফা হয়েছিল বলে রাজ্য সরকারি সূত্রের দাবি। যে রফা শেষপর্যন্ত মানা হয়নি বলেই তাদের অভিযোগ। |
গত কাল চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া দেখার পরে মমতা যখন বেঁকে বসেন, তখন বাংলাদেশের তরফেও তাঁকে বোঝানোর একটা চেষ্টা হয়। মমতার কালীঘাটের বাড়িতে শেখ হাসিনার চিঠি নিয়ে আসেন তাঁর এক দূত। সেই চিঠিতে জল-চুক্তি নিয়ে মমতার সাহায্য প্রার্থনা করেন হাসিনা। মমতা হাসিনার প্রতিনিধিকে বোঝান, তিনি বাংলাদেশের বিরোধী নন। রেলমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভারত-বাংলাদেশ যোগসূত্র বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের সুবিধার জন্য বনগাঁ থেকে অজমের শরিফ পর্যন্ত ট্রেন চালু করেছেন। কিন্তু এই বিষয়টা তাঁর রাজ্যের স্বার্থ সম্পর্কিত।
এই পরে জয়রাম রমেশের সঙ্গেও মমতার বৈঠক হয়। সেখানে জমি নীতির পাশাপাশি জলবণ্টন প্রসঙ্গও ওঠে। মমতা জয়রামকে বলেন, আপনারা কাবেরীর জলবণ্টন নিয়ে তিনটে রাজ্যের বিবাদ মেটাতে পারছেন না। অথচ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দোহাই দিয়ে আমাকে তিস্তা চুক্তি মেনে নিতে চাপ দিচ্ছেন। তা ছাড়া, শ্রীলঙ্কার সমস্যা নিয়ে তো আপনারা ডিএমকে-র সঙ্গে আলোচনা করেন। তা হলে এই চুক্তি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন না কেন?
দূত মারফৎ প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এই একই অনুযোগ জানিয়েছেন মমতা। তিনি বলেছেন, গঙ্গা চুক্তির সময় তৎকালীন দেবগৌড়া সরকার পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেছিল। এ বারে তা করা হল না কেন! মমতার অবশ্য অভিযোগ, গঙ্গা চুক্তির ফলে আখেরে রাজ্যের ক্ষতিই হয়েছে। যে হেতু উজানে উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের জল টেনে নেওয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয় না, সে হেতু বাংলাদেশকে জল দিতে গিয়ে ফরাক্কায় জল থাকে না। জলের অভাবে হলদিয়া বন্দর মরতে বসেছে। এমনকী, ড্রেজিংয়ের টাকাও চেয়ে চেয়ে কেন্দ্রের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। এখন আবার তিস্তার ক্ষেত্রে সেই একই কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে, যা তিনি কোনও অবস্থাতেই মানবেন না। গত কাল ঢাকায় মেননের উপস্থিতিতে তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। দিল্লি চেয়েছিল রাজ্যের সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া সেখানে উপস্থিত থাকুন। কিন্তু মমতা তাঁকে যেতে দেননি। |
জল বণ্টন প্রস্তাব |
রাজ্য-কেন্দ্রের আলোচনায় সিদ্ধান্ত জল ছাড়া হবে ২৫০০০ কিউসেক
|
চূড়ান্ত খসড়া চুক্তিতে |
জল ছাড়া হবে কার্যত ৩৩০০০ কিউসেক রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ |
উজানের দেশ (এখানে ভারত) কখনওই এতটা জল নিতে পারবে না, যাতে ভাটির দেশে
(এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ) পরিবেশ, প্রকৃতি, বাস্তুতন্ত্র, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই সনদ
মানলে জলবণ্টনের আনুপাতিক হার অনুযায়ী ১৬% জল পাওয়ার যোগ্য বাংলাদেশ। |
|
গত কাল রাতে কলকাতা থেকে দিল্লি ফিরেই প্রধানমন্ত্রীর সচিব জয়দীপ সরকারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন রমেশ। মেননের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়। কথা হয় সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেলের সঙ্গেও। ঢাকা থেকে মেনন আবার ফোন করেন রাজ্যের মুখ্যসচিবকে। কিন্তু জটিলতা কাটেনি।
তিস্তা চুক্তি নিয়ে উত্তরবঙ্গের কিছু কিছু এলাকায় ইতিমধ্যেই বিক্ষোভের ইঙ্গিত দেখা দিতে শুরু করেছে। তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, সেই বিক্ষোভের খবর পেয়েই মমতা আঁচ করেছিলেন, চুক্তিতে কোথাও একটা গোলমাল রয়েছে। আর বিপদ আগাম আঁচ করতে পারার সেই ক্ষমতাই তাঁকে আরও একটা ‘বিপর্যয়’ থেকে রক্ষা করল।
|