সময়টা দুপুর সাড়ে বারোটা। কষ্ট বুকে চেপে রেখে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে দিল্লির ফুটবল হাউসে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর ঘোষণা করলেন ভাইচুং ভুটিয়া। একটাই দুঃখ, বিশ্বকাপে নিয়ে যেতে পারলেন না ভারতকে।
কেন অবসর? বিষণ্ণ কন্ঠে ভাইচুং জানিয়ে দিলেন, এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ জিতে ভেবেছিলেন এশিয়া কাপ খেলেই অবসর নেবেন। কিন্তু চোটের জন্য কোরিয়ার বিরুদ্ধে মাত্র ১৫ মিনিট খেলে তৃপ্তি পাননি। তার পর ৮-৯ মাস ধরেই অবসর নেওয়ার কথা নিয়ে ভেবেছেন। পরে ভাবলেন, ইংল্যান্ডে গিয়ে ভারতের হয়ে খেলার পরই অবসর নিয়েই নেবেন। কিন্তু কাফ মাসলের চোট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অবসর নিয়ে ভাবতে শুরু করেন।
ভারতের হয়ে ১৬ বছর খেলে ভাইচুংয়ের মনে হচ্ছে রুস্তম আক্রামভ তাঁকে মিডফিল্ডার থেকে ফরোয়ার্ড লাইনে তুলে না আনলে ফরওয়ার্ডে এই সাফল্যটা পেতেন কি না সন্দেহ। তাজিকিস্তানের বিরুদ্ধে গোলটাকে সেরা বলার পরে, উজবেকিস্তানের বিরুদ্ধে দুটি গোল ও শ্রীলঙ্কা ম্যাচে গোলের কথা বললেন। আর ঘরোয়া খেলায় সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার হয়ে পঞ্জাবের বিরুদ্ধে ব্যাকভলির গোলটিকে শ্রেষ্ঠ গোল বলে মনে করেন ভাইচুং। |
ভাইচুংয়ের তৃপ্তি, আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিলেও মাঠ থেকে তাঁকে সরে যেতে হচ্ছে না। সিকিম ইউনাইটেডের কর্তা ও খেলোয়াড় হিসাবে রোজই তিনি মাঠে আসবেন। পাশাপাশি ফেডারেশনকে তরুণ ফুটবলার তুলে আনার জন্য সব সাহায্য করবেন। তবে কোনওমতেই এখন ফেডারেশনের প্রশাসনে যোগ দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন ভাইচুং। প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক বললেন “কোনও দিন ভাবিনি সিকিম ছেড়ে প্রথমে ইস্টবেঙ্গলে ও পরে ভারতের হয়ে খেলব। আইকন হব সেটা তো কোনও দিনই ভাবিনি। আমি সেই ব্যাপারে সত্যি খুব ভাগ্যবান।” তাঁর কথায়, “খেলোয়াড়জীবনের শেষ দু’তিন বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দু’তিন বছরে ভারতের ফুটবল অনেকটাই এগিয়েছে। যেটা গত দশ বছরেও হয়নি বলে আমি মনে করি। আর আমি থাকি বা না-ই থাকি যে ভাবে ফেডারেশনের উন্নয়নের ফসল জেজে, রাজু গায়কোয়াড ও লালরেম ডিকারা উঠে আসছে, আমার মনে হয় ভারতীয় ফুটবল ঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।”
|
এগারোতেই খেলাব |
|
বাইশ জনে থাকবে |
অমল দত্ত: ভাইচুংয়ের গতি, হেডিং দারুণ ছিল না। কিন্তু সিক্সথ সেন্স ছিল, বলের কাছাকাছি পৌঁছে যেত। ফলোআপটা অসাধারণ। কেউ যদি হেমন্ত-মান্নার মতো না হয়েও তাঁর গলায় নিখুঁত গান গায়, তা হলে তাকে ভাল বলতেই হবে। যে করেই গোল করুক, গোল হল গোল। আমি তাই ভাইচুংকে সেরা এগারোয় রাখব। আগে ওকে রাখতাম না। এখন রাখব। ওর গোলক্ষুধা, ম্যাচ রিডিং আর দীর্ঘ দিনের ধারাবাহিকতার জন্য। বলরাম আর ভাইচুং হবে আমার স্ট্রাইকার জুটি। চুনী, পিকে মাঝমাঠে। বিজয়ন প্রতিভাবান বেশি, কিন্তু চাপ নিতে না পেরে আগেই ছেড়ে দিয়েছে। ভাইচুং পালায়নি। গণ্ডগ্রাম থেকে এসে কত উপরে উঠল, ভাবা যায় না! |
প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়: সব অর্থে আইকন। ফুটবলার হিসেবে বিজয়ন, আনচেরি একটু এগিয়ে থাকবে। কিন্তু নেতা হিসেবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে ভাইচুং। নিষ্ঠা দিয়ে ও সব সতীর্থকে প্রভাবিত করেছে। ওর বড় গুণ, কখনও হারে না। সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এখনও ওর পর্যায়ে কোনও ফুটবলার ছিল না। সর্বকালের সেরা ভারতীয় দলে কোথায় থাকবে ভাইচুং? আামার ১৮ জনে থাকবে না। |
সেখানে স্ট্রাইকার হিসেবে ইন্দর, নেভিল ডি’সুজা, শ্যাম, সুভাষকে রাখব। চুনী, বলরাম তো স্বপ্নের ব্যাপার। মেওয়ালাল, নায়ারকে আগের প্রজন্ম বলে ধরছি না। ভাইচুং বরং ২২ জনের দলে থাকবে। আকবর ওর থেকে এগিয়ে। সাব্বির গায়ে গায়ে। |
|
অবসর নেওয়ার সময় থেকে যতক্ষণ ফেডারেশন অফিসে ছিলেন ততক্ষণ তাঁর মুখে ছিল বিজয়নের নাম। “আমার দেখা সেরা ভারতীয় ফুটবলার।” তাঁর সেরা দলে বন্ধু রেনেডি সিংহকে না রেখে লেফট মিডফিল্ডার হিসেবে রেখেছেন সাব্বির পাশাকে। ইংল্যান্ড সফরের অধিনায়ক রেনেডি ছিলেন ভাইচুংয়ের পাশে। সঙ্গে দুই কোচ সুখবিন্দর সিংহ ও তনুময় বসু। বলছিলেন, “জন্মগত নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। মাঠের বাইরেও ও নেতা। দুর্দান্ত টিমমেট, মোটিভেটর। ভেবেছিলাম, আরও ক’দিন খেলবে। কিন্তু চোটটা শেষ করে দিল।” মাস দুয়েক আগেই নতুন জাতীয় কোচ কোলাসো বিতর্ক তৈরি করেন, ফুটবলারদের দাম বেঁধে দেওয়ার কথা বলে। ভাইচুংও কিন্তু সেই কথা বললেন। “ইউরোপ-ব্রাজিলের মতো আমাদের ক্লাবগুলোর সঙ্গে খেলোয়াড়দের চুক্তি হওয়া উচিত। তাই ফেডারেশনের সঙ্গে খেলোয়াড়রা মউ-সই করবে। প্রয়োজনে খেলোয়াড়দের দাম বেঁধে দেওয়া উচিত।” ভারতের ক্লাবগুলো ফুটবলার তুলে আনার জন্য ভাবে না, এটা ভাবাচ্ছে তাঁকে। “ক্লাবগুলোকেও এই কাজে বাধ্য করা উচিত। যত দিন না ক্লাবগুলো নিজেরা ফুটবল তুলে আনতে পারবে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলে স্থানীয় খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমতে থাকবে। এ ব্যাপারে ক্লাব ও ফেডারেশন একসঙ্গে বসাটা খুব জরুরি।” বিশ্বকাপে না খেলার জন্য তো আফসোস করছেন, অলিম্পিক মশাল বহন না করার সিদ্ধান্তে কোনও আফসোস নেই? ভাইচুং বলে গেলেন, “আমি নিজে বৌদ্ধ। তিব্বতের উপর অবিচার হচ্ছে। সে জন্যই আমি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এ জন্য আফসোস নেই।” |