|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
বন্ধ ও গণতন্ত্র |
বন্ধ-এর রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে পশ্চিমবঙ্গ হইতে নির্বাসিত করিতে চাহেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য বিধানসভায় দাঁড়াইয়া তিনি এই ঘোষণা করার পাশাপাশি এই প্রশ্নে সর্বদলীয় ঐকমত্যেরও আহ্বান জানাইয়াছেন। কথায় কথায় বন্ধ ডাকা এবং পালন করা যে-রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সেখানে ইহা একটি ঐতিহাসিক এবং নজিরবিহীন ঘটনা। স্বাগত সুলক্ষণ, সন্দেহ নাই। বস্তুত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু কাল যাবৎই বন্ধ-অবরোধের মতো কর্মনাশা, বন্ধ্যা রাজনীতির বিরুদ্ধে মুখর হইতেছিলেন। গত দুই বছর ধরিয়া তিনি বা তাঁহার দল রাজ্যে কোনও বন্ধ ডাকেনও নাই, যদিও সেই সময়ের অধিকাংশই তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী পক্ষে ছিল এবং শাসক বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নানা উপলক্ষও রচিত হইয়াছিল। এমনকী রাজনৈতিক জোটসঙ্গী এস ইউ সি তাহার ডাকা বন্ধ-এ তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থন চাহিলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবিনয়ে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। তবু হয়তো কর্মবিরতি পালনের প্রবণতা হইতে তিনি এখনও সম্পূর্ণ মুক্ত নহেন, বাইশে শ্রাবণ উদ্যাপনজনিত ক্লেশ অপনোদনের যুক্তিতে পর দিন ছুটি ঘোষণার মধ্যে যে-প্রবণতার ছায়া আছে।
বলিলে বিশেষ ভুল হইবে না যে, বন্ধ বস্তুটি এক অর্থে বাঙালির নিজস্ব ব্রত। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে যে নিষ্ঠার সহিত এই ব্রত পালিত হইয়া থাকে, তাহার তুলনা ভূভারতে বিরল। ইহা বাঙালির গৌরব নহে, লজ্জা। কারণ, বন্ধ একটি অগণতান্ত্রিক ‘আন্দোলন’। ইহা জনসাধারণের অভিপ্রায়-নিরপেক্ষ, সর্বদাই রাজনৈতিক দল কর্তৃক জনসাধারণের উপর জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া একটি নিরুপায়, নিষ্ফল কর্মনাশের আয়োজন। প্রায়শ দলীয় বাহিনীর রাজনৈতিক গুণ্ডামি ও আস্ফালন জনসাধারণকে গৃহবন্দি করিয়া বন্ধ-এর সাফল্য উদ্যাপন করিয়া থাকে। প্রধানত বামপন্থীরা বিরোধী পক্ষে থাকার সময় এবং পরবর্তী সাড়ে তিন দশকের দীর্ঘ ক্ষমতাভোগের কালে বন্ধ-এর উদ্যাপনকে পৌনঃপুনিক অনুশীলনে একটি সূক্ষ্ম শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করিয়াছিলেন, যাহাতে সরকারে থাকিয়াও বন্ধ ডাকা যায় এবং সরকারি প্রশাসনকেও তাহা সফল করার কাজে ব্যবহার করা যায়। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতও জোর করিয়া জনসাধারণের উপর বন্ধ চাপাইয়া দেওয়াকে ‘অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়াছে। তাই বন্ধ নিষিদ্ধ হইলে তাহাকে গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ বলিয়া প্রতিবাদ জানাইবার অবকাশও নাই, কেননা জনগণের বন্ধ-এ শামিল না-হওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকারকে তাহা লঙ্ঘন করে। এবং কে, কোথায়, কবে জনসাধারণের অনুমোদনসাপেক্ষে বন্ধ ডাকিয়াছে?
ধর্মঘট গুণগত ভাবে বন্ধ হইতে পৃথক। কলকারখানায় বা শিল্পে ধর্মঘট করার অধিকারও সংবিধান-স্বীকৃত। কিন্তু এ দেশে যে-ভাবে কথায় কথায় ধর্মঘট ডাকা হয়, তাহা কি সমর্থনযোগ্য? প্রথমত, কোনও শিল্পে বা কলকারখানায় একটি ইউনিয়ন নাই। সাত জন শ্রমিক-কর্মী নথিভুক্ত হইয়াই যেহেতু একটি ইউনিয়ন গড়িতে পারে, তাই প্রতি কারখানায় ইউনিয়নের ছড়াছড়ি। দ্বিতীয়ত, যে কোনও একটি ইউনিয়ন ধর্মঘটের বিজ্ঞপ্তি জারি করিয়া কারখানার গেটে বসিয়া গেলেই তাহা ধর্মঘট হইবে কেন? অধিকাংশ শ্রমিক-কর্মচারী যেখানে কাজে যোগদানে ইচ্ছুক, সেখানে মুষ্টিমেয় ইউনিয়নবদ্ধ কর্মীর যূথশক্তি কোন যুক্তিতে কারখানার গেটে তালা ঝোলায়? তৃতীয়ত, কোনও শিল্পে ধর্মঘট করিতে হইলে অধিকাংশ (অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ পরিমাণ) শ্রমিকের আগাম সায় তাহাতে আবশ্যক হওয়া উচিত। অন্যথায় ধর্মঘটের সিদ্ধান্তই অনৈতিক। তাহার আগে ধাপে-ধাপে শ্রমিক-কর্মীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া লইয়া আন্দোলন হওয়া চাই। সর্বশেষ, প্রথমেই ধর্মঘট নয়, আর সব আন্দোলন ও দরকষাকষির পদ্ধতি ব্যর্থ হইলে একেবারে অন্তিম অস্ত্র হিসাবেই কেবল ধর্মঘটের আশ্রয় লওয়ার প্রশ্ন। আর বন্ধ-এর মতোই সেই ধর্মঘটও হউক আন্দোলনকারীদের মর্জিমাফিক নয়, তাহার দ্বারা প্রভাবিত হইবে, এমন জনসমষ্টির সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমোদনসাপেক্ষে। এ জন্য আইনের সংশোধন জরুরি। অবিলম্বে। |
|
|
|
|
|