|
|
|
|
দিনভর বৈঠকেও রফাসূত্র অধরা, রাতে তিক্ততা হজারের স্বাস্থ্যের দায় নিয়ে |
সংসদকে খাটো করা নয়, মানল সব দলই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
লোকপাল বিলের প্রশ্নে সংসদকে পাশ কাটিয়ে কোনও কিছুই করা হবে না বলে স্পষ্ট করে দিল কেন্দ্র। আজ সর্বদল বৈঠকেও সকলেই মেনে নিলেন সে কথা। তাই অণ্ণা হজারে শিবিরের দাবি অনুযায়ী, জন লোকপাল বিল স্থায়ী কমিটিতে না পাঠিয়ে এই মাসের মধ্যেই সরাসরি সংসদে পাশ করানো যে সম্ভব নয়, সেটাও তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয় সরকারের তরফে। যা মানতে চাননি অণ্ণার প্রতিনিধিরা।
ফলে দিনভর দফায় দফায় আলোচনার পরেও রফাসূত্র অধরাই রইল।
শুধু তা-ই নয়, রাতে সরকার ও অণ্ণা শিবিরের বৈঠকের পর পরিস্থিতি তিক্ততাতেও গড়াল। সেটা এতটাই যে অণ্ণা শিবিরের তরফে অভিযোগ করা হল, রাতারাতি বদলে গিয়েছে সরকারের আচরণ। স্বয়ং অণ্ণার কথায়, সরকারের আসল ‘স্বৈরাচারী’ মুখটা বেরিয়ে পড়েছে। এমনকী, অণ্ণার শরীর নিয়েও সরকার আর মাথা ঘামাতে রাজি নয় বলে দাবি করেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় সাংবাদিকদের জানান, তাঁরা অণ্ণার শরীরিক অবস্থা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। তিনি আরও বলেন, “আমার মুখে কথা বসানো হয়েছে। কথা বিকৃত করা হয়েছে।” তাঁর বক্তব্য, “আমি ওঁদের বলেছি, সংসদীয় প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে কিছু হবে না। তাই স্থায়ী কমিটির কাছে বিষয়টি যাক। তারা সব বিবেচনা করে যা করার করুক।”
সংসদই যে শেষ কথা, সেটা অণ্ণা শিবিরকে আরও এক বার বোঝানোর পাশাপাশি সরকার তাদের সঙ্গে সংঘাতকে কৌশলগত ভাবেই অণ্ণা বনাম সংসদ করে তুলতে চেয়েছে। সেই কৌশলের অঙ্গ হিসেবে সর্বদল বৈঠক ডাকা হয়েছিল। কারণ, কংগ্রেস তথা সরকারের শীর্ষ নেতাদের কাছে এ-ও স্পষ্ট ছিল যে, জন লোকপাল বিল পুরোপুরি কেউই সমর্থন করেন না। পাশাপাশি অণ্ণা যে ভাবে তাঁর তৈরি জন লোকপাল বিলকেই সংসদে পাশ করাতে চান, তা-ও কারও পক্ষে সমর্থন করা সম্ভব নয়। বৈঠকে সেটাই ঘটে। বিজেপি এবং বাম-সহ বিরোধী শিবিরের বড় অংশ সরকারের লোকপাল বিল প্রত্যাহার করে নতুন বিল পেশের দাবি জানালেও এই মতও উঠে এল যে, সংসদের অধিকার এবং মর্যাদাই সর্বোচ্চ। এমনকী, অণ্ণা হজারের জন লোকপাল বিলকেও কেউই ষোলো আনা সমর্থন করলেন না। বরং সর্বসম্মতিতে শুধু এই প্রস্তাবই গৃহীত হল যে, “অণ্ণা হজারেকে অনশন তুলে নেওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে। সরকার লোকপাল বিলের চূড়ান্ত খসড়া করার সময় যেন ‘জন লোকপাল বিল’ যথাযথ ভাবে বিবেচনা করে, যাতে তা নিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে সর্বসম্মতি তৈরি হয়।” এবং এই মতকে অস্ত্র করেই রাতে ফের অণ্ণা শিবিরের সঙ্গে দৌত্যে নামে সরকার। সংসদই যে সর্বোচ্চ, সর্বদল বৈঠকে তা নিয়ে সর্বসম্মতির পর প্রধানমন্ত্রীও তাঁর বাসভবনে ইফতার পার্টির অবসরে জানিয়ে দেন, অণ্ণা যে ভাবে সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছেন তা মানা সম্ভব নয়। আবার অণ্ণা শিবিরও অনড়। তাদের দাবি, কেন্দ্র তার বর্তমান বিল প্রত্যাহার করে, জন লোকপালের সুপারিশগুলো নিয়ে সংসদের চলতি অধিবেশনেই বিলটি পাশ করাক। |
|
সর্বদল বৈঠকে মনমোহন, প্রণব, অ্যান্টনি ও চিদম্বরম। ছবি: পি টি আই। |
গত রাতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, কিরণ বেদী ও প্রশান্তভূষণের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ও আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদ মতান্তরের বিষয় অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছিলেন। কিছু রক্ষাকবচ রেখে প্রধানমন্ত্রীর পদকে যেমন লোকপালের আওতায় আনতে রাজি হয় সরকার, তেমনই সিবিআই-এর দুর্নীতি দমন শাখাকে লোকপালের অধীনে রাখতেও সম্মত হয়। আবার বিচারব্যবস্থার শীর্ষ স্তরকে লোকপালের আওতার বাইরে রাখতে রাজি হন অণ্ণা সমর্থকরাও। কিন্তু তিনটি বিষয়ে মতান্তর রয়ে যায়। তা হল নিচু স্তরের আমলাদের লোকপালের আওতায় রাখার দাবি মানতে কেন্দ্র আপত্তি করে। সেই সঙ্গে রাজ্যস্তরে লোকায়ুক্ত গঠনের জন্য বিল আনতে এবং নাগরিক সনদ মান্য করার (সরকারি কর্মচারীদের আদর্শ আচরণবিধি এবং লক্ষ্য) বিষয়টি লোকপালের তদন্তের আওতায় রাখতে। কেন্দ্রের বক্তব্য, কংগ্রেস শাসিত রাজ্যে লোকায়ুক্ত নিয়োগ নিশ্চিত করা যেতে পারে, কিন্তু বিজেপি বা শরিকশাসিত রাজ্যে তা চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আজ তৃতীয় দফার বৈঠকে সেই মতান্তর কমিয়ে নাগরিক সনদের বিষয়টিতেও সম্মত হয় সরকার। কিন্তু জন লোকপাল বিল সংসদে পাশ করানোর মূল বিষয়টিতে রফা করা যায়নি স্বাভাবিক ভাবেই।
এ দিন সর্বদল বৈঠকের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলেন, মোটামুটি ভাবে অণ্ণা ও তাঁর সমর্থকদের অবস্থান হল এক, সরকার যে লোকপাল বিল সংসদে পেশ করেছে তা প্রত্যাহার করা হোক। দুই, জন লোকপাল বিল সামান্য কিছু পরিবর্তন করে চার দিনের মধ্যে সংসদে পেশ করা হোক। তিন, তার পর জন লোকপাল বিলটি স্থায়ী কমিটিতে না পাঠিয়ে আলোচনার মাধ্যমে চলতি অধিবেশনেই পাশ করানো হোক। প্রয়োজনে অধিবেশনের মেয়াদ সে জন্য বাড়ানো হোক। এই তিন শর্ত নিয়ে লিখিত আশ্বাস পেলে তবেই অণ্ণা হজারে অনশন প্রত্যাহার করবেন। এগুলোর মধ্যে প্রথমটি ছাড়া বাকিগুলোতে কোনও দলই রাজি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর পরে প্রণববাবু জানান, লোকপাল নিয়ে অণ্ণা সমর্থকদের সঙ্গে সরকারের ৩৩টি বিষয়ে সহমত রয়েছে। শুধু মতান্তর হয়েছে সাতটি বিষয়ে। তবে সরকারের কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার। তা হল, কোনও ভাবেই সংবিধানের পরিপন্থী কোনও ধারা লোকপাল বিলে রাখতে চাইবে না সরকার। সেই সঙ্গে সংসদের সর্বোচ্চ অবস্থান এবং মর্যাদাও খাটো হতে দেবে না।
রাজনৈতিক সূত্রে খবর, এর পরেই লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, সরকার যে লোকপাল বিলটি সংসদে পেশ করেছে তা কার্যকর নয়। তাই সরকার আগে তা প্রত্যাহার করুক। তবে সুষমাও কৌশলগত কারণে জন লোকপাল বিল সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক মত প্রকাশ করেননি। কিন্তু জানান, অণ্ণা হজারের অনশন প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। সর্বদল বৈঠকের খসড়া প্রস্তাব তৈরির ক্ষেত্রেও অণ্ণার পাশে থাকার বার্তা দিতে চেয়েছে বিজেপি। কারণ, সরকারের প্রাথমিক খসড়া প্রস্তাব ছিল, জন লোকপাল বিল-সহ নাগরিক সমাজের অন্য প্রতিনিধিদের মত নিয়ে চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হবে। কিন্তু বিজেপি আপত্তি করে বলে, নাগরিক সমাজের অন্য প্রতিনিধিদের রাখলে চলবে না। অর্থাৎ বিজেপি এ ভাবে অণ্ণাদের বিলটিই বিবেচনা করার কথা বলে। সরকার তা মেনে নেয়। পরিবর্তে সর্বসম্মত প্রস্তাবে বর্তমান বিলটি প্রত্যাহারের দাবিতেও বিজেপি চাপ দেয়নি। সরকারের বর্তমান বিল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্ত এবং সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি। তবে গুরুদাস বলেন, অণ্ণা সমর্থকদের ওপর যেন দমননীতি প্রয়োগ করা না হয়। আবার বৈঠকের পরে সীতারাম জানিয়ে দেন, তাঁরাও জন লোকপালের সব প্রস্তাব সমর্থন করেন না। সেই সঙ্গে সংসদের সর্বোচ্চ মর্যাদায় আঁচ পড়ুক, তাও চান না।
সর্বদল বৈঠকে এনসিপি-র মতো তৃণমূল কংগ্রেসও সরকারের পাশেই থেকেছে। লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেস মুখ্য সচেতক তথা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠকে বলেন, সংসদের অবস্থান এবং মর্যাদাকে খাটো করতে দেওয়া উচিত নয়। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় আলোচনা হতেই পারে। সরকারের পাশে থেকে কড়া সুরে লালুপ্রসাদ বলেন, এ ভাবে অনশনের হুমকিকে গুরুত্ব দিয়ে যদি সরকার সব দাবি মেনে নেয় তা হলে সংসদের কী হবে? রামবিলাস পাসোয়ান বলেন, অণ্ণা ও তাঁর সমর্থকরা সংরক্ষণ বিরোধী। কাল সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার দাবিতে ওঁরা অনশন করলে সরকার কী করবে? অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই ইত্তিহাদ আল মুসলিমিন-এর সদস্য আসাউদ্দিন ওয়াইসির মন্তব্য, “এমনকী ওঁরা কোনও দিন অনশন করে বলতে পারেন, সব মুসলিম সন্ত্রাসবাদী। তাঁদের দমন করতে নতুন বিল সংসদে পেশ করতে হবে।” |
|
|
|
|
|