উন্নয়নে বাধা দিলে তিনি ছেড়ে দেবেন না!
মারধর করে নয়, বাধার মোকাবিলা করবেন উন্নয়ন দিয়েই।
সৌজন্য দেখানোটা তাঁদের দুর্বলতা নয়!
পাহাড়-চুক্তির পর দিন শিলিগুড়িতে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের সাফ হুঁশিয়ারি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর উত্তরবঙ্গ সফরে এসে পাহাড়-চুক্তি সম্পাদন (ক্ষমতায় আসার দু’মাসের মাথায় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনটি ‘বড়’ কাজ করে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গুরের জমি সরকারের হাতে নেওয়া, জঙ্গলমহলে উন্নয়নের কর্মসূচি এবং পাহাড় চুক্তি) ছাড়া নিজেকে কার্যত সুকনার বনবাংলোতেই আবদ্ধ রেখেছিলেন মমতা। সম্ভবত ভালয়-ভালয় চুক্তি সই এবং তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিঞ্চিৎ টেনশন-জনিত কারণেই। কিন্তু পাহাড়ের মানুষের প্রতিক্রিয়া বা অঞ্জন দত্তের মতো ‘দার্জিলিং-মনস্কে’র ইতিবাচক এসএমএস পেয়ে তিনি অনেক তেজিয়ান।
উত্তরবঙ্গ সফর সেরে মঙ্গলবার কলকাতায় ফেরার আগে শিলিগুড়িতে রেল এবং রাজ্যের যৌথ কর্মসূচি ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে। কলকাতার উড়ান ধরার আগে সেখানেই বক্তৃতা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং সোমবারের চুক্তি-সই অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাঁর ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’কে যা যা বলতে পারেননি, এ দিন তা সুদে-আসলে পুষিয়ে নিয়েছেন। এক বারের বেশি সিপিএমের নাম করেননি। কিন্তু প্রধান বিরোধী দলের নাম কার্যত অনুচ্চারিত রেখেও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, মানুষকে ‘ভুল’ বোঝানোর ‘অপচেষ্টা’ তিনি বরদাস্ত করবেন না।
লোকসভা ভোটে দক্ষিণবঙ্গে নিজের রাজনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের পর বিধানসভা ভোটেও উত্তরবঙ্গে আগের চেয়ে ভাল ফল করেছে তৃণমূল। এ দিন তা আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন মমতা। বলেছেন, “আসুন, আমরা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে মেলবন্ধনের সেতু গড়ি। আমি বলছি, এমন উন্নয়ন করব যে, আগামী ছ’মাসের মধ্যে উত্তরবঙ্গে আমার বেকার ভাইবোনদের জন্য চাকরির দরজা খুলে যাবে। আমাদের সরকারের বয়স মাত্র দু’মাস হয়েছে। তার মধ্যেই কিন্তু আমরা উত্তরবঙ্গের জন্য কাজ করতে শুরু করেছি। পাহাড় থেকে শিলিগুড়ি, শিলিগুড়ি থেকে মালদহ গোটা উত্তরবঙ্গ আমরা নতুন করে গড়ব।”
পাহাড়-চুক্তি নিয়ে সিপিএম যে তাঁর বিরোধিতায় নেমেছে, সে খবরও সভাস্থলে আসার আগেই পেয়েছিলেন মমতা। পাহাড়-চুক্তিতে তরাই-ডুয়ার্সের কিছু অংশ গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (জিটিএ) আওতায় আসার পথ খোলা রাখা হয়েছে, এমন প্রচারে যথেষ্ট বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, “যে কেউ চাইলে চুক্তি দেখে নিতে পারেন! তাতে বলা হয়েছে, জিটিএ-র আওতায় থাকবে দার্জিলিং, কালিম্পং এবং কার্শিয়াং মহকুমা। আর তরাই-ডুয়ার্সের বিষয়টা দেখার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠিত হবে। সেই কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। তা হলে তরাই-ডুয়ার্সের অংশ দিয়ে দেওয়ার রাস্তা খোলা রাখা হয়েছে কোথায়? আমরা তো কেউই এখনও জানি না, কমিটি কী বলবে!” শিলিগুড়ির অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “রটিয়ে দেওয়া হল, তরাই-ডুয়ার্স দিয়ে দেওয়া হবে। সমস্ত কুৎসা আর অপপ্রচার। একটা এলাকায় স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে শুধু। তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে!” |
প্রসঙ্গত, কমিটিতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার চার প্রতিনিধি থাকবেন। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে থাকবেন জনগণনা দফতরের ডিরেক্টর। রাজ্য সরকারের তরফে থাকবেন স্বরাষ্ট্র দফতরের এক অফিসার এবং দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির দুই জেলাশাসক। কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত করবে রাজ্য সরকার (সম্ভবত মুখ্যসচিবই হবেন কমিটির চেয়ারম্যান)। প্রশাসনিক সূত্রে যার ব্যাখ্যা করা হচ্ছে এই বলে যে, “কমিটিতে রাজ্য সরকার এবং মোর্চার প্রতিনিধি মিলিয়ে ন’জন থাকবেন। কিন্তু সরকারের তরফে প্রতিনিধি থাকবেন চেয়ারম্যান নিয়ে পাঁচ জন। যাঁরা কেউই তরাই-ডুয়ার্স দিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নন। কারণ, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার কেউই তা চায় না। ফলে কমিটিতে তাঁরাই সংখ্যাগুরু। অতএব যে আশঙ্কা করা হচ্ছে বা প্রচার চালানো হচ্ছে, তা একেবারেই ভিত্তিহীন।” রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, “আমলা মহলে একটা কথা খুব চালু যখন কোনও বিষয়ে ধীরে চলো নীতি নিতে হবে, তখন একটা কমিটি করে দাও। এর থেকে যা বোঝার বুঝে নিন!”
চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে, কমিটির কাজের পাশাপাশিই জিটিএ এলাকায় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হবে। এবং সেই প্রস্তুতি নেওয়া হবে বর্তমান সীমানা পুনর্বিন্যাস অনুযায়ী। অর্থাৎ, চুক্তি অনুযায়ী দার্জিলিং, কালিম্পং এবং কার্শিয়াং এলাকা নিয়েই। যা একান্ত ভাবেই পাহাড়ে। সমতলে নয়। যা থেকেও স্পষ্ট যে, বর্তমান এলাকার ভিত্তিতেই পাহাড়ে জিটিএ-র নির্বাচন হবে এবং জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন। ফলে তরাই-ডুয়ার্স দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। এর পরেও রয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব। মমতা নিজে ঘনিষ্ঠ মহলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি কোনও মতেই তরাই-ডুয়ার্স জিটিএ-র অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী নন। আলাদা রাজ্য তো অনেক দূরের কথা! সে মোর্চা নেতা বিমল গুরুঙ্গ যা-ই বলুন না কেন!
এ দিন শিলিগুড়িতেও মুখ্যমন্ত্রী সেই বার্তাই দিয়েছেন। ঝিরঝিরে বৃষ্টি এবং শহরে ‘আমরা বাঙালি’-র বন্ধ সত্ত্বেও যাঁরা তাঁর বক্তৃতা শুনতে জড়ো হয়েছিলেন, সেই চোখে পড়ার মতো ভিড়ের উদ্দেশে (যে জনতার সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করল কলকাতা থেকে-আসা রেলের শিয়ালদহ শাখার সাংস্কৃতিক টিম। জনতার হাততালি তো বটেই, রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী নগদ দু’লক্ষ টাকা পুরস্কারই ঘোষণা করে ফেললেন তাদের জন্য) মমতা বলেন, “আবেদন করছি, বন্ধ ডাকবেন না। পাহাড়ের মানুষও চান, আমরা সকলে মিলে ভাল ভাবে কাজ করি।” আবার পর ক্ষণেই ‘আবেদন’-এর রাস্তা ছেড়ে তাঁর হুঁশিয়ারি, “বন্ধ করছে! যেন বন্ধের জমিদারি হয়েছে! আগুন নিয়ে খেলবেন না। প্রগতিকে বাধা দেবেন না। সিপিএম, পিছন থেকে কলকাঠি নাড়বেন না।” মমতার আরও বক্তব্য, “যারা ভাঙতে চায়, তারা কখনও গড়ার স্বপ্ন দেখে না। উন্নয়নকে বাধা দেবেন না। মানুষকে ভুল বোঝাবেন না। বিভেদ ছড়াবেন না। উন্নয়নকে বাধা দিলে আমি কিন্তু ছেড়ে দেব না। যে কোনও মূল্যে উন্নয়ন করব।” তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “মারপিট করে নয়। মেরে নয়। উন্নয়নকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা রুখব উন্নয়ন দিয়েই।” এরই পাশাপাশি বিরোধীদের মুখ্যমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ, “লড়াই করলে সামনে থেকে করুন। পিছন থেকে ছুরি মারবেন না। গোর্খা ভাইরা আমার ভাই। সকলকে নিয়ে চলতে হবে।” কামতাপুরি এবং গ্রেটার কোচবিহারের আন্দোলনকেও এক হাত নিয়েছেন মমতা, “বাঙালি-অবাঙালি-রাজবংশী-পাহাড়ের মানুষের মধ্যে বিভেদ ঘটানোর চেষ্টা করছে কেউ কেউ। আপনারা সকলে জোট
বেঁধে এগিয়ে যান। উন্নয়নের বান ডাকবে উত্তরবঙ্গে। দার্জিলিংয়ের উন্নতি হলে তো শিলিগুড়িরই ভাল হবে।”
প্রায় আড়াই দিনের উত্তরবঙ্গ সফর সেরে কী বুঝলেন রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী?
নীল ঝোলাটা কাঁধে তুলে মমতা বললেন, “কথা দিয়ে কথা রাখাটা আমার জীবনের একটা অন্যতম বড় ইচ্ছে। সেটাই আমার বিশ্বাসযোগ্যতা। আমার তো ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই। মানুষকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলাম, সেটা ভেবে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে, আরও আরও আরও কাজ করতে পারব।”
|