নোটিসপিছু ১০ পয়সা, আশাই সম্বল সার্ভারদের
কাল সকাল চাট্টি ভাত খেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরনো। তার পর এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চক্কর। গড়ে ৭-৮ কিলোমিটার দূরের এক-একটা গ্রামে গিয়ে কৃষকের হাতে সেচ দফতরের নোটিস দিতে হয়। চাষের মরসুমে সেচ দফতরের খালের মাধ্যমে জমিতে জল নেওয়ার জন্য সরকারকে কত টাকা খাজনা দিতে হবে, তারই নোটিস। খর গ্রীষ্ম, তীব্র শীত বা অবিশ্রান্ত বর্ষায় সারা দিন অক্লান্ত ভাবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘুরে এই ভাবে পৌঁছে দেওয়া নোটিসপিছু সরকারের কাছ থেকে মাত্র ১০ পয়সা পারিশ্রমিক পান হরিপালের মুসাপুর গ্রামের হেমন্ত কোলে! এবং তাঁর মতো আরও অনেক ‘নোটিস সার্ভার’।
কৃষি-শ্রমিক বা খেতমজুরদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ১১২ টাকা ৫০ পয়সা, চা শ্রমিকেরা ন্যূনতম দৈনিক মজুরি পান ৬৭ টাকা। অথচ, এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে সেচ দফতরের অস্থায়ী ‘নোটিস সার্ভারেরা’ সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করেন ২-৩ টাকা। পঞ্চাশ পেরনো হেমন্ত কোলে,
গুড়াপের আব্দুল রশিদ সরকার, হুগলির অমরকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, দোলপুর বর্ধমানের মানিক মুখোপাধ্যায় বা দুর্গাপুরের দুলেশ্বর মণ্ডলের মতো অনেকেই জানালেন, কোনও মাসেই ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি রোজগার হয় না তাঁদের। “এই বাজারে মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০! ভাবা যায়! এতো মারাত্মক ঘটনা।
অমানবিক। দরিদ্রদরদী বলে যে বামফ্রন্ট বড়াই করে তারা কি এঁদের অবস্থা সম্পর্কে এত দিন ওয়াকিবহাল ছিল না?” বলেছেন সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইঞা।
‘নোটিস সার্ভারেরা’ অবশ্য বলছেন, ‘ওয়াকিবহাল’ না-থাকার কোনও কারণ নেই। ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সেই আশির দশক থেকে তাঁরা আন্দোলন করছেন। আব্দুল রশিদ ম্লান হেসে বলেন, “সরকার একেবারে যে কথা শোনেনি তা নয়। ৮০ সালে নোটিস প্রতি ৬ পয়সা পেতাম। তা বাড়িয়ে ১০ পয়সা করেছে! ভাবতে অবাক লাগে, সরকারি কর্তারা কি বুঝতে পারেন না যে, এই টাকায় কোনও মানুষের সংসার চলে না?”
কার কী মনে হয় জানা যায়নি, তবে হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান, বাঁকুড়া জুড়ে দামোদর ইরিগেশন সার্কেলে কাজ করা প্রায় দেড়শো ‘নোটিস সার্ভার’ জীবন বদলায়নি। দীর্ঘদিন এঁদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ‘ইউনাইটেড স্টেট গভর্মেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশন’-এর সভাপতি মনোজ চক্রবর্তীর কথায়, “নোটিস সার্ভারদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো সংক্রান্ত ফাইল এক যুগের বেশি শুধু এক সরকারি দফতর থেকে আর এক সরকারি দফতরে যাচ্ছে। যেখানে অস্থায়ী সরকারি কর্মচারীদের ন্যুনতম বেতন ৩,৪০০ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে এই মানুষগুলি মাসে ২৫০ টাকাও পাচ্ছেন না। এটা কোনও সভ্য সমাজে সম্ভব?”
ফাইল যে ‘ঘুরছে’ তা স্বীকার করেছেন মানসবাবুও। বলেছেন, “বছর তিনেক আগে কয়েকবার সেচ দফতর থেকে অর্থ দফতরে এই সংক্রান্ত ফাইল গিয়েছে। কিন্তু কিছু হয়নি। আমি সচিব অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়কে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছি। এটা চলতে পারে না।” গুড়াপের আব্দুল রশিদ সরকার বা দুর্গাপুরের দুলেশ্বর মণ্ডলেরা জানিয়েছেন, সারা বছরের মধ্যে সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসেই বেশি নোটিস দিতে হত। কিছু রোজগার হত। এখন তা-ও হয় না। কারণ, এখন নিয়মিত নোটিস লেখাই হয় না।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এত কম পারিশ্রমিক পেয়েও কেন ‘নোটিস সার্ভারেরা’ এই কাজ করছেন? কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না? কী করে এই টাকায় তাঁদের জীবন চলে? ‘নোটিস সার্ভার’দের জবাব, “আমরা কাজটা করে যাচ্ছি একটাই আশায়‘— যদি কোনও দিন সরকার আমাদের স্থায়ী করে?” তাঁরা জানালেন, এই নামমাত্র টাকায় জীবন চলে না বলেই তাঁদের কেউ অন্য সময় খেতমজুরি করেন, কেউ ঘর ছাওয়ার কাজ বা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হিসাবে কাজ করেন। কোনও রকমে সংসার চলে।
তবুও কোনও দিন সব ঠিক হবে এই আশাতেই ৫০-৫৫ পার করা মানুষগুলো এখনও দিনে ২০-২২ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তর।
দিন গেলে হাতে আসছে বড়জোর ২-৩ টাকা! এই যুগেও!
Previous Story Rajya Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.