কুৎসিত সব লোহার ব্যারিকেড। সেগুলোর সামনে অঝোর বৃষ্টিতে ঘুরছে ক্যাটক্যাটে হলদে রংয়ের বর্ষাতি পরা চেহারা। হাতে লাঠি। ছপাৎ ছপাৎ করে জল মাড়িয়ে যাওয়া আসা করছে। ঘিঞ্জি, সরু রাস্তা। যার মুখ-চলতি নাম ‘খাউ গলি’। গত কাল সন্ধেয় এই এলাকাই কেঁপে উঠেছিল তীব্র বিস্ফোরণে।
তৃতীয় বার!
প্রথম ১৯৯৩। দ্বিতীয় ২০০৩। ২০১১-য় তৃতীয় বার। দক্ষিণ মুম্বইয়ের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা জাভেরি বাজার আরও এক বার বিস্ফোরণ-বিক্ষত। কলকাতার বড়বাজারের মতো ছোট ছোট গলি। তাতে ছোট ছোট দোকান। দিনের প্রায় সব সময়েই সরগরম। সন্ধেয় তো আরও। দিনের শেষে হা-ক্লান্ত ব্যাবসায়ীরা খাউ গলিতে এসে পেটে কিছু ঢেলে ফেরার রাস্তা ধরেন। তাঁরা কি জানতেন, সেই গলির মুখেই একটা মোটরসাইকেলের পাশে ফালতু ছাতার তলায় শক্তিশালী বিস্ফোরক রাখা রয়েছে? যার প্রচণ্ড অভিঘাতে রাস্তায় গভীর গর্ত তৈরি হবে? যে গহ্বর নিয়ে নেবে তাঁদের মধ্যে ১৩ জনের জীবন? আজ অবশ্য রুজির ধান্দায় আবার খুলেছে জাভেরি বাজারের অক্ষত অংশ। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে গোটা দেশ থেকে লোক এসে থানা গেড়েছেন জাভেরি বাজারে। সারা ভারতের সোনার কারবারের (‘জাভেরি’ মানে আসলে ‘জহুরি’) প্রায় ৭০ শতাংশের ধারক-বাহক। ব্যবসায়ীরা এসেছেন। দোকান খুলে বসেছেন। টুকটাক খদ্দেরও আসছে। ‘কসমোপলিটান’ মুম্বইয়ের সার্থক টুকরো।
তবে খাউ গলিতে সাধারণের চলাফেরা বন্ধ। একে তো গত কাল সন্ধের বিস্ফোরণ। তার পর আজ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভিভিআইপি-দের আনাগোনা। কী অবাক তাঁদের চোখ! কী অপার বিস্ময়! তার পরেই নতমস্তকের চিত্রনাট্যে আরোপিত সহানুভূতি।
হাস্যকর লাগছিল। |
জাভেরি বাজারের তিন কিলোমিটারের মধ্যে অপেরা হাউস এলাকা। কোনও এক কালে অপেরা হাউস নামে সিনেমা হল ছিল। সেটা কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে! কিন্তু নামটা থেকে গিয়েছে। পোশাকি নাম গিরগাঁও জে এস এস রোড। রাস্তার মুখে আড়াআড়ি দাঁড় করানো মুম্বই পুলিশের প্রিজন ভ্যান। ভিতরে সাধারণ মানুষের যাওয়া বারণ। মাথার উপর বিশাল একটা অশ্বত্থ গাছ। তার পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া। রাস্তার দু’পাশে প্রাচীন সব বাড়ি। গায়ে গায়ে লাগানো। তাদের দেওয়ালে আরও গায়ে গায়ে লাগানো স্প্লিট এসি মেশিনের বাইরের ইউনিটগুলো। যা বলছে, এলাকাটা বাইরে পুরনো পুরনো হলেও, বড়লোকদের। ঠিকই। বাড়িগুলোর এক তলায় সার সার দোকান। হিরের! সারা দিনে নাকি গড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় এখানে। বলছিলেন স্থানীয় এক যুবক। আজ সেটা বন্ধই রইল।
প্রবল কম্পনে শাটার-ফেলা দোকানের ভিতরের শো-কেসের কাচ নাকি ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়েছে। বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ কুমার। আঙুল তুলে দেখাচ্ছিলেন, “ওই যে নীল রংয়ের তার্পোলিন-ঢাকা জায়গাটা, ওখানেই একটা মারুতি এস্টিম গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। তার পাশেই একটা হাতগাড়ির উপর রাখা ছিল বিস্ফোরক। আজও সার সার কয়েকটা হাতগাড়ি দাঁড়িয়েছিল সেখানে। কালো রংয়ের। কী অসম্ভব আটপৌরে আর নিরীহ দেখতে। কে বলবে, গত কাল সন্ধেয় ভলকে ভলকে আগুন উঠছিল এই রাস্তা থেকে! চার দিকে ছিন্নভিন্ন দেহের সারি। মাংস পোড়ার কটূ গন্ধ। আর দিশেহারা দৌড়। কিন্তু তখনও কেউ কেউ ছিলেন, যাঁরা স্নায়ু ঠিক রেখে মোবাইলে ছবি তুলেছিলেন গোটা দৃশ্যের। আজ কাছের একটা বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকবেরির স্ক্রিনে সেটা দেখাচ্ছিলেন তাঁদেরই এক জন। নাম জানা হল না, তাঁর চার দিকে এত ভিড়। কিন্তু ঠেলেঠুলে গিয়ে দেখে আসা গেল। |
খানিকটা ঝাপসা। কিন্তু লকলকে আগুনের শিখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাত্রই কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও। কিন্তু তাতেই গোটা স্ক্রিন জ্বলজ্বল করছে। এ-পাশে ও-পাশে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছু রক্তাক্ত চেহারা। দেখলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিস্তর বিস্ফোরণ কভার-করা পেশাদারেরও চিত্তবৈকল্য হয়। যেমন হচ্ছিল দাদার স্টেশনের অনতিদূরে বিখ্যাত দাদার-পশ্চিমের ‘কবুতরখানা’র সামনে দাঁড়িয়ে। ‘পরিন্দা’ সিনেমার বিখ্যাত দৃশ্যটা মনে পড়ে? ছোটবেলার বন্ধু অনিল কপূরের সঙ্গে দেখা করতে এসে পিছন থেকে ছোড়া আততায়ীর গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছেন পুলিশ অফিসার অনুপম খের। ঝটপট করতে করতে উড়ে যাচ্ছে অজস্র পায়রা।
মনে রাখুন, দাদার বরাবরই শিবসেনার ঘাঁটি। দাদারের খানিকটা পরেই শিবাজি পার্কে শিবসেনার সদর দফতর। দাদারে অধুনা পরিচিত রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার প্রভাবও যথেষ্ট। অর্থাৎ, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের খাসতালুক। সম্ভবত সেই জন্যই দাদারের বিস্ফোরণ অন্য রকমের ‘তাৎপর্য’ বহন করছে। কিন্তু সে তো গেল রাজনীতির কারবারিদের সালতামামি। সাধারণ মানুষ? তাঁরা কোথায় গেলেন?
আজ দুপুরে জায়গাটা কী অদ্ভুত নিঝুম! স্টেশনের কাছেই এক ইলেকট্রিক মিটার-বক্সে রাখা এক কিলো অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জীবনটাই বদলে দিয়েছে এই এলাকার। অন্তত এক দিনের জন্য। তীব্র বিস্ফোরণের কম্পনে কাছাকাছি দাঁড়-করানো সমস্ত গাড়ির কাচ চুরমার হয়ে ভেঙে পড়েছিল মিছরির গুঁড়োর মতো। আজ দুপুরে সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করছিলেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের (এনএসজি) কমান্ডোরা। যাঁদের দেখলেই আবার ভিড় করে আসে ২৬/১১-র দৃশ্যপট। পরিচয় দিয়ে দেওয়ালে গর্তটা দেখা আসা গেল। আচ্ছাদনের তলায় থাকায় সেখানে তখনও চটা দেওয়ালটা রয়ে গিয়েছে। বিশাল গর্তের মুখের চারপাশে মেঝেতে চরকি-বাজি পোড়ালে যেমন হয়, তেমন বিভিন্ন রংয়ের দাগ। বিস্ফোরণের খুব পরিচিত চিহ্ন। প্লাস্টিকের ছোট ছোট প্যাকেটে নমুনা সংগ্রহ করছিলেন এনএসজি এবং দিল্লি থেকে-আসা ফরেন্সিক টিমের সদস্যরা। |
কোনও ধারণা?
ব্রিফকেস হাতে, সাধারণ শার্ট-ট্রাউজার্সের ভদ্রলোকেরা ম্লান হাসলেন। সেই হাসি খুব একটা আশা জাগায় না। বরং অসহায়তা প্রকটতর করে। নাম জানাতে প্রবল অনীহা। এক জন বললেন, “আসলে এই বৃষ্টিতে অনেক পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ ধুয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে তো কিছু করার নেই। যা আছে, সেটা নিয়েই কাজ করতে হবে। কী আর করা!” তাঁদের বলা হল না, হয়তো তাঁদের কাজের ক্ষতি হল। কিন্তু যে কোনও বিস্ফোরণ স্থলের আশপাশে পর দিন যে বীভৎসতার চিহ্ন থেকে যায়, সেটা দেখার হাত থেকে অন্তত জনতাকে রেহাই দিয়ে গেল তুমুল বৃষ্টি।
কয়েক বছর আগে বৃষ্টি ভাসিয়েছিল মুম্বইকে।
তুমুল ভোগান্তি।
কয়েক বছর পরের বৃষ্টি ধুয়ে দিয়ে গেল বিস্ফোরণের চিহ্নটুকু।
আপাত-স্বস্তি।
কখন যে কী ভাবে বদলে যায় জীবনের ধারাপাত! |