ত্রস্ত মুম্বই
মর্গের দরজায় ছটফট করছে ধ্বস্ত মুখের ভিড়
থিক স্থাপত্যের পাথুরে দেওয়ালের গায়ে সাঁটা কাগজের টুকরোটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন আতুর মানুষ। আঁতিপাঁতি খুঁজছেন পরিচিত নাম।
কিছু দূরে একটা চত্বরের পাশে ছাতার তলায় অন্তহীন প্রতীক্ষায় আরও কিছু চেহারা।
ভিতরের বেঞ্চে আরও কিছু ধ্বস্ত মানুষ। মাথা নিচু। চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে এত ক্ষণে। পরনে খুব আটপৌরে শার্ট-ট্রাউজার্স। কারও পায়ে চটি। কারও পায়ে সস্তা দরের জুতো। পকেটের সেলফোন বেজে উঠছে কখনও কখনও। জে জে হাসপাতালের নৈঃশব্দ্য ভেদ করে তীক্ষ্ন শোনাচ্ছে সেই শব্দ।
গত কাল থেকে নতুন এক পরিচয় হয়েছে এঁদের ‘১৩/৭ ভিকটিম’। ১৩/৭-এর শিকার। যাঁদের মধ্যে নিহতদের পরিবারের জন্য মহারাষ্ট্র সরকার ইতিমধ্যেই পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে দু’লক্ষ করে টাকা। আহতদের জন্য রাজ্য সরকারের ক্ষতিপূরণ পরিবারপিছু ৫০ হাজার টাকা। তাঁদের চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্বও সরকারেরই। ‘শিকার’ হওয়ার সাম্মানিক!
সত্যি! স্রেফ অর্থ দিয়ে যদি ক্ষতি মাপা যেত! কেন যে ‘ক্ষতিপূরণ’ বলে! এই ক্ষতি কখনও পূরণ হয়? কোনও ভাবে? কোনও অঙ্কের অর্থে?
গত কাল সন্ধের পর থেকে একটা গোটা রাত কেটে গিয়েছে। দক্ষিণ মুম্বইয়ের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল দৌড়োদৌড়ি। বেঁচে আছে? কতটা আহত? কোন অ্যাম্বুল্যান্সে রয়েছে? আদৌ অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়া গিয়েছে কি? কোন টাকায় হয় এই হেনস্থার ক্ষতিপূরণ!
গত কাল সন্ধেয় জাভেরি বাজার এবং অপেরা হাউসে বিস্ফোরণের পর দক্ষিণ মুম্বইয়ের মোট ছ’টা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল গুরুতর আহতদের। আর এই জে জে হাসপাতালে বাধ্যতামূলক ভাবে আনা হয়েছিল তাঁদের, যাঁদের দেহ থেকে প্রাণবায়ু ঘটনাস্থলেই বেরিয়ে গিয়েছে। কেননা শহর মুম্বইয়ের এই হাসপাতালেই একমাত্র ময়নাতদন্তের পরিকাঠামো রয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সদের জরুরি ভিত্তিতে ডেকে আনা হয়েছিল রাতেই। আপৎকালীন অবস্থায় তাঁরা রাতভর কাজ করেছেন। কিন্তু তাতেও কি সামাল দেওয়া গিয়েছে পরিস্থিতি?
মুম্বইয়ের হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ
ও ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধী। পিটিআই
যায় নাকি কখনও!
সারি সারি মুখ। সারি সারি বিধ্বস্ত চেহারা। তাঁরা ক্ষুব্ধ। ক্রুদ্ধ। তাঁরা বলছেন, “কাল রাত থেকে এক দরজা থেকে অন্য দরজায় ধাক্কা খাচ্ছি! কেউ সাহায্য করছে না। একটাও অ্যাম্বুল্যান্স নেই! কেউ কিছু বলতেও পারছে না।” কে তাঁদের বোঝাবে যে, মৃতদেহের ময়নাতদন্তের জন্য একটা আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে! আর কেনই বা তাঁরা বুঝবেন! হাসপাতালের পিছন দিকে মর্গের ফটক ধরে ঝাঁকাচ্ছেন কেউ। তাঁর পাশ দিয়ে শববাহী গাড়িতে বেরিয়ে যাচ্ছে কারও মৃতদেহ। বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আর্ত মানুষের হাহাকার সম্বলিত চোখের জল।
প্রিয়ঙ্কা, রীতেশ, সন্তোষ..। একের পর এক মুখ। একের পর এক নাম। কারও ইন্টিরিয়র ডেকরেশনের সঙ্গে যুক্ত স্বামী মাত্র ছত্রিশেই নিহত। কারও ব্যবসার পার্টনার। মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে রীতেশ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে বলছিলেন, “টিভিতে এত দিন দেখেছি। কাগজে পড়েছি বিস্ফোরণের খবর। খারাপ লেগেছে। ভেবেছি, যাদের জীবনে এমন হয়, তারা কী করে সামলায়! এখন বুঝতে পারছি, কী হয়! কখনও ভাবিনি, হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকের সঙ্গে আমি নিজে কোনও দিন এই কারণে কথা বলব। বিশ্বাস করুন।” পাশে দাঁড়িয়ে এক অচেনা যুবক বলছিলেন, “নিজের চোখে কখনও দেখিনি! চার দিকে রক্ত। কিছু লোকের গায়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ছিটকে ছিটকে পড়ছে লাশ। কোথাও ধড় থেকে মুন্ডু বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। কোথাও পড়ে রয়েছে উড়ে-যাওয়া হাত-পা। চার দিকে ধোঁওয়া। এখনও ভাবলে শরীর খারাপ লাগছে।” জানা গেল, তাঁর নাম রাজেন্দ্র রাঠৌড়। দাদারের কবুতরখানার কয়েক মিটার দূরে তাঁর দোকান। যে দোকানের অস্তিত্বই এখন বিপন্ন। দরজা ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালে এসেছিলেন পাশের এক দোকানের মালিকের খবর নিতে।
সকালেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের। দুপুরে লালকৃষ্ণ আডবাণী। রাতে খোদ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধীর। রাজনীতির অলিগলি মাড়িয়ে জে জে হাসপাতাল থেকে সইফি হাসপাতালে দৌড়েছেন রাজনীতির কারবারিরা। হাসপাতালে শুয়ে থাকা আহতদের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁদের। জে জে হাসপাতালে প্রায় কুড়ি মিনিট ছিলেন মনমোহন-সনিয়া (ভাবা যায়!)। তার আগে সইফি হাসপাতাল। কী ভাবে ঘটনা ঘটেছিল, তাঁদের কোথায় কোথায় আঘাত লেগেছে, এই সব রুটিন প্রশ্ন। এ সব ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে। হাসপাতালে ঢোকার আগে বক্তব্য পেতে আকুল সংবাদমাধ্যমকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন বলেছেন, “আমি নিহতদের পরিবার এবং আহতদের সঙ্গে আছি।”
এর বেশি আর কীই বা বলতে পারতেন তিনি! উস্কোখুস্কো, উলোঝুলো চেহারা সব। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। সরকারি অবিমৃষ্যকারিতা এবং নিস্পৃহতায় বিরক্ত। অথচ অসহায়। কাকে সান্ত্বনা দেবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী? জে জে হাসপাতালের ফটকের বাইরে অনন্ত প্রতীক্ষা চলছে তাঁদের।
জুলাই মাসের ১৩ তারিখ তো অদৃশ্য অথচ এক নতুন পরিচয় দেগেই দিয়েছে তাঁদের গায়ে ১৩/৭-এর শিকার।
Previous Story Desh Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.