ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন? হতে পারে।
মানববোমা? হতে পারে। কিন্তু এখনও কোনও প্রমাণ নেই।
সীমান্তের ও পার থেকে আসা সন্ত্রাসবাদী? হতে পারে। এখনও বলা যাচ্ছে না।
ভারত-পাকিস্তান আলোচনা বানচাল করার চেষ্টা? এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য না করাই ভাল।
মুম্বইয়ের মাফিয়াদের হাত? খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মাওবাদী? সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালানিয়প্পন চিদম্বরম বা মুম্বই-এটিএস প্রধান রাকেশ মারিয়া বা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের সচিব ইউ কে বনশল মুম্বইয়ের ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পরে ২৪ ঘণ্টা কাটলেও সকলেই এমনই অন্ধকারে! সকলেই একই রকম দিশাহারা! কে বা কারা দেশের অর্থনৈতিক রাজধানীতে এ ভাবে সন্ত্রাস চালাল, সে সম্পর্কে কোনও তথ্যই এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাননি গোয়েন্দারা! ফলে ‘সব রকম সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে’ বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
সকাল দশটায় মুম্বইয়ে চিদম্বরম জানিয়েছিলেন, তদন্তে কোনও নির্দিষ্ট দিশা নেই। ভারত-বিরোধী সমস্ত জঙ্গি-সংগঠনের যোগসূত্রই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই বিস্ফোরণের বিষয়ে কেন্দ্র বা রাজ্যের কাছে আগেভাগে কোনও গোয়েন্দা-তথ্য ছিল না বলে মেনে নিলেও একে ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’ হিসেবে স্বীকার করেননি চিদম্বরম। তবে গোটা ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেছেন।
এর পরে বেলা গড়িয়েছে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্তির। চিদম্বরম, ইউ কে বনশল, রাকেশ মারিয়া বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব রাজকুমার সিংহ, সকলেরই এক কথা কে বা কারা গত কাল মুম্বইয়ের ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তা নিয়ে এখনও কোনও নির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি! মুখে না বললেও গোয়েন্দাদের সন্দেহের তির এখনও লস্কর-ই-তইবা ও সিমি-র নিয়ন্ত্রণে থাকা ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের দিকেই। কিন্তু সরকারি ভাবে সে দাবি করতে গেলে যে প্রমাণ প্রয়োজন, এনআইএ-এনএসজি-এটিএস-মহারাষ্ট্র পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের গোয়েন্দারা এখনও তা হাতড়ে চলেছেন। সরাসরি না হলেও গোয়েন্দা-কর্তারা যা মানছেন, তা হল, অন্যান্য নাশকতার ঘটনার পরে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন যে ভাবে ই-মেল পাঠিয়ে দায় স্বীকার করে, তা এ ক্ষেত্রে হয়নি। আর সেটাই ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে।
কিন্তু তা হলে কারা? চিদম্বরমের যুক্তি, “আগে থেকে কিছু ধরে নিয়ে তার ভিত্তিতে রাজ্য পুলিশ এগোচ্ছে না।” অর্থাৎ আগেভাগে কারও নাম করে বিপাকে পড়তে চান না তিনি। সে জন্যই সব সম্ভাবনার দরজা খুলে রাখছেন তিনি। এমনকী সেটা করতে গিয়ে মুম্বই বিস্ফোরণের পিছনে মাওবাদী-যোগও উড়িয়ে দেননি চিদম্বরম। গত মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের তথ্যের ভিত্তিতে পুণে থেকে দশ জন মাওবাদীকে গ্রেফতার করে মহারাষ্ট্র সন্ত্রাস দমন শাখা। ওই দশ জনই পশ্চিম মেদিনীপুরের মাওবাদী বলে দাবি করেছিল পুলিশ। গত কালের বিস্ফোরণ কি তারই প্রতিশোধ? চিদম্বরমের কথায়, “সে সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” |
গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে মুম্বইয়ের লাগাতার বৃষ্টি। তার ফলে এক দিকে ঘটনাস্থল থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে সমস্যা হচ্ছে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের। আবার বৃষ্টির মধ্যে ছাতার আড়াল থাকায় সিসিটিভি-ফুটেজ থেকেও কোনও ‘ক্লু’ খুঁজে পেতে সমস্যা হচ্ছে গোয়েন্দাদের। তার মধ্যেই ময়নাতদন্তে একটি মৃতদেহে বিদ্যুতের তার মেলায় মানব-বোমার জল্পনাও শুরু হয়েছে। এনএসজি-র প্রধানের থেকে ওই ব্যক্তির ব্যাপারে রিপোর্ট পাওয়ার পরেই নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, “কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তবে ওই ব্যক্তি যে সুইসাইড-বম্বার ছিল, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এমনও হতে পারে, ওই ব্যক্তি বোমার খুব কাছাকাছি ছিলেন। ফলে শরীরে তার আটকে যেতে পারে।’’ মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, মানব-বোমা সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যক্তিকে হত্যা বা প্রচণ্ড স্পর্শকাতর এলাকায় নাশকতার জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আপাত ভাবে সাধারণ মানুষের ভিড়ে মানব-বোমা ব্যবহারের কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না গোয়েন্দারা। সে কারণেই বাড়তি সতর্ক তাঁরা।
গত কালের ঘটনাকে চিদম্বরম গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলে মানতে রাজি না হলেও গোয়েন্দারা কেন পরিকল্পিত ভাবে তিন জায়গায় বিস্ফোরণের চক্রান্তের আঁচ পর্যন্ত পেলেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চিদম্বরমের জবাব, “চক্রান্তকারীরা একেবারে গোপনে কাজ সেরেছে।” আর গোয়েন্দা-কর্তারা বলছেন, খুব ছোট বা নতুন একটি দলকে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। তাই জন্যই আগে থেকে কিছু জানা যায়নি। এ বিষয়ে আজ চিদম্বরমের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননেরও কথা হয়েছে। তদন্তে এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য হল, বিস্ফোরণে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ও টিএনটি ব্যবহার হয়েছিল। বোমার ‘টাইমার’ হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল মোবাইলের অ্যালার্ম। অন্তত দু’টি বোমায় এক কেজিরও বেশি ওজনের বিস্ফোরক ব্যবহার হয়েছিল। আর এই সমস্ত তথ্য একজোট করে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর প্রতি সন্দেহ আরও বেড়েছে গোয়েন্দাদের। বনসল বলেন, “এর আগে যে সব সংগঠন এই ধরনের কাজ করেছে, একই ভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তাদের নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি। তাই একেবারে অন্ধকারে হাতড়ানো হচ্ছে না।”
গোয়েন্দারা বলছেন, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন সম্প্রতি ‘৩১৩ স্কোয়াড’ নামে একটি দল গঠন করে নতুন লোক নিয়োগ করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। গত কালের ঘটনা সেই সব নতুন নিযুক্ত জঙ্গিদের কাজও হতে পারে। তাই কোনও ঝুঁকি না নিয়ে ভিড়ে ঠাসা বাজারে বোমা লুকিয়ে রাখার মতো নাশকতার সহজ উপায় বেছে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। তবে বারবার মুম্বই কেন? চিদম্বরম অবশ্য আলাদা করে মুম্বইকে বেছে নেওয়ার কোনও কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন না।
দিন কয়েক আগে মহারাষ্ট্র থেকে আইএম-জঙ্গি সন্দেহে ইরফান ও আয়ুব শেখ নামের দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা ২০০৮ সালে আমদাবাদ ও সুরাতের বিস্ফোরণে জড়িত ছিল। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের যোগসূত্রের সন্ধান করতে গিয়ে ওই দু’জনকেও জেরা করা হচ্ছে। কারণ তাদের সঙ্গে আইএম-জঙ্গি আফজল উসমানি মুতালিকের যোগাযোগ ছিল বলে জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা। এই মুতালিককে আবার আইএম-র পাণ্ডা রিয়াজ ভটকল গুজরাতে বিস্ফোরণের জন্য গাড়ি জোগাড় করার দায়িত্ব দিয়েছিল। আইএম-র আরেক পাণ্ডা আবদুস সুবহান উসমান কুরেশি এবং আবু ফয়সলও মহারাষ্ট্রের। কাজেই সেখানে বেশ
ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সূত্রেই উঠছে লস্কর-ই-তইবার নাম। কারণ আইএম-কে নিয়ন্ত্রণ করে লস্কর। আর সেই সূত্রে পাকিস্তানের প্রসঙ্গও উঠছে। চিদম্বরম আজ স্পষ্টই জানিয়েছেন, পাকিস্তান-আফগানিস্তান সন্ত্রাসের ভরকেন্দ্র। তদন্তে নেমে সে কারণে পাক জঙ্গি সংগঠনগুলির কথাও মাথায় রাখছেন গোয়েন্দারা। |