|
|
|
|
টান পড়েছে প্রাণশক্তিতেই |
আমজনতার মুখে সেই অসহায়তা, চিদম্বরমেরও |
অনিন্দ্য জানা • মুম্বই |
স্টুপিড কমন ম্যান!
আজ সকালে ধুম বৃষ্টির মুম্বইয়ে নেমেই আচম্বিতে এই তিনটে শব্দ মনে পড়ল।
হিন্দি সিনেমার আগ্রাসী দর্শকরা জানেনই। অ্যামেচার বলিউড-দর্শকদের বলা যেতে পারে এই মুম্বই এবং তার বিস্ফোরণ-দীর্ণ অতীতের পটভূমিকায় জনৈক নীরজ পান্ডের তোলপাড় ফেলা ছবি ‘আ ওয়েডনেসডে’র কথা। বলা যেতে পারে, মুখ্য চরিত্রের মুখ থেকে ছিটকে আসা নিজের পরিচয়। কে সে? না, ‘স্টুপিড কমন ম্যান’! নির্বোধ সাধারণ মানুষ। আহত, ক্ষিপ্ত অথচ অসহায়। এই মুম্বইয়ের বাসিন্দা।
কোন মুম্বই? কোন বাসিন্দা?
সেই বাসিন্দা, যারা কাজে বেরোয়। কিন্তু জানে না, বাড়ি ফিরবে কিনা। সেই বাসিন্দা, যাদের দিনরাতের প্রতিটি সময় কাটে এক অদ্ভুত আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তায়। কিন্তু নাচার তারা, নিরুপায় তারা সেটা মেনে নিতে বাধ্য হয়। যেমন হল গত কাল। বাড়ি ফিরলেন না নিহত-আহত মিলিয়ে প্রায় দেড়শো জন।
কী আশ্চর্য সমাপতন! কালও ছিল একটা বুধবার। আ ওয়েডনেসডে!
যে বুধবার আম-মুম্বইকরকে কলার ধরে এক ঝটকায় আবার দাঁড় করিয়ে দিল বাস্তবের সামনে। মাত্র ২০ মিনিটের তিনটে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঝাঁকুনিতে খসে পড়ে গেল ২৬/১১-উত্তর যাবতীয় প্রতিজ্ঞা এবং বহ্বাস্ফোট। ৩১ মাস পরে সেই ২৬/১১-র দিনগুলো আবার ঝপ করে চলে এল গায়ের ওপর। যাকে আপ্রাণ ভুলতে চেষ্টা করছিল সে, যে আতঙ্কের ছায়া থেকে পালাতে চেষ্টা করছিল প্রাণপণ। সে। তারা স্টুপিড কমন ম্যান। নির্বোধ সাধারণ মানুষ।
জাভেরি বাজার, অপেরা হাউস এবং দাদার সন্ধে ৬টা ৪৫ মিনিটে শুরু। ৭টা ৫ মিনিটে শেষ। মাত্রই কুড়িটা মিনিট। কিন্তু কী নিদারণ অভিঘাত! মাত্র কুড়ি মিনিটে ছিন্নভিন্ন ১২১ কোটির দেশে উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধের যাবতীয় বর্ম। বেআব্রুও বটে। |
|
সেই ১৯৯৩ সাল থেকে বারবার উগ্রপন্থার হাতে আক্রান্ত ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী। প্রথম প্রথম ‘কভার’ করতে এসে শুনতাম, বিখ্যাত ‘মুম্বই স্পিরিটে’র কথা। শুনতাম, এ সব হামলা ছাড়িয়ে তেড়েফুঁড়ে ওঠে মুম্বই। কাজে যায়। জীবন চালিয়ে নেয়। শুনতাম, এমন হামলা মুম্বইয়ের মনোভাব আরও দৃঢ় করে। কঠোর করে। আরও প্রতিজ্ঞা ভরে দেয় আরব সাগরের তীরের আমজনতার ভিতরে। হবে হয়তো। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, মুম্বইয়ের সেই ‘স্পিরিট’ এবং বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে। যেমন অঝোর বৃষ্টিতে নিভে যাচ্ছে মুম্বই-স্পিরিটের বহুল প্রচারিত এবং দৃশ্যমাধ্যম-নির্মিত ‘শান্তির অভিজ্ঞান’ মোমবাতির শিখা। কখনও একশো, কখনও দেড়শো, কখনও দুশো। কিন্তু সংখ্যা দিয়ে কীই বা আসে-যায়? সে সব তো আমাদের মতো পেশাদাররা মাপবে। এবং ভাববে, সংখ্যার নিরিখে কত বড় হল ঘটনাটা। ভাববে, মুম্বইয়ের মানচিত্রে এই কালির ছোপটা কত বড় হল। ক্যালেন্ডারে খুঁজবে, কত দিন পর হল যেন আবার?
খুব নির্মোহ মন নিয়ে ভাবলে মুম্বইয়ের মতো বিস্ফোরণ-বায়োডাটা সম্পন্ন শহরে এটা কোনও নিহতের সংখ্যাই নয়! ১৮! ২০০৬ সালের ১১ জুলাই মুম্বইয়ের লোকাল ট্রেনে বিস্ফোরণের পাঁচ বছর পূর্ণ হল এই তো গত তরশু। সেখানেও তো নিহতের সংখ্যা কত কত বেশি ছিল! কিন্তু এই সংখ্যাগুলো তো আসলে কারও বাবা, কারও মা, কারও ভাই বা বোন। নির্বোধ সাধারণ মানুষ একেক জন। স্টুপিড কমন ম্যান!
ভরা বর্ষার মরসুম এখন। গত কাল রাত থেকেই তেড়ে বৃষ্টি নেমেছে। এখনও চলছে। সেই বৃষ্টির ধারায় কি ধুয়েমুছে যাচ্ছে জনতার উদগ্র ক্রোধ? জানা নেই। ঘটনার ১২ ঘণ্টার কিছু পরে এক এক করে তিনটে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখতে গিয়ে মনে হল, ধুয়েই গিয়েছে রক্তের ধারাস্রোত। খুব ঠান্ডা মাথায়, ধীরেসুস্থে, পরিকল্পনা করে এমন তিনটে এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, এমন সময় ঘটানো হয়েছে, যেখানে সেই সন্ধেয় প্রবল ভিড় থাকে। কী করে তাঁরা জানবেন, বর্ষার মরসুমে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা আপাত নিরীহ ফোল্ডিং ছাতার তলায় রাখা থাকবে কালান্তক বিস্ফোরক? অথবা তাঁদের মৃত্যুবাণ রাখা থাকবে দাদার স্টেশনের পাশে সাধারণ ইলেকট্রিক মিটার বক্সে? কিংবা রাস্তায় পার্ক করে রাখা সার সার স্কুটার বা মোটরবাইকের মধ্যে কোনও একটায় রাখা থাকবে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, ইলেকট্রিক তার এবং সাধারণ সেলফোনে জড়ানো একটা পুঁটলি?
কী করে জানবেন? সব নির্বোধ সাধারণ মানুষ যে! |
|
|
এ বার হামলার কোনও আগাম
ইঙ্গিত ছিল না। চমক দেওয়ার
সুবিধা জঙ্গিদের আছে।
মনমোহন সিংহ |
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি
যে, এই হামলা সম্পর্কে আগে
থেকে কোনও তথ্য ছিল না।
পি চিদম্বরম |
মোট নিহত |
১৮ |
মোট আহত |
১১৩ |
গুরুতর আহত |
২৩ |
|
|
যেমন জানবেন না পালানিয়াপ্পন চিদম্বরম। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আজ সকালে জনাকীর্ণ সাংবাদিক বৈঠকে যে কী অসহায় লাগছিল তাঁকে! হার্ভার্ড-চর্চিত ইংরেজিও মিইয়ে গিয়েছে। তবে কিনা ঘোড়েল রাজনীতিক। তীক্ষ্ন, আক্রমণাত্মক সব প্রশ্নে শান্ত ভাবটা কোনও ক্রমে ধরে রাখলেন বটে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কোথাও একটা নির্ঘাৎ উচাটন ছিল। স্বাভাবিক। স্রেফ অন্ধকারে হাতড়াচ্ছেন তো! এমন একটা ঘটনার পর কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী দায় স্বীকার করেনি। শান্ত আত্মসমর্পণী
ভঙ্গি ছাড়া উপায় কী? নইলে কি আর বিনা ভূমিকায় বলে ফেলেন, “এই হামলার কোনও আগাম গোয়েন্দা তথ্য আমাদের কাছে ছিল না। এটা দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু ঘটনা। তা বলে একে সরাসরি গোয়েন্দা-ব্যর্থতা বলে দেখাটা উচিত হবে না।” কিম্বা বলেন, “কেউ এই ঘটনার দায় স্বীকার করেনি। আমাদের কাছে সকলেই সন্দেহভাজন। আমরা সমস্ত জঙ্গিগোষ্ঠীর ভূমিকাই খতিয়ে দেখছি।”
এতে কি পাকিস্তানের কোনও ভূমিকা রয়েছে?
চিদম্বরম: “এ ভাবে কোনও কিছু স্পেকুলেট করবেন না। এটা ঠিকই যে, আমাদের সীমান্তটা একটু গোলমেলে। কিন্তু কোনও অনুমানের উপর ভিত্তি করে কিছু লিখবেন না প্লিজ। যেটা ঘটনা, সেটাই তুলে ধরুন। আমরা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর আপনাদের যথাসম্ভব তথ্য দেব। প্রমিস! কিন্তু আপনারা দয়া করে তার বাইরে কিছু লিখবেন বা বলবেন না।”
পাশে মুখ গোঁজ করে বসা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ, রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর আর পাটিল, সদ্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে শপথ নেওয়া তরুণ রাজনীতিক তথা মুম্বইয়ের বাসিন্দা মিলিন্দ দেওরা এবং মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার অরূপ পট্টনায়ক। তাঁর দিকে তাকিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানতে চাইলেন, “মুম্বই পুলিশের মুখপাত্র কে?” নিচু গলায় জবাব এল, “রাকেশ মারিয়া।” চিদম্বরম বললেন, “রাকেশ মারিয়া মুম্বই পুলিশের মুখপাত্র। তিনি যা বলবেন, আপনারা দয়া করে তা-ই লিখবেন। আবার বলছি, দয়া করে এমন কিছু লিখবেন না, যাতে তদন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
মারিয়া বিকেলে যা বলার বললেন। আসলে নতুন কিছুই বললেন না। তাঁর বক্তব্যের নির্যাস মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ এবং অ্যান্টি-টেররিস্ট স্কোয়াড মিলে যৌথ তদন্তকারী বাহিনী তৈরি হয়েছে। তারা কাল রাত থেকে তিনটি জায়গারই ক্লোজড-সার্কিট টিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছে। সমস্ত দিক থেকেই সূত্র খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। মারিয়া আরও যা বললেন না, বর্ষার মুম্বইয়ে সমস্ত ফুটেজেই জনতার শরীরের নড়াচড়া ঢাকা পড়েছে সার সার ছাতার তলায়! যা থেকে নির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো অত্যন্ত কঠিন। বললেন না, রাতে ঘটনাস্থলে এসে ফরেন্সিক টিম যখন তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে শুরু করে, তত ক্ষণে বৃষ্টিতে অনেক কিছুই ধুয়ে গিয়েছে। ত্রিপল দিয়ে ঢাকাঢুকি দেওয়ার একটা চেষ্টা হয়েছিল বটে। কিন্তু সে তো অনেক পরে। ঘটনাস্থলের দায়িত্বে-থাকা এক পুলিশ অফিসারের বিস্মিত বক্তব্য, “খালি হাতে এ ভাবে কি প্রমাণ সংগ্রহ করা যায়? নাকি করা উচিত?”
যায় না তো। কিন্তু চুটিয়ে রাজনীতিটা করা যায়। যেমন করলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। ঘটনাস্থলে এসে, হাসপাতালে ঘুরে কড়া আক্রমণ করলেন কংগ্রেসকে। কাঠগড়ায় তুললেন পাকিস্তানকে। চিদম্বরমকে লক্ষ করে বললেন, “গোয়েন্দা-ব্যর্থতা নয়। এটা আসলে সরকারের নীতির ব্যর্থতা। আমাদের সরকারের আমলে আমরা জিরো-টলারেন্সের নীতি নিয়েছিলাম। এরা সে সব কাজে নেই। এই সরকার এমনিতেই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এখন দেশের মানুষের জীবনটাও রক্ষা করতে পারছে না। এদের উচিত, অবিলম্বে দেশে নির্বাচন ঘোষণা করা।”
তত ক্ষণে ভুবনেশ্বর সফরের সাংবাদিক বৈঠকে ব্যাপারটা আরও ঘেঁটে ফেলেছেন রাহুল গাঁধী। বলেছেন, “আমাদের মতো দেশে সমস্ত জঙ্গি হামলা ঠেকানো সম্ভব নয়! সরকার চেষ্টা করে ৯৯ শতাংশ হামলা ঠেকাতে পারে। কিন্তু সব হামলা ঠেকানো অসম্ভব।” ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এই সব স্পর্শকাতর সময়ে কেউ এ সব বলে! তা-ও আবার যখন তাঁকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী ভাবা হচ্ছে! মানুষের প্রাণ নিয়ে যেখানে রাজনীতি হয়, সেখানে এই তথাকথিত অর্বাচীনতা ক্ষমাসুন্দর চোখে কে দেখবে?
সেই ‘বিপর্যয়’ সামাল দিতেই বোধহয় সন্ধেয় মুম্বই উড়ে আসতে হল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধীকে। তদন্ত এবং নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ বৈঠক করতে হল দ্রুত। মুম্বইয়ে নেমে স্বঘোষিত ‘সবল’ প্রধানমন্ত্রী আর্কাইভ
থেকে পুরনো টেপ ঝেড়েঝুড়ে রি-ওয়াইন্ড করলেন, “আমি মুম্বইয়ের মানুষের শোক, দুঃখ এবং ক্রোধ বুঝতে পারছি। আমি তাঁদের সমব্যথী। ভবিষ্যতে এমন হামলা ঠেকাতে যা যা করণীয়, সমস্ত করবে সরকার। দোষীরা অবিলম্বে ধরা পড়বে। তাদের কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হবে।”
নীল পাগড়ির মিতভাষী সর্দারকে শুনতে শুনতে সকালে তাঁর মন্ত্রিসভার সহকর্মীর অসহায় মুখটা মনে পড়ছিল। চিদম্বরম বলছিলেন, ‘‘জীবনের সার সত্য হল, মুম্বইয়ে আবার একটা সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মুম্বইকরের এর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা ছাড়া উপায় কী?”
সাধারণ মুম্বইকর। নির্বোধ সাধারণ একেক জন মানুষ। স্টুপিড কমন ম্যান! |
|
|
|
|
|