|
|
|
|
সার্কাসের তাঁবুতে ২ |
জেব্রা চেনায় নকল ডোরাই |
|
সুব্রত সীট • দুর্গাপুর
জোকারের রংচঙে জোব্বা বা শিম্পাঞ্জির আড়ালে লুকোনো শুকনো মুখ।
ঘোড়ার গায়ে জেব্রার ডোরা। পর্দা নেমে গেলে ঠিক কেমন
সার্কাসের তাঁবুর অন্দরমহল। উঁকি দিল আনন্দবাজার। |
|
একটা শিম্পাঞ্জি আর একটা জেব্রা। কেউ লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে, কেউ বা আগুনের রিংয়ের ভিতর দিয়ে গলে চেষ্টা করে হাততালি কুড়নোর। দর্শকদের মন জয় করতে ওদের জুড়ি মেলা ভার। ওদের সবচেয়ে বড় মিল, ওরা দু’জনেই পাকা অভিনেতা।
ওড়িশার তুলসীদাস ও পুরুলিয়ার নাটু। দুর্গাপুরের গাঁধী মোড় ময়দানে যে সার্কাসের আসর বসেছে সেখানে এক জন শিম্পাজি আর এক জন জেব্রা। ওরা যখন মজার মজার খেলা দেখিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করছে, তখন পর্দার আড়ালে সার্কাসের কর্মকর্তারা কিন্তু ভুগছেন বিবেকের দংশনে। দু’টি জন্তুই যে নকল! আইনের কড়াকড়িতে বাধ্য হয়ে এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা।
১৯৮৪ সালে গড়ে ওঠা এই সার্কাসের দলে এক সময় প্রায় এক ডজন বাঘ ছিল। ছিল সিংহও। রিং মাস্টার চাবুক কষাতেন। আর বাঘ-সিংহের দল হুঙ্কার ছাড়ত। তা দেখে দর্শকাসনে বসে ছোটরা বটেই, বড়দেরও অনেকেরই হাড় হিম হয়ে যেত। তবে আজ সব অতীত। এখন পাঁচটি হাতি, ছয়টি ঘোড়া, কয়েকটি কুকুর, ম্যাকাও ও কাকাতু্য়া পাখি এবং একটি জলহস্তিই সম্বল। আর আছে নকল শিম্পাঞ্জি ও নকল জেব্রা।
সার্কাস কর্তৃপক্ষ জানালেন, এখন আইনে বাঘ, সিংহ রাখা যায় না। হাতি, কুকুর, পাখির খেলা দিন দিন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়েই নতুন কিছু করার চেষ্টা করতে হচ্ছে। তাই জোকার তুলসীদাসকে কালো মোটা উলের জামাকাপড় পড়ে অভিনয় করতে হচ্ছে শিম্পাঞ্জির চরিত্রে। গায়ে হলুদ ও কালো রঙের ডোরাকাটা দাগ এঁকে জেব্রা সাজানো হচ্ছে খর্বাকৃতি ঘোড়া নাটুকে। |
|
ময়ূরভঞ্জের বাসিন্দা তুলসীদাস নায়েক। গত আড়াই দশক ধরে সন্ধ্যায় সার্কাসের তাঁবুতে দশর্কদের হাসাতে বিরাম নেই তাঁর। ‘সার্কাসের জোকার’ তিনি। কিন্তু তাতে আর মন ভরছিল না দর্শকদের। তাই বছর তিনেক আগে কর্তৃপক্ষ ভাবলেন, নতুন কিছু করতে হবে। তখনই শিম্পাঞ্জির কথা মাথায় আসে। কিন্তু জোকারদের কেউ কি নিজেদের রূপ ভুলে শিম্পাঞ্জি সাজতে রাজি হবে? কিন্তু প্রস্তাব শুনেই লুফে নেন তুলসীদাস। তাঁর কথায়, “রোজগার নিশ্চিত হওয়া নিয়ে কথা। আপত্তি থাকবে কেন? সৎ পথে থেকে যে কোনও কাজ করতে রাজি আমি।” এই ভাবেই মুখোশের আড়ালে থাকা জোকার যে কখন শিম্পাঞ্জি হয়ে গেল, চোখে পড়ল না কারও। সার্কাসের ম্যানেজার রাজ জানালেন, তুলসীদাস না কি দারুণ কাজ করছেন।
এতো গেল তুলসীদাসের কথা। কিন্তু বহু বছর আগে পুরুলিয়া থেকে নিয়ে আসা নাটু? লম্বা-চওড়া ঘোড়াদের মাঝে খর্বাকৃতি নায়ুই সবচেয়ে শান্ত। মাঝে মাঝে ছোট্ট লেজ নাড়িয়ে মশা-মাছি তাড়ায় আর জেব্রাদের ঢংয়ে ঘাড় উঁচু করে দেখে। নাটুকে দেখভাল করেন কার্তিক রক্ষিত। তাঁর কথায়, “মাসে এক বার রং করতে হয় নাটুকে। মেহেন্দি ও বিশেষ রং একসঙ্গে মিশিয়ে সারা গায়ে রং করা হয়। তবে খেয়াল রাখতে হয়, যাতে হলুদ ও কালো রংয়ের ডোরের মাঝের দূরত্ব নির্দিষ্ট থাকে। তা হলে কিন্তু বেমানান লাগবে। স্নান করানোর সময়ও সতর্ক থাকতে হয়।” আর জেব্রার মতো হাবভাব না কি নাটুর জন্মগত। ম্যানেজার রাজ বলছেন, “নাটু আমাদের সম্পদ। অনেক বয়স হয়েছে। তাই সার্কাসের সবাই এখন ওকে দাদু বলে।”
দর্শকরা না হয় দুধের সাধ ঘোলে মেটালেন। কিন্তু তুলসীদাস বা নাটুকে আশ্রয় করে সার্কাস কি বাঁচবে? আশার আলো দেখছেন না কর্তৃপক্ষ “এত মানুষ জড়িয়ে। জানি না এ ভাবে চললে আর কত দিন!”
আলোর রোশনাই আর দর্শকের হাততালিতে আরও মুখ লুকলো বিপন্নতা। |
(শেষ) |
|
|
|
|
|