|
|
|
|
ট্রেন বাড়লেও কমেছে কর্মীঅতিরিক্ত |
বিনা বিশ্রামে বিপজ্জনক ট্রেন সফরে চালকরা |
শুভাশিস ঘটক • কলকাতা |
ট্রেন চালাতে গিয়ে বিশ্রাম পাচ্ছে না ইঞ্জিনগুলো। তাই বিকল হয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। মলওয়াঁয় কালকা মেলের দুর্ঘটনার পরে এই অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু শুধু ইঞ্জিন কেন, ট্রেনের চালকদেরও কি পর্যাপ্ত বিশ্রাম জুটছে?
গত তিন বছর ধরে সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেন চালাচ্ছেন রেলের ‘গ্রেড-ওয়ান’ চালক প্রবীর বর্মন (নাম পরিবর্তিত)। হাওড়া থেকে ধানবাদ অথবা মোগলসরাই পর্যন্ত দূরপাল্লার ট্রেন নিয়ে যাওয়া আসা করেন তিনি। প্রবীরবাবুর বক্তব্য, হাওড়া থেকে ধানবাদ যেতে পাঁচ ঘণ্টা লাগে। অধিকাংশ দিনই তার সঙ্গে যোগ হয় ট্রেন লেটের সময়। তার পর পৌঁছে ‘রিপোর্ট’ জমা দিতে দিতেই অনেকটা সময় কেটে যায়। ফের ট্রেন নিয়ে হাওড়া রওনা হওয়ার মাঝখানে বেশির ভাগ দিনই তিন ঘণ্টাও বিশ্রাম পান না তিনি। গত দু’ বছর ধরে কার্যত এ ভাবেই ডিউটি করে চলেছেন প্রবীরবাবু। তিনি বলেন,“পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়ে কাজ করতে করতে আমি শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্লান্ত, বিপর্যস্ত। কয়েক বার এমনকী চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছি। কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে ঝুঁকি নিতে পারিনি।”
রেলের নিয়ম অনুযায়ী, টানা ৮ ঘণ্টা ট্রেন চালানোর পর অন্তত ৫ ঘণ্টা বিশ্রাম পাওয়ার কথা চালকদের। ৬ দিন এ ভাবে কাজ করার পরে চালকেরা
৩২ ঘণ্টা টানা বিশ্রাম পাবেন। রেলের চালকদের অভিজ্ঞতা কিন্তু উল্টো কথা বলছে। প্রায় সব চালকেরই বক্তব্য, ৩২ ঘণ্টা বিশ্রামের কথা তাঁরা ভুলেই গিয়েছেন। অনেক সময়ে টানা ১৬ ঘণ্টাও কাজ করতে হচ্ছে। শরীর অসুস্থ হয়ে পড়লেও ছুটি নেই।
যেমন হয়েছিল, হাওড়া-পাঁশকুড়া লোকালের চালক ডি এন মৈত্রের। গত জানুয়ারিতে কতর্ব্যরত অবস্থাতেই প্ল্যাটফর্মে অচৈতন্য হয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওই চালকের মৃত্যু হয়েছিল বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। ওই মৃত্যু ঘিরে বিতর্ক দানা বাধে। অল ইন্ডিয়া লোকো রানিং স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিধুভূষণ দত্ত বলেন, “আমরা জানতে পারি, ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মৈত্রবাবু। তিনি তাঁর অসুস্থতার কথা আধিকারিকদের জানান।” কমিটির দাবি, বদলি চালকের ব্যবস্থা করার আর্জিও জানান তিনি। তা শোনা হয়নি। নিধুভূষণবাবু বলেন, “অসুস্থ অবস্থাতেই ট্রেন চালাতে বাধ্য করা হয় বি এন মৈত্রকে। আমরা বিষয়টি নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করি। তার তদন্ত চলছে।”
কেন এমন ভাবে কাজ করতে হচ্ছে ট্রেনের চালকদের?
রেল দফতরের এর পদস্থ অফিসার বলেন, “১৯৭৪ সালে গোটা দেশে রেলের সব ক’টি জোন মিলিয়ে চালক ছিলেন ৯৬ হাজার। ২০১১ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজারে। অথচ এর মধ্যে ট্রেনের সংখ্যা অন্তত দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে নাভিশ্বাস উঠছে চালকদের। এক্সপ্রেস থেকে লোকাল ট্রেন, সব ক্ষেত্রেই এক অবস্থা। চালকদের অভিযোগ, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে একের পর এক ট্রেন চালু করা হয়েছে, কিন্তু তা চালাতে যে লোকের দরকার, এই সহজ কথাটি কোনও মন্ত্রী ভাবেননি। রেল কর্তাদের বক্তব্য, এখনই অন্তত সাড়ে ৪ হাজার চালক নিয়োগ করা হলে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া যেতে পারে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পেয়ে কাজের সময়ে কী কী অসুবিধা বোধ
করেছেন চালকেরা?
চালকদের বক্তব্য, ইঞ্জিনের গরমে কাজ করতে করতে ঝিমুনি আসে। শরীরের জলের পরিমাণ অসম্ভব কমে যায়। ফলে বার বার পেটের গোলমাল হয়। চাপ পড়ে চোখের উপরে। বাড়তে থাকে নেশা করার প্রবণতাও। এর ফলে বিপদের আশঙ্কা বেড়ে যায় অনেক গুণ।
চালকদের ওই বক্তব্য সমর্থন করেছেন চিকিৎসক এবং মনোবিদেরা। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পর্যাপ্ত বিশ্রাম ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেন চালানোর মতো মানসিক-শারীরিক চাপের কাজ করে গেলে মনঃসংযোগের অভাব ঘটতে বাধ্য। এতে চালকদের সতর্কতাবোধও শিথিল হয়ে পড়ে। খিটখিটে ভাব আসতে পারে, আসতে পারে বেপরোয়া মনোভাব, যাত্রী নিরাপত্তার দিক দিয়ে যা মারাত্মক।” মনোবিদ মোহিত রণদীপও জানিয়েছেন, “বেশ কিছু ট্রেন চালক মারাত্মক চাপ সহ্য করতে না-পেরে মনোবিদদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। তাঁরা ছুটি পাচ্ছেন না, বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। ফলে অবসাদগ্রস্থ হচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে কাজের উপর। হাজার হাজার মানুষের জীবনও বিপন্ন হচ্ছে।” |
|
|
|
|
|