সিপিএমকে আরও কোণঠাসা করতে ময়দানে ‘নেত্রী’ মমতা
সুকৌশলে এবং সুনিপুণ ভাবে বামফ্রন্টের অন্দরে সিপিএমকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে সোরগোল ফেলে দিয়েছেন শরিক মহলেও।
এবং যে মমতা এই প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তিনি ‘মুখ্যমন্ত্রী’র চেয়ে অনেক বেশি ‘তৃণমূল নেত্রী’ মমতা।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাতে যেমন ‘আমরা-ওরা’র বেড়া ভাঙার প্রকাশ্য বার্তা থাকছে, তেমনই অন্তর্নিহিত ‘রাজনৈতিক’ বার্তা থাকছে ফ্রন্টের শরিকদের জন্যও। সে বিধানসভায় তাঁর প্রথম বক্তৃতায় স্পিকারের কাছে বিরোধীদের বেশি সময় দেওয়ার আবেদনই হোক বা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামীর স্ত্রী-কে মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন করাই হোক।
ক্ষিতিবাবুর স্ত্রী সুনন্দা মুখোপাধ্যায়কে মমতা যে পদে নিয়ে এলেন, এর ঠিক আগে সেখানে ছিলেন সিপিএম নেত্রী মালিনী ভট্টাচার্য। একমাত্র যাঁর কাছে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে মমতাকে ভোটে হারতে হয়েছিল। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর মালিনীদেবী ওই পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার দু’সপ্তাহের মধ্যে মমতা সিপিএমের মালিনীদেবীর পদে আরএসপি-র প্রথম সারির নেতার স্ত্রী সুনন্দাদেবীকে নিয়োগ করেছেন। সেদিক দিয়েও মমতার ওই সিদ্ধান্ত যথেষ্ট ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
বস্তুত তৃণমূলের একাধিক প্রথম সারির নেতা মনে করেন, এই বিশাল নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর সিপিএমে এমনকী ভাঙন ধরাও আশ্চর্য নয়। সে ক্ষেত্রে সামগ্রিক ভাবে ভাঙন ধরতে পারে ফ্রন্টেও। ভবিষ্যতে তেমন কিছু সত্যিই ঘটলে বাম শরিকদের মধ্যে অনেকে তৃণমূলের সঙ্গে চলে আসতে পারেন বলে এই নেতাদের ধারণা। রবিবার যেমন তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বললেন, “বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর সিপিএমের ভিতরে যা অবস্থা, তাতে দল ভেঙে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। সে ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ভাবেও সিপিএম অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে। শরিকদের উপরেও দাদাগিরি বন্ধ হবে। তখন বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ শরিকরাও সিপিএমের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করবে। এত দিন তারা যেটা সে ভাবে পারেনি। তার ফলে সিপিএমের সঙ্গে শরিকদের অ-বনিবনা হওয়াই স্বাভাবিক।”
এ-ও স্বাভাবিক যে, মমতা সেই ‘অ-বনিবনা’র সুযোগ নিতে চাইবেন। ইতিমধ্যেই তাঁর মতো করে তিনি সেই প্রক্রিয়া শুরুও করে দিয়েছেন।
বিধানসভায় ফ্রন্টের মোট বিধায়ক মাত্রই ৬২। সিপিএম নেমে এসেছিল ৪০-এ। কিন্তু বসিরহাট-দক্ষিণের বিধায়কের মৃত্যুর পর তারা আপাতত ৩৯। মমতা নিজে অবশ্য মনে করেন, কংগ্রেসের একাংশ ‘গুরুত্ব’ দিয়ে জোট করলে সিপিএমকে আরও কোণঠাসা করা যেত। আরও কমে যেত তাদের আসনসংখ্যা। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “বিরোধী দল হিসেবে সিপিএম যে আমাদের পদে পদে বাধা দেবে, সেটা আমরা জানি। কিন্তু ফ্রন্টের একাধিক শরিক দলের নেতারা মনে করছেন, পরিবর্তিত সরকারকে মসৃণ ভাবেই চলতে দেওয়া উচিত। সে দিক দিয়ে সিপিএমের সঙ্গে তাঁদের মৌলিক তফাত রয়েছে।” ওই নেতার আরও বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা যে ভাবে ‘আমরা-ওরা’র বেড়া ভাঙতে চাইছেন, তাতে শরিক দলের তরফে ‘সদর্থক’ সাড়া এলেও সিপিএমের তরফে তেমন কোনও ‘ইতিবাচক’ সাড়া পাওয়া যায়নি।
বস্তুত বিধানসভায় স্পিকার নির্বাচনের দিন বক্তৃতা দিতে উঠে মমতা যে ভাবে বিরোধীদের বেশি সময় দেওয়ার আর্জি বা সদ্য-প্রয়াত সিপিএমের বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাশেমকে ‘মোস্তাফা ভাই’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, তাতে ফ্রন্টে অধিকাংশ বিধায়কই দৃশ্যত আপ্লুত ছিলেন। প্রাক্তন পরিষদীয় মন্ত্রী প্রবোধচন্দ্র সিংহ তো বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেই ফেলেন যে, ‘বিপুল জয়ে’র পরেও মমতা যে ‘নমনীয়’ মনোভাব দেখিয়েছেন, তা যথেষ্ট প্রশংসার্হ। কিন্তু বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্র ওই বক্তৃতার অব্যবহিত পরেই জানান, ওঁদের (সরকার পক্ষের) কাজে এবং কথায় যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। সূর্যবাবু-সহ সিপিএমের নেতাদের লাগাতার বক্তব্য, প্রকাশ্যে বিরোধীদের ‘মর্যাদা’ দেওয়ার কথা বললেও গ্রামেগঞ্জে ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই তাঁদের সদস্য-সমর্থকদের উপর ‘তৃণমূলের হামলা’ চলছে। এক বার মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে দেখা করে ‘হামলা’ বন্ধের আবেদন এবং তার আগে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে দেখা করে বিহিত চাওয়া ছাড়া শরিক দলের তরফে কিন্তু ওই বিষয়ে টানা কোনও প্রচার করা হচ্ছে না। এমনকী, তৃণমূল সূত্রের খবর, সম্প্রতি মহাকরণে সূর্যবাবুর নেতৃত্বে বাম শরিকরা যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখনও শরিক নেতাদের ‘মনোভাব’ মুখ্যমন্ত্রীর যথেষ্ট ‘ইতিবাচক’ মনে হয়েছে।
এই প্রেক্ষিতেই মমতা তাঁর কৌশলী চাল দিয়েছেন।
বিধানসভায় বিরোধীদের ‘মর্যাদা’ দেওয়ার আর্জি জানানোর এক সপ্তাহের মধ্যে মমতা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে তাঁর তরফে শরিক দলের প্রতি ‘বার্তা’ যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ। আরএসপি-র প্রথম সারির নেতা ক্ষিতিবাবুর স্ত্রীকে মমতা মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন মনোনীত করায় ফ্রন্টের অন্দরে যথেষ্ট তরঙ্গ তৈরি হয়েছে (পাশাপাশি, বিতর্ক তৈরি হয়েছে ক্ষিতিবাবুর দলেও। প্রাথমিক ভাবে দলের একাংশ চেয়েছিলেন, ক্ষিতিবাবু স্ত্রীকে ওই পদ নেওয়া থেকে বিরত রাখুন। প্রাক্তন মন্ত্রীর তরফে সে চেষ্টা করাও হয়েছিল। কাজ হয়নি)। সিপিএম প্রকাশ্যে ওই ঘটনায় কিছু না-বললেও দলের রাজ্য কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, ফ্রন্টে ‘বিভেদ’ তৈরির জন্যই ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তাঁর কথায়, “এ ভাবে উনি (মমতা) ফ্রন্টের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি করতে চাইছেন। কিন্তু গত বিধানসভা ভোটে ফ্রন্ট এককাট্টা হয়ে
যেমন লড়েছে, আগামী দিনেও তেমনই অটুট থাকবে।” সিপিএমের রাজ্য নেতা যা-ই দাবি করুন না কেন, ইতিমধ্যেই কিন্তু প্রাক্তন মন্ত্রী তথা বাম শরিক নেতা কিরণময় নন্দ ‘বেসুরে’ গাইতে শুরু করেছেন। যাতে তৃণমূলের নেতাদের একাংশ আরও উৎসাহী।
Previous Story Rajya Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.