|
|
|
|
কাঠগড়ায় কারাট-বুদ্ধ-বিমান |
বিপর্যয়ের দায় নিয়ে উত্তপ্ত রাজ্য কমিটি |
সন্দীপন চক্রবর্তী ও স্বপন সরকার ² কলকাতা |
সিপিএম চেয়েছিল, বিপর্যয়ের পরে দলের অন্দরে দোষারোপের পালা যেন তীব্র হয়ে না-ওঠে। কিন্তু বিপর্যয়ের ময়নাতদন্তে দায় এবং পাল্টা দায় নিয়ে রীতিমতো উত্তপ্ত হয়ে উঠল রাজ্য কমিটির দু’দিনের বৈঠক। এক দিকে যেমন বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা বিগত সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং দলের সাংগঠনিক বিচ্যুতির প্রশ্ন তুলে ঘুরিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর সমালোচনা করেছেন, দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের দায় মূলত আলিমুদ্দিনেরই। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক যে কারণগুলির কথা রাজ্য কমিটির সদস্যদের মতামতে উঠে এসেছে, সেগুলি মূলত ‘স্থানীয়’ বা রাজ্য স্তরের বিষয় বলেই কারাট উল্লেখ করেছেন।
বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরে এই নিয়ে দু’বার রাজ্য কমিটির বৈঠক হল। একেবারে বুথ থেকে লোকাল, জোনাল স্তর হয়ে জেলা কমিটিগুলির কাছে ফলাফলের তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট এখনও পৌঁছয়নি বলে পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করা যায়নি। কিন্তু সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতেই দু’দিনের বৈঠকে একাধিক প্রতিনিধি গত তিন বছরে সরকারের ব্যর্থতা থেকে শুরু করে নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে আক্রান্ত দলীয় কর্মী-সমর্থকদের পাশে না-দাঁড়ানোর জন্য রাজ্য নেতৃত্বের সমালোচনা পর্যন্ত করেছেন। সংগঠনের কোনও স্তরেই যে ভাবে ভোটের আগে মানুষের মন বুঝতে পারা যায়নি, উঠে এসেছে সেই আলোচনাও। সরকারি তথা প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা বলে একাধিক সদস্য আসলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু এবং সাংগঠনিক ঘাটতির প্রসঙ্গ তুলে রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন বলে সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা। বুদ্ধবাবুর যাদবপুরে দাঁড়ানো উচিত হয়নি বলেও মন্তব্য করেছেন প্রাক্তন এক মন্ত্রী। |
|
জেলাগুলির প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনে জবাবি ভাষণে কারাট বলেন, এখন পরাজয় মেনে নেওয়ার সময়। এই মুহূর্তে দল ‘নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া’র মুখে দাঁড়িয়ে। সিপিএম যৌথ দায়িত্বের নীতিতে বিশ্বাসী। তাই আলাদা করে কোনও ব্যক্তি বা নেতৃত্বকে এই সময়ে দায়ী করা উচিত নয়। তবে রাজ্য কমিটির সদস্যদের বক্তব্যেই বেরিয়ে আসছে, রাজ্য স্তরে সরকার এবং সংগঠনের নানা ব্যর্থতাকেই তাঁরা চিহ্নিত করছেন। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দলকে আবার ‘পুনর্গঠিত’ হতে হবে। হায়দরাবাদে আসন্ন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ফলাফল নিয়ে বিশদে আলোচনা হবে বলেও তিনি জানান। সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যায়, ইউপিএ-১ থেকে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহার এবং তার জেরে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হওয়া এ রাজ্যে বামফ্রন্টের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ বলে এ বারের রাজ্য কমিটিতেও কথা উঠেছে। প্রবীণ এক সদস্য কারাটের উদ্দেশে প্রশ্ন তুলেছেন, রাষ্ট্রপতি হিসাবে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নামে প্রস্তাব আসা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কেন সম্মতি দেননি? কারাট অবশ্য জবাবি বক্তৃতায় ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কী পরিস্থিতিতে ওই প্রস্তাব মানা যায়নি। তাঁর দাবি, সোমনাথবাবুও তা মেনে নিয়েছিলেন। তবে এ সবের পাশাপাশি যে হেতু রাজ্য স্তরের কারণগুলিও বারবার উঠে এসেছে, তাই বুদ্ধবাবু-বিমানবাবুকে পাশে বসিয়ে কারাট সুকৌশলে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিধানসভায় বিপর্যয়ের ‘দায়’ মূলত আলিমুদ্দিনেরই।
কারাটের পরে সমাপ্তি ভাষণে বিমানবাবু স্বীকার করে নেন, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের পরে পর্যালোচনায় তাঁরা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক যে ত্রুটি-দুর্বলতার কথা বলেছিলেন, তা কাটিয়ে উঠে যে পর্যায়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেখানে তাঁরা পৌঁছতে পারেননি। নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘ধৈর্য’ রেখে দলের কাজের তৎপরতা বাড়াতে হবে। জেলার নেতাদের সমালোচনা স্বীকার করে নিয়েই তিনি বলেন, আক্রান্ত মানুষের পাশে নেতৃত্বকে দাঁড়াতে হবে। দলকে ‘সংহত’ করতে সর্ব স্তরের নেতৃত্বকে অনেক বেশি ‘শ্রম ও নিষ্ঠা’র সঙ্গে কাজ করতে হবে। তবে একই সঙ্গে এ বার ৪১% মানুষের সমর্থন পাওয়ার কথা উল্লেখ করে বিমানবাবু বলেন, হেরে গেলেও বামফ্রন্ট ‘সব কিছু হারিয়ে’ বসে নেই!
কারাট-বিমানবাবুদের আত্মসমালোচনার আগে রাজ্য কমিটির সদস্যেরা অবশ্য বিগত সরকার ও দলীয় নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও দলের পলিটব্যুরোর সদস্য বুদ্ধবাবুর এই পরিস্থিতিতে যাদবপুরে প্রার্থী হওয়াই উচিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন প্রবীণ এক প্রাক্তন মন্ত্রী। তাঁর মতে, বুদ্ধবাবুর হার জনমানসে দলের ভাবমূর্তিকে আরও ‘খাটো’ করে দিয়েছে।
বিগত মন্ত্রিসভার আর এক সদস্য আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা এ দিন বৈঠকে বলেছেন, ভূমিমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কোথায় কার জন্য কত জমি অধিগ্রহণ হচ্ছে, তিনি জানতে পারতেন না। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী (নিরুপম সেন) ছাড়া বাকি মন্ত্রিসভাকেও অন্ধকারে রাখা হত। কী পদ্ধতিতে জমি অধিগ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও নীতি তৈরি করা হয়নি। যার ফল সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম।
প্রসঙ্গত, দলের বাইরে রেজ্জাক এই নিয়ে অনেক বার মুখ খোলায় তাঁকে ‘ভর্ৎসিত’ হতে হয়েছিল। এ বার দলীয় নেতৃত্বের পরামর্শ মেনেই দলীয় মঞ্চে তিনি নেতৃত্ব তথা বিগত সরকারের সমালোচনা করলেন।
আবার রেজ্জাকের বক্তব্যের আগেই তাঁর আচরণের সমালোচনা করে কয়েক জন বলেন, দলের কর্মীরা যখন আক্রান্ত হচ্ছেন, সেই সময় প্রবীণ নেতা হয়েও রেজ্জাক বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাত মেলাতে যাচ্ছেন (রেজ্জাকের ওই পদক্ষেপ ছিল অবশ্য নেহাতই সৌজন্য)। এমনকী, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি ফোনে কথা বলছেন এবং প্রয়োজনে আরও কথা বলবেন বলেছেন! রেজ্জাকের অবশ্য দাবি, তিনি নিজে থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করতে যাননি।
বস্তুত, যে জেলাগুলিতে লোকসভা ভোটে বাকি রাজ্যের তুলনায় ভাল ফল হয়েছিল এবং বিধানসভায় তা-ও মুছে গিয়েছে, সেই জেলাগুলির প্রতিনিধিরা সমালোচনায় আরও মুখর ছিলেন। রাঢ় বঙ্গের এক জেলা সম্পাদক যেমন বলেছেন, গত তিন বছর রাজ্যে কোনও সরকার ছিল বলে মনেই হয়নি! কল্যাণমূলক প্রকল্পের সুফলও নিচু তলায় মানুষের হাতে পৌঁছয়নি।
একাধিক সদস্যের মতে, এর জন্য প্রশাসনিক প্রধান ছাড়াও রাজ্য সম্পাদকও সমান দায়ী। তাঁরা মনে করছেন, দল সরকারের কাজ পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং, সরকারই দলকে পরিচালনা করেছে এবং তাতে ভরাডুবি ঠেকানো যায়নি! রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরাও সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পাননি। বর্ধমান, বাঁকুড়া থেকে শুরু করে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার নেতারা বিগত সরকার ও দলের ব্যর্থতার কথাই বেশি করে তুলে ধরেছেন।
রাজ্য নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় উঠতে হয়েছে ‘সন্ত্রাস-কবলিত’ কর্মীদের পাশে না-দাঁড়ানোর জন্যও। জেলার এক প্রবীণ নেতা বলেছেন, মমতাও নিজে একা সাংসদ এবং ৩০ জন বিধায়ক নিয়ে দল চালিয়েছেন। কিন্তু বড় ঘটনা ঘটলেই তিনি সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন। এতে দলীয় কর্মীরা ‘উদ্দীপ্ত’ হয়েছেন। অথচ সিপিএমের কোনও ‘বড় নেতা’ এই রকম কোনও ‘বড়’ উদাহরণ দেখাতে পারেননি! এই অবস্থায় রাজভবনে নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে সৌজন্য দেখাতে বুদ্ধবাবু ও বিমানবাবুর যাওয়া উচিত ছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে দলের একাংশ।
গোটা পর্বে অবশ্য রা কাড়েননি বুদ্ধবাবু! |
|
|
|
|
|