|
|
|
|
হাল বুঝতে জনতার দরবারে |
একুশে জুলাইয়ের পরে জেলায় জেলায় মমতা |
অনিন্দ্য জানা² কলকাতা |
তাঁর হাসপাতাল পরিদর্শনের ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ মডেল গোটা রাজ্যেই চালু করতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
একুশে জুলাইয়ের সমাবেশের পর মুখ্যমন্ত্রী জেলা সফরে বেরোতে চান। তখন তিনি সরেজমিনে গিয়ে জেলার হাল দেখবেন। একই সঙ্গে জরিপ করে নেবেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা তাঁর নির্দেশ মেনে কাজ করছেন কি না।
এমনিতে নির্বাচনের প্রচারের সময়েই মমতা প্রতিটি জনসভায় বলেছিলেন, “জেতার পর আমি আবার এই সমস্ত জায়গায় আসব।” সেদিক দিয়ে তাঁর জেলা সফর ‘ধন্যবাদজ্ঞাপক’ই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘প্রশাসক মমতা’ তার সঙ্গে দেখে নিতে চাইছেন, ‘বাম অপশাসনে’ রাজ্যের হালও। আপাতত মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত জুন মাসে প্রস্তাবিত শিল্পপতি সম্মেলন নিয়ে। তার পর রয়েছে একুশে জুলাই। যা এ বছর ‘বিজয় উৎসব’ হিসেবেই পালন করবে তৃণমূল। ওই সমাবেশের পরেই জেলায় জেলায় গভীর মনোনিবেশ করবেন মুখ্যমন্ত্রী।
তবে কালীঘাটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মহাকরণ যাওয়ার পথে আচম্বিতে কোনও সরকারি হাসপাতালে ঢুকে পড়া এবং রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সফর করার মধ্যে অবশ্যই তফাৎ থাকবে। হাসপাতাল সফরের মধ্যে যে ‘হঠাৎ-দর্শনে’র আকস্মিকতা থাকে, জেলা সফরে অবশ্যই তা থাকা সম্ভব হবে না। কিন্তু সরাসরি মানুষের মুখ থেকে তাদের অভাব-অভিযোগ শোনা এবং হাতেনাতে প্রতিকার করার বিষয়টি যে থাকবে, তা নিয়ে রাজ্যের প্রশাসনিক মহলের বিশেষ সন্দেহ নেই। |
|
পরিচিত দৃশ্য। নাগালের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী। ফাইল চিত্র |
অনেকটা এই ধাঁচেই গোটা বিহার জুড়ে ‘জনতা দরবার’ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে এবং পরে দু’দফায় নীতীশ ঘুরেছিলেন বিহারের প্রতিটি জেলা। রাতে তিনি জেলাসদরে গিয়ে পৌঁছতেন। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। রাতে সেখানেই শিবির করে থাকতেন মুখ্যমন্ত্রী। পরদিন সকালে তাঁর সামনেই বসত ‘জনতা-দরবার’। সেখানে হাজির থাকতেন জেলাশাসক এবং জেলা পুলিশের পদস্থ কর্তারা। থাকতেন মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অফিসারেরাও। কোনও অভাব-অভিযোগ শুনলে সেখানেই প্রশাসনের কর্তাদের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিতেন নীতীশ।
বিহার ভোটে জনতা দরবারের ‘সুফল’ পেয়েছেন নীতীশ। মমতাও চান, রাজ্যের মানুষকে ‘স্বচ্ছ এবং দক্ষ’ প্রশাসন দিতে। এবং সেই কাজটা রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী করতে চাইছেন একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের কথায়, “যে ভাবে উনি বিভিন্ন জায়গায় সরেজমিনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাতে এমনিতেই প্রশাসনের উপর একটা চাপ তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাজকর্ম থেকে একটা বার্তা তো সর্বস্তরে পৌঁছচ্ছেই! তার সুফলও ইতিমধ্যেই ফলতে শুরু করেছে। এর পর জেলা সফরে গেলে তারও ফল পাবেন সাধারণ মানুষ।”
বস্তুত তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকের ‘সারপ্রাইজ ভিজিটে’র মতোই রাজ্য জুড়ে জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারদেরও জেলার বিভিন্ন সরকারি দফতরে ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কখনও কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে নিজের চোখে ট্র্যাফিক ব্যবস্থা দেখা, বিভিন্ন হাসপাতালে সরাসরি পৌঁছে লোকের অভাব-অভিযোগ শোনা এবং পাশাপাশি সরকারি দফতরে কর্মসংস্কৃতির হাল দেখতে শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং তিনি চাইছেন, তাঁর অধীনস্থ প্রশাসনিক কর্তারাও একই কাজ নিয়মিত করুন। সেই মর্মে ইতিমধ্যেই মৌখিক নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে বিভিন্ন জেলায় পৌঁছেছে। সেই কাজ কতটা হয়েছে, জুলাইয়ের শেষে বা অগস্টের প্রথমে সেটাই সরেজমিনে দেখার পরিকল্পনা নিচ্ছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।
মহাকরণের একাংশের মতে, নিজস্ব ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করে ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছেন মমতা। রবিবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিটি দিন মহাকরণে আসছেন। একের পর এক দফতর ধরে ধরে বৈঠক করছেন এবং দফতর ছাড়ছেন রাত প্রায় ৮টা নাগাদ। যা থেকে তাঁর পূর্বসূরির সঙ্গে স্পষ্ট তফাত দেখছে মহাকরণ। রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তার কথায়, “প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গড়ে মহাকরণে থাকতেন দিনে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা! তাও সপ্তাহে পাঁচদিন। খুব বড় কিছু না-হলে শনি বা রবিবার আসার প্রশ্ন ছিল না। সে আমলের সঙ্গে এই আমলের তফাতটা তাই আরও বেশি চোখে লাগছে।”
পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনের খোলনলচে ঢেলে সাজাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। গোটা দেশ থেকে খুঁজে খুঁজে তুলে আনার চেষ্টা করছেন প্রথম সারির বাঙালি আমলাকুলকে। সরাসরি তাঁদের ফোনে ধরে মমতা বলছেন, “আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আসুন। নতুন বাংলা গড়তে হবে তো!” এঁদের মধ্যে কয়েক জনের স্ত্রী-ও আবার আইএএস।
তাঁরাও দিল্লি বা অন্য রাজ্যে কর্মরতা। সে ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী যাতে একই রাজ্যে পোস্টিং পান, তার জন্যও উদ্যোগী হচ্ছেন মরিয়া মমতা। সংশ্লিষ্ট আমলাকে রাজ্যে আসার জন্য অনুরোধ করার পাশাপাশিই জানাচ্ছেন, তাঁর স্ত্রী-র পোস্টিংয়ের ‘দায়িত্ব’ও মুখ্যমন্ত্রীরই। সেই প্রয়োজনে তিনি যোগাযোগ করছেন যে কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে, যে দফতরে কর্মরত রয়েছেন সংশ্লিষ্ট আমলার স্ত্রী।
একই সঙ্গে ‘দক্ষ এবং সৎ’ আইপিএস অফিসারদেরও রাজ্যে নিয়ে আসতে উদ্যোগী হয়েছেন মমতা। ইতিমধ্যেই হাওড়ায় কলকাতার ধাঁচে নতুন ‘কমিশরিয়েট’ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। যেখানে হাওড়া শহরের দায়িত্বে থাকবেন কলকাতার মতোই এক জন পুলিশ কমিশনার। ওই পদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই এক অফিসারের নাম চূড়ান্ত করেছেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি দায়িত্ব নেবেন। পাশাপাশি বর্ধমান-আসানসোলের জন্য একটি নতুন ডিআইজি পদ তৈরি হচ্ছে বলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর। সেই পদের জন্যও দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলায় যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া এক আইপিএসের নাম চূড়ান্ত করেছেন মমতা। আপাতত ওই আইপিএস একটি কেন্দ্রীয় বাহিনীতে রয়েছেন। তাঁর কাছেও মুখ্যমন্ত্রীর ‘বার্তা’ চলে গিয়েছে। রাজ্য পুলিশের এক পদস্থ কর্তার কথায়, “হাওড়া এবং আসানসোলের মতো কিছু জায়গায় বিভিন্ন অপরাধমূলক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একটি শ্রেণি রয়েছে। তাদের কড়া হাতে দমন করলে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবেন। মূলত সেই জন্যই হাওড়া এবং আসানসোল নিয়ে ওই বিশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।”
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, পুলিশের নিয়োগের জন্য ‘রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে’র ধাঁচে ‘পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড’ গড়তে চান মুখ্যমন্ত্রী। |
|
|
|
|
|