রামলীলায় মধ্যরাতের নাটকের পরের দিন তুঙ্গে উঠল রাজনৈতিক লড়াই। যার কেন্দ্রে রইলেন যোগগুরু রামদেব। এক দিকে যেমন তাঁর সঙ্গে সরকারের পুরোদস্তুর লড়াই শুরু হয়ে গেল। অন্য দিকে, নতুন করে টক্কর শুরু হল কংগ্রেস-বিজেপিরও।
সরকার ও কংগ্রেসের তরফে একাধিক শীর্ষ নেতা আজ রামদেবকে ‘ঠগ’ পর্যন্ত আখ্যা দিয়ে তাঁর অনশনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছেন। তেমনই রামদেবও দফায় দফায় হুমকি, হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছেন, ফের দিল্লি যাবেন তিনি। অনশনেও বসবেন। মহিলা ও শিশুদের ওপর পুলিশি অত্যাচারের প্রশ্নে সনিয়া গাঁধীকে ‘বিদেশিনি’ বলে মন্তব্য করে তাঁর আরও অভিযোগ, উনি (সনিয়া) সংবেদনশীল নন। স্বাভাবিক ভাবেই রামদেবের পাশে দাঁড়িয়েছে আন্না হাজারে-সহ তথাকথিত দুর্নীতি বিরোধী বিগ্রেড। আর ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন বিজেপি তথা আরএসএস নেতৃত্ব। তাঁদের আক্রমণের নিশানা কংগ্রেস। এই লড়াইয়ের রাজনৈতিক তাৎপর্য দূরগামী বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে শুরুতেই প্রশ্ন, সরকার কেন এমন ‘চরম’ পদক্ষেপ করল? জবাবে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কপিল সিব্বল ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী সুবোধকান্ত সহায় বলেছেন, সরকার গোড়া থেকে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পক্ষে ছিল। আনুষ্ঠানিক ভাবে অনশন শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগেই রামদেবের সব সঙ্গত দাবি মেনে নেওয়া হয়। অনশনের তাই আর কোনও কারণ ছিল না। অথচ তার পরেও অনশন করে মানুষকে বোকা বানাচ্ছিলেন ‘রামদেবজি মহারাজ’! কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিখিত আশ্বাসপত্র দেওয়ার পরেও তিনি যখন অনশন তুললেন না, তখন পুলিশ দিয়ে তাঁকে তুলে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ, সরকারের কাছেও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ‘বাবা’ এ বার রাজনীতি করছেন। তাঁকে মদত দিচ্ছে সঙ্ঘ তথা সাম্প্রদায়িক শক্তি। সঙ্কট তৈরি হচ্ছিল নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও। এতগুলো মানুষের ওপর যদি কোনও হামলা হত, তা হলে জবাবদিহি করতে হত সরকারকে।
সব মিলিয়ে, রামদেবের গোটা পর্বের পিছনে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করে দুর্নীতির প্রশ্ন থেকে বিতর্কের অভিমুখও ঘোরাতে চাইছে সরকার ও কংগ্রেস।
কিন্তু যে কথা প্রকাশ্যে সরকার বা কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব বলেননি তা হল, ‘অপারেশন রামদেব’ ছিল সুচিন্তিত পদক্ষেপ। গোড়ায় এই যোগগুরু সম্পর্কে নরম মনোভাব দেখালেও পরে সনিয়া গাঁধীর হস্তক্ষেপে ক্রমশই কঠোর অবস্থান নিতে শুরু করে সরকার। স্থির হয়, আলোচনার মাধ্যমে রামদেব অনশন প্রত্যাহার না করলে, জোর করে তুলে দেওয়া হবে। নিত্য নতুন অনশন ও ‘ব্ল্যাকমেলের’ রাজনীতি আর বরদাস্ত করা যাবে না। কারণ, এর ফলে প্রমাণ হচ্ছে, কংগ্রেস ও সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে গিয়েছে। আন্না হাজারের অনশন পর্বের সময়ই এক প্রস্ত এই বার্তা গিয়েছে। আর নয়! বস্তুত, আন্না-পর্বেও সরকারের শীর্ষ নেতাদের একাংশ জোর করে অনশন তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। কিন্তু পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন থাকায় সেই রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে পারেনি সরকার। এ বার সেই কর্তৃত্ব দেখাল সরকার।
সন্ধ্যায় দলের বৈঠকেও সরকারের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও তোলা হয়েছে। প্রথমত, অনেকেই বলছেন, সর্বসম্মতির মাধ্যমে রামদেবকে তোলা হল না কেন? তা হলে বিজেপি এই রাজনৈতিক সুবিধা পেত না। দ্বিতীয়ত, সিব্বল আগ বাড়িয়ে চিঠি ফাঁস করতে গেলেন কেন? তৃতীয়ত, রাত পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগেই রামদেবকে গ্রেফতার করা হল না কেন? সর্বোপরি, রামদেব যে সঙ্ঘের ‘হাতের পুতুল’ হয়ে গিয়েছেন, সেটা কেন বুঝতে পারল না সরকার?
দলের অন্দরে প্রশ্ন তোলা হলেও বাইরে ঐকমত্যের ছবিটা ধরে রাখছে কংগ্রেস। এই অবস্থায় বিজেপি যে সুবিধা পেয়ে যাবে, দুর্নীতির প্রশ্নে আন্দোলনে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সেটা বুঝতে পারছেন দলীয় নেতৃত্ব। তাই তাদের মোকাবিলায় রাজ্যে রাজ্যে প্রচারে নামতে বলেছেন সনিয়া। অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রীও আগামী মঙ্গলবার সরকারের শরিক নেতৃত্বকে ডাক দিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে ঐকমত্য তৈরির জন্য। মঙ্গলবারের বৈঠকে তিনি শরিকদের বুঝিয়ে বলবেন, কেন এই পদক্ষেপ নেওয়া হল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে দীনেশ ত্রিবেদীকে পাঠাচ্ছেন। সরকার যখন রামদেবকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল, তখন দীনেশই কিন্তু যোগগুরুর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। কেন তাঁকে বোঝাতে মন্ত্রীদের বিমানবন্দরে পাঠানো হয়েছিল, তোলেন সেই প্রশ্নও।
রামদেবকে পুলিশ দিয়ে তুলে দেওয়ার পর তার রাজনৈতিক ফল নিয়ে কি ভয় নেই কংগ্রেসের? বিশেষ করে হিন্দিবলয়-সহ গোটা দেশের শহর থেকে গ্রাম, সর্বত্র রামদেবের লক্ষ লক্ষ অনুগামী রয়েছেন। তাঁদের আবেগকে উস্কে দিয়ে কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে বিজেপি। এমনকী বামেরাও। তাতে উজ্জীবিত যোগগুরু আজ এ-ও বলেছেন, আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে সরকার। একই সঙ্গে সনিয়ারও তীব্র সমালোচনা করেছেন রামদেব। প্রত্যাশিত যে, গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে রামদেব যে গুরুত্ব পেয়েছেন, তাঁকে পুঁজি করে নতুন উদ্যমে কংগ্রেস বিরোধিতায় অবতীর্ণ হবেন। তা ছাড়া তাঁর দিক থেকেও তাগিদ রয়েছে এই প্রমাণ করার যে ‘তিনি মানুষকে বোকা বানাননি।’
কংগ্রেস সরকারের পাশে দাঁড়ালেও দলের মধ্যে কিছু অন্য স্বরও ছিল। কেউ কেউ এ কথাও বলছিলেন, এর প্রভাব সব থেকে বেশি পড়বে উত্তরপ্রদেশের ভোটে। এই পরিস্থিতিতে সন্ধ্যায় দলের শীর্ষ নেতাদের দশ জনপথে বৈঠকে ডাকেন সনিয়া গাঁধী। স্থির হয় যে, হিন্দিবলয়ে কী প্রভাব পড়বে পরের কথা, সরকার যে পদক্ষেপ করেছে তাতে জোরালো সমর্থন জানাবে দল। রামদেব ও সঙ্ঘ পরিবার কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে আক্রমণে নেমেছে, তাকে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে মতাদর্শের লড়াইয়ে নিয়ে যেতে চাইবে কংগ্রেস। বৈঠকের পর দলের প্রধান মুখপাত্র জনার্দন দ্বিবেদী বলেন, “কিছু সাম্প্রদায়িক শক্তি নির্বাচনে হারার পর এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে যেন তেন প্রকারে ক্ষমতা দখল করতে চাইছে। কিন্তু কংগ্রেস এদের মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে।” কাল থেকে দেশ জুড়ে দলের সব নেতা-সমর্থককে এ ব্যাপারে প্রচারে নামারও নির্দেশ দিতে চলেছেন সনিয়া।
তবে কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, বৈঠকে এ-ও আলোচনা হয়েছে যে, দুর্নীতি দমনের প্রশ্নে সরকার যে পদক্ষেপ করছে, দল তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর সেই কারণেই সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতায় ঘাটতি হচ্ছে মানুষের। ফলে চটজলদি সমাধানের জন্য কখনও আন্না কখনও রামদেবের হাত ধরছে মানুষ। ফলে কংগ্রেসকে আরও আগ্রাসী হয়ে সরকারের কাজকর্ম নিয়ে প্রচারে নামতে হবে।
এখন দেখার, এই পরিস্থিতি কংগ্রেস কী ভাবে সামলায়? যার প্রথম পরীক্ষা হবে আগামী বছর, উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে। |