তলিয়ে যাওয়া নৌবহরে নাব্যতা হারিয়েছে নদী।
পাঁকে ও পলিতে ক্রমশ মজে আসা গঙ্গায়, হারানো নাব্যতার কারণ খুঁজতে গিয়ে বাস্তবিকই চমকে গিয়েছেন নদী বিশেষজ্ঞরা। নদীর অতলে ডুবে রয়েছে ছোট-বড় অজস্র জলযান। গঙ্গা-গর্ভে হারানো সেই সব জাহাজ, লঞ্চের আড়ালেই নিশ্চুপে হারিয়ে গিয়েছে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা।
শুধু তাই নয়, কলকাতা লাগোয়া গঙ্গায়, পরিত্যক্ত স্টিমার, গাদা নৌকা আর অগুন্তি বয়ার ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলাও দুরূহ হয়ে উঠেছে নদীর। হারানো সেই নাব্যতা উদ্ধারে এ বার তাই গঙ্গার বুকে ডুবে যাওয়া জলযান খোঁজার ফরমান জারি করল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। সেই সঙ্গে কলকাতা বন্দর এবং বিভিন্ন ঘাটে পরিত্যক্ত কিংবা আধ-ডোবা অবস্থায় থাকা লঞ্চগুলিকেও ৩০ জুনের মধ্যে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গঙ্গা-দূষণ রুখতে কলকাতা হাইকোর্টের মনোনীত নজরদারি কমিটির পরামর্শ মেনে কলকাতা পুলিশ এবং বন্দর কর্তৃপক্ষকে ওই দায়িত্ব সঁপেছে পর্ষদ। |
গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক অবশ্য দু’বছর আগেই গঠন করেছিল ন্যাশনাল গঙ্গা রিভার বেসিন অথরিটি বা এনজিআরবিএ। বুধবার সেই কেন্দ্রীয় সংস্থাকে একশো কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রতি দিয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক জানিয়ে দিয়েছে গঙ্গার দূষণ-মুক্তি ঘটাতে পাশেই রয়েছে তারা। ব্যাঙ্কের এ দেশীয় অধিকর্তা রোবের্তো জাঘা জানান, গঙ্গা-নির্মল করার কাজে সরকারকে সাহায্য করতে পেরে তারা খুশি।
নদী গর্ভে ক্রমান্বয়ে জমা পলি আর নদীর বুকে ছড়িয়ে থাকা আবর্জনার ভিড়ে গঙ্গা যে তার চেনা গতি ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে, বিশেষজ্ঞেরা অনেক দিন ধরেই সে ব্যাপারে সতর্ক করছিলেন। হাইকোর্ট নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ কমিটি, এ ব্যাপারে কারণ অনুসন্ধানে সম্প্রতি দায়িত্ব দিয়েছিল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে। তাঁদের পরামর্শ মেনে কারণ খুঁজতে গিয়েই পর্ষদের হাতে উঠে এসেছে ডুবো জাহাজের এই চমকপ্রদ তথ্য। পর্ষদের মুখ্য আইন-অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “গঙ্গার দূষণমুক্তি অভিযান শুরু করে দেখছি নদীর বুকেই নয়, গভীরেও ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু জলযান। নাব্যতা কমানোর পাশাপাশি নদীর গতিও থমকে দিয়েছে সেগুলি।”
বিশেষজ্ঞ কমিটিতে রয়েছেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত। তিনি মনে করছেন কলকাতা বন্দরের প্রবেশ পথ, স্যান্ড হেড থেকেই ডুবে যাওয়া জাহাজের ভিড় জমেছে। তিনি বলেন, “ডুবে যাওয়া স্টিমার, ট্রলার নদীগর্ভ থেকে তোলা বেশ খরচ সাপেক্ষ। অনেকেই সে পথ মাড়ান না। তারউপর, মেরামতির জন্য নিয়ে আসা বহু জাহাজও প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় বছরের পর বছর পড়ে রয়েছে নদীর বুকে। নির্বিচারে তা থেকেও দূষণ ছড়াচ্ছে।” সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে, দেশের সীমানায় বেআইনি অনুপ্রবেশের দায়ে আটক জাহাজের ভিড়। কলকাতা বন্দরের এক পদস্থ কর্তা জানান, তাইল্যান্ড, বাংলাদেশ থেকে আসা এমনই অজস্র ‘বন্দি’ ট্রলার মরচে ধরে ক্রমে ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে নদীগর্ভে।
পরিণতিতে কী হচ্ছে? নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, “ডুবে যাওয়া ওই সব জলযানে বাধা পাচ্ছে স্রোত। আর জলে গুলে থাকা পলি থিতিয়ে পড়ছে নদী গর্ভে। পরিণতিতে নষ্টা হচ্ছে নাব্যতা।” তিনি জানান, গঙ্গার মোহনায় প্রায় ২.৬০ লক্ষ টন পলি গুলে রয়েছে জলে। জোয়ারের সময়ে নদীর উৎসমুখী স্রোত ওই বিপুল গোলা-মাটি নিয়ে ঢুকে পড়ছে বন্দর এলাকায়। কিন্তু ভাঁটার সময়ে, মোহনাগামী মরা স্রোত, ধীর গতিতে ওই পলি ফেলতে ফেলতে ফিরছে। সেই সময়ে নদীর অতলে ডুবে থাকা জলযানগুলিতে সেই ঘোলা স্রোত বাধা পাওয়া মাত্রই জলে গোলা পলি ঝড়ে পড়ছে। ভাঙা জাহাজ, স্টিমারগুলিকে ঘিরে জমে উঠছে পলির স্তূপ। নাব্যতা হারানোর সঙ্গে গতিও ভুলছে নদী।
ডুবো জাহাজের খোঁজ চালানোর সঙ্গে কলকাতার বিভিন্ন ঘাটে পরিত্যক্ত জাহাজের সুলুক সন্ধান শুরু করেছে পুলিশ। বাবুঘাট থেকে গ্বালিয়র মনুমেন্ট, গঙ্গায় এই অপিরসর নদী বক্ষেই অন্তত সাতটি পরিত্যক্ত জাহাজ চিহ্নিত করে তারা দেখে, নদীর বুকে আবর্জনার স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা জলযানগুলি সব ক’টিই সরকারি। ভূতল পরিবহণ নিগম এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের ওই সাতটি জাহাজ বছর দশেক আগে মেরামতির জন্য আনা হয়েছিল। কিন্তু সংস্কার আর হয়নি। উল্টে নদীতে ভেসে আসা বিবিধ অবর্জনার আঁস্তাকুড় হয়ে দশ বছর ধরে দূষণ ছড়িয়ে চলেছে সেগুলি। এমভি সৈদুল্লাহ, এমভি মাতিয়া, এমভি কপোতাক্ষ, এমভি ময়ূরাক্ষী, এমভি চন্দ্রিকা-সহ ওই সাতটি জাহাজকে দ্রুত সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা না হয় হল, কিন্তু নদী গর্ভে ডুবো জাহাজ?
জলযানে ভারাক্রান্ত গঙ্গার ভবিষ্যৎ এখনও নদীর অতলেই। |