পশ্চিমবঙ্গের নতুন সরকার চাইলে ‘পরামর্শ’ দিতে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে তাঁর কাছে এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে আমন্ত্রণ পৌঁছয়নি। তাই তাঁর বঙ্গ-সফরের দিনক্ষণও এখনও চূড়ান্ত নয় বলে জানাচ্ছেন স্বয়ং রাজেন্দ্র সাচার।
প্রাক্তন বিচারপতি সাচারের মতে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়ন তাঁর কাজ নয়। তিনি সাচার কমিটির প্রধান হিসাবে ইতিমধ্যেই তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর রিপোর্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে উন্নয়ন কী ভাবে হবে, তা নির্ভর করবে সরকারের ‘সদিচ্ছা’র উপরে। সরকারের ‘সদিচ্ছা’ থাকলে তিনি মতামত দিতে পারেন। আনন্দবাজারকে বুধবার সাচার বলেছেন, “আমাদের রিপোর্ট কয়েক বছর ধরে অ-কার্যকর হয়ে পড়ে আছে! তার রূপায়ণ নির্ভর করে পশ্চিমবঙ্গ বা যে কোনও সরকারেরই সদিচ্ছার উপরে। পশ্চিমবঙ্গে যাব বলে শুনেছি! কিন্তু আমি নিজে এখনও চূড়ান্ত কিছু জানি না!” নতুন সরকার তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতে এগোতে চাইলে শিক্ষা ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আগাম ‘পরামর্শ’ও দিয়েছেন সাচার।
মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই তাঁর দফতর (সিএমও) সূত্রে দাবি করা হয়, রাজ্যের এক আমলাকে পাঠিয়ে সাচারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি জুন মাসেই আসছেন। সিএমও-র তরফে সাচারের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার এ দিনও জানান, ২৪ মে সাচারের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে রাজ্যে আসতে আমন্ত্রণ জানান। তিনি প্রাথমিক সম্মতিও দেন। খোদ সাচার অবশ্য বলছেন, “যোগাযোগ তো অনেকের সঙ্গেই হয়ে থাকে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু হলে তখনই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব।” হায়দরাবাদ থেকে সদ্য দিল্লি ফিরে তাঁর বঙ্গ-সফর নিয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাননি প্রাক্তন বিচারপতি।
হায়দরাবাদে সমাজবাদী মঞ্চের মহাসম্মেলনে আমন্ত্রণে গিয়ে সাচার শোনেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁর সফরের কথা প্রচার হয়ে গিয়েছে। মমতার সরকার চাইলে সহযোগিতা করতে তাঁর যে আপত্তি নেই, সে কথা সমাজবাদী মঞ্চের নেতাদেরও বলেন তিনি। ঘটনাচক্রে, ওই সম্মেলনেই সিদ্ধান্ত হয়, সমাজবাদী মঞ্চের পাশাপাশিই দেশের সব সমাজবাদী শক্তিকে এক ছাতার তলায় এনে একটিই দল গড়ার চেষ্টা হবে। সেই লক্ষ্যে ২১ অগস্ট দিল্লিতে একটি সম্মেলন ডাকা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সমাজবাদীদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলার দায়িত্ব পেয়েছেন ডিএসপি নেতা সমীর ভট্টাচার্য। সম্মেলনে সাচার থাকবেন কিনা, তা এখনও চূড়ান্ত নয়।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের সাচার রিপোর্ট নিয়ে অভিযোগের জবাব দিয়েছেন সাচার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সাচারের নেতৃত্বে যে সাত সদস্যের কমিটি হয়, তাদের কাজ ছিল দেশ জুড়ে সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পর্যালোচনা। তাঁদের ৪০৩ পাতার প্রতিবেদন ছিল ‘স্টেটাস রিপোর্ট’, সেখানে সুপারিশ ছিল না। সেই জন্যই মমতার ঘোষণামতো সাচার কমিটির ‘সুপারিশ’ কার্যকর করার প্রশ্ন নেই বিধানসভা ভোটের আগে বলতেন বামেরা। সাচারের ব্যাখ্যা, “বিষয়টাকে এত যান্ত্রিক ভাবে দেখা উচিত নয়। সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কোথায় ঘাটতি, সেগুলো যে ভাবে দেখানো আছে, তা পর্যালোচনা করলেই সমাধান সম্ভব।”
পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভা পর্যন্ত বামেদের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ধস নামার পিছনে সাচার রিপোর্টে ধরা-পড়া চিত্রকে বিশেষ ভাবে দায়ী করা হয়। বুদ্ধবাবু বারংবার বলেছেন, সাচার রিপোর্ট অসম্পূর্ণ। সাচারের পাল্টা প্রশ্ন, “কোথায় অসম্পূর্ণ? সংসদে জমা পড়ার পর রিপোর্ট যে কেউ দেখতে পারেন! পশ্চিমবঙ্গের বিগত সরকারের উচিত ছিল, তথ্যগত ভুল থাকলে তা সর্বসমক্ষে চিহ্নিত করা। তা হলে আমরা জবাব দিতে পারতাম।” তাঁর দাবি, “পক্ষপাতমূলক অবস্থান নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করিনি। কোনও সরকারকে বিপাকে ফেলাও উদ্দেশ্য ছিল না। আমাদের কাজের বিচার হওয়া উচিত নিরপেক্ষ ভাবে।”
বামফ্রন্ট সরকারের অভিযোগ ছিল, এ রাজ্যের জেলায় জেলায় গরিব মুসলিম কৃষকদের হাতে বন্টি জমির প্রকৃত চিত্র রিপোর্টে ধরা পড়েনি। সাচারের জবাব, “কম-বেশি জমি বণ্টন পশ্চিমবঙ্গ কেন, সর্বত্র হয়েছে। এ আর নতুন কথা কী? ভূমি সংস্কারের উপরে কাজ করা তো আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না! হাতে জমি এলেই কি সংখ্যালঘুরা শিক্ষা বা সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় এগিয়েছেন? এই সার্বিক প্রেক্ষাপট মাথায় রাখতে হবে। আমরা সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পর্যালোচনা করেছি, বিশেষত শিক্ষার উপরে জোর দিতে চেয়েছি।” সমীক্ষা চালানোর সময়ে বামফ্রন্ট সরকারের কাছ থেকে কি সহযোগিতা পেয়েছিলেন? সাচার বলছেন, “সরকারের কাছে কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। কিছু তথ্য পেয়েছি। কিছু আলোচনায় গিয়েছি। সরকারের উপর নির্ভরশীল ছিলাম না। তবে বিগত সরকার অসহযোগিতা করেছিল, এমন কিছু বলতে চাই না।” |