|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
আমাদের উচ্চশিক্ষা: বদল নয়, সূচনা |
সামগ্রিক ভাবে কলকাতার শিক্ষাজগৎকে মস্ত এক কদম এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সময়টা নানা কারণে প্রশস্ত।
সুযোগের সদ্ব্যবহার করলে পশ্চিমবঙ্গ আবার একটা দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। কী ভাবে? দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
সুকান্ত চৌধুরী |
শিক্ষক-সংখ্যা আর পরিকাঠামো দিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করব। প্রথম বিষয়টি সবচেয়ে গুরুতর, সবচেয়ে মর্মান্তিক। রাজ্যে অসংখ্য কলেজে সাম্মানিক মানের লেখাপড়া সামলাচ্ছেন এক জন পূর্ণসময়ের শিক্ষক, বা এক জনও না, হাতে গোনা আংশিক শিক্ষক, যাঁদের মাইনে (সরকারি নির্দেশ যা-ই বলুক) কখনও দু-তিন হাজার, কখনও শূন্য। শিক্ষক-কক্ষ ছেড়ে দিলাম, ক্লাসঘর বাড়ন্ত। গ্রন্থাগারের বাৎসরিক অনুদানও কয়েক হাজার বা শূন্য, গবেষণাগার ফাঁকা। গল্প শুনেছি, (মিথ্যা প্রমাণে আশ্বস্ত হব) যন্ত্রের অভাবে প্র্যাকটিকাল ক্লাস নেওয়া হয় বোর্ডে যন্ত্রের ছবি এঁকে। সে ঘাটতি পূরণ করতে বিজ্ঞানের ‘ভাল’ কোচিং ক্লাসে কিছু সরঞ্জাম মজুত থাকে। যে কলেজগুলি সরকারি সাহায্য পায়, সেখানে পূর্ণসময়ের শিক্ষকদের মাইনেটা নিশ্চিত। নতুন যে কলেজগুলি সেই সাহায্য পরিহারের কড়ার দিয়ে স্থাপিত হয়েছে, সেখানে সেটুকুও নয়। প্রাথমিক আর কলেজ-শিক্ষায় আসমান-জমিন ফারাক; তবু বলতে ইচ্ছে করে, এ হল গাছতলায় এক-শিক্ষকের নেই-স্কুলের পরিপূরক। |
|
ভবিষ্যৎ। নতুন একটা সুযোগ এসেছে। |
সবচেয়ে আশ্চর্য, গত দশ বছরে এই নেই-রাজ্যে পাইকারি হারে স্নাতকোত্তর পাঠ চালু হয়েছে। কখনও ভুলক্রমেও পূর্ণসময়ের একটি বাড়তি শিক্ষক নিযুক্ত হননি। গ্রন্থাগারে দু-এক লাখ টাকা এককালীন অনুদানের পর বাড়তি এক পয়সা মেলেনি। বিভাগ প্রতি দুটো ক্লাস বাড়ল, প্রায়ই হয়নি ঘরের সংস্থান। ক্লাস চলছে, পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে মুষ্টিমেয় শিক্ষকের অসাধারণ পরিশ্রমের ফলে। বলতেই হয়, এই অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের এক অর্থে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে মার খাচ্ছে প্রাক্-স্নাতক পঠনপাঠন, কারণ এই লোকবলে দুটো দায়িত্ব ঠিকঠাক সামলানো অসম্ভব।
নতুন সরকার যদি উচ্চশিক্ষার উন্নতি চায়, প্রথম কর্তব্য, প্রতিটি কলেজে ন্যূনতম শিক্ষক সংখ্যা ও পরিকাঠামোর মান বেঁধে দেওয়া ও বিনা আপসে তা বলবৎ করা: অমুক বিষয়ে অমুক স্তরে এত জন শিক্ষক চাই, ছাত্রপ্রতি এত বর্গফুট জায়গা, গ্রন্থাগারে এতগুলি বই, বিজ্ঞানের ক্লাসে এই-এই সরঞ্জাম।
অসম্ভব? যদি হয়, তবে মানতে হবে উচ্চশিক্ষায় স্থায়ী উন্নতিও অসম্ভব, ক’টা জনমুগ্ধকারী প্রতীকী ব্যবস্থার বেশি কিছু ভেবে লাভ নেই। না-হয় চালু কলেজগুলিকে দু-এক বছর সময় দেওয়া হোক এই মানে পৌঁছতে, নতুন কলেজ খোলার সময় গোড়া থেকেই কড়া ভাবে নিয়ম ধার্য হোক। যে ক’টা বিরল ক্ষেত্রে ভৌগোলিক বা সামাজিক কারণে নতুন কলেজের একান্ত প্রয়োজন অথচ অর্থ বাড়ন্ত, সেখানে সরকার বিশেষ সাহায্যের ব্যবস্থা করুক, কিন্তু কখনওই নিয়ম শিথিল করে, অর্থাৎ পরিকাঠামোয় আপস করে, জল-মেশানো শিক্ষা জুগিয়ে নয়।
টাকা আসবে কোথা থেকে? এই প্রশ্নের একটা জবাব আছে এ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা নিয়ে আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ প্রতিবেদন, ভবতোষ দত্ত কমিশনের রিপোর্টে। প্রস্তাবটা হল, দু’চারটি কলেজ একত্র করে, এক-একটি বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা একটি কলেজেই কেন্দ্রীভূত করা, সেই একটি কেন্দ্রে ওই বিষয়ে শিক্ষক ও পরিকাঠামোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা।
ভৌগোলিক কারণে এটা সর্বত্র সম্ভব নয়; কিন্তু বড় বাধা ভৌগোলিক বা ব্যবহারিক নয়, মানসিক ও রাজনৈতিক। এমন প্রস্তাব ওঠামাত্র শুরু হবে দখলের লড়াই এক্তিয়ারের দখল, ইউনিয়নের দখল, ছাত্র-ভর্তির মধুভাণ্ডের দখল। সে কারণেই যে সরকার রিপোর্টটি তলব করেছিল, তারা সেটি কার্যকর করার কোনও চেষ্টা করেনি। নতুন সরকার করবে কি? রিপোর্টটি এখনও ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ তাতে বর্ণিত সমস্যাগুলি আজও বিদ্যমান।
|
উচ্চ চিন্তা, উচ্চ শিক্ষা |
মৌলিক কলেজশিক্ষার জন্য একান্ত প্রয়োজন লোকবল ও পরিকাঠামো সুনিশ্চিত করা। উচ্চশিক্ষা কিন্তু তখনই সত্যি করে ‘উচ্চ’ স্তরে পৌঁছয়, যখন তাতে ছোঁয়া লাগে গবেষণা বা উচ্চতর চিন্তার। এ দিক দিয়ে ঘাটতির অভিযোগে আই-আই-টি আই-আই-এম’কেও আজ গঞ্জনা শুনতে হচ্ছে। রাজ্য স্তরের বিধ্বস্ত পরিবেশে এত দূর ভাবার অবকাশ আছে কি? না ভাবলেও কিন্তু নয়, নইলে উচ্চশিক্ষার আয়োজন কেন? বর্ধমান যেতে কেউ বিমানে চড়ে? মৌলিক বিদ্যাচর্চা সম্বন্ধে আমার আগের আলোচনা পাঠককে ভেবে দেখতে বলি।
এখানে একটা অপ্রত্যাশিত আশার অবকাশ আছে। কলেজ সার্ভিস কমিশন নিয়ে আমাদের সঙ্গত ক্ষোভের অন্ত নেই। প্রাক্তন সরকারের দলতন্ত্রে এটি ছিল অমোঘ হাতিয়ার। কিন্তু এর কার্যকলাপের একটি অ-ভাবিত ফল রাজ্যের বিভিন্ন কলেজের নানা বিভাগে বেশ কিছু মেধাবী উৎসাহী তরুণতরুণী ছড়িয়ে পড়েছেন। হয়তো গেছেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে, দলের প্রার্থীদের জন্য ‘ভাল’ কলেজগুলি সংরক্ষিত ছিল বলে। (দলানুগত শিক্ষকরাও সবাই নিশ্চয় অযোগ্য নন।) সব নিয়োগই হয়েছে বিক্ষিপ্ত ভাবে, কোনও সৎ পরিকল্পনা ছাড়া; উপযুক্ত সঙ্গ, পরিবেশ ও পরিকাঠামোর অভাবে এই তরুণ শিক্ষকরা প্রায়ই হতোদ্যম। তবু নানা কলেজে এখন কিছু লেখা, কিছু গবেষণা, আলোচনা-আদানপ্রদান, শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে এক-আধটু চিন্তা শুরু হয়েছে। কলেজ-কর্তৃপক্ষ এতে উৎসাহ দিতে অপারগ, কারণ ক্লাস চালু রাখতে পরীক্ষা নিতেই তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন তরুণ শিক্ষকদের গবেষণার শখ মেটানোর, এমনকী সরকার নির্ধারিত রিফ্রেশার কোর্সে তাঁদের যেতে দেবার অবকাশ কোথায়?
ধরে নিচ্ছি, ‘ভাল’ কলেজে বদলির আর্জি নিয়ে নব্য শিক্ষকদের অনেকে নতুন সরকারের দ্বারস্থ হবেন। নিয়োগ-চালাচালি করে কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না, বরং ঘোলা জল আরও ঘোলা হবে। তার চেয়ে ভাল পন্থা পরিকাঠামো বাড়িয়ে, ছুটির সুযোগ দিয়ে, পদোন্নতির পথ ত্বরান্বিত করে, সেই সঙ্গে নিশ্চেষ্টতার কিছু শাস্তিবিধান করে এই নতুন শিক্ষককুলের মধ্যে উদ্যোগ ও গবেষণার একটা পরিমণ্ডল গড়ে তোলা। অবশ্যই দেখতে হবে, এতে কেবল ব্যক্তিবিশেষ নয়, কলেজগুলিও যেন পুরস্কৃত হয়।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে একটি মডেল হতে পারে। এ রাজ্যের তুলনায় সেখানকার কলেজগুলির সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্নাতকোত্তর বিভাগের অনেক নিবিড় যোগ, তার একটা আইনি ভিত্তিও আছে। নানা রাজ্যের মফস্সল বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গেও জেলা কলেজগুলির একটা পারস্পরিক নির্ভরতা দেখা যায়। এ দিক দিয়ে পশ্চিমবাংলায়, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবধান অনেক বেশি। সেটা দূর করতে পারলে বর্তমান মানবসম্পদ দিয়েই অনেক বেশি ফল লাভ করা সম্ভব। নতুন সম্পদও জোগাড় করতে সুবিধা হবে, আরও বেশি কলেজ তরুণ শিক্ষকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
|
ইতিহাস |
এই কর্মকাণ্ডের রসদও নানা সূত্রে পাওয়া যাবে। স্বাধীন ভারতে উচ্চশিক্ষার ইতিহাসটা এখানে একটু দেখা দরকার। প্রেসিডেন্সি কলেজের হৃত গৌরব নিয়ে বিলাপ করার সময় তার মৌলিক কারণটা আমরা প্রায়ই বিশ্লেষণ করি না। একটা কারণ অবশ্যই বামপন্থীদের দলীয় দৌরাত্ম্য, আর একটা তারও আগে নকশাল যুগের তাণ্ডব। কিন্তু মূল কারণ এই যে, সে দিন পর্যন্ত কলেজটি যে ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়েছে, তা আদতে উনিশ শতকীয়। স্বাধীনতার পর, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন স্থাপিত হবার পর, ভারতে উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা ও পরিচালনার ধাঁচ আমূল পাল্টে গেল। পশ্চিমবাংলায় এই নতুন ব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি সদ্ব্যবহার করল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, তার শ্রীবৃদ্ধির সেটাই একক বৃহত্তম কারণ। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও অল্পবিস্তর লাভবান হল। এ দিকে আমলা-অধ্যুষিত প্রেসিডেন্সি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এই সুযোগ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হল। কিছু অধ্যাপকের ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা (যেমন, অর্থনীতি বিভাগে) মুখ থুবড়ে পড়ল লাল ফিতের ফাঁসে।
ইউ জি সি-র যুগ অস্ত যাচ্ছে, তার অস্তিত্ব বিপন্ন, তার সঙ্গে কারবার করা উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে পড়ছে। তার বদলে যে নতুন পর্যায়ের অস্থির সূচনা দেখা যাচ্ছে, তাতে রাজ্য স্তরের প্রতিষ্ঠানগুলির যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে। এ দিকে যুগের হাওয়ার সঙ্গে তাল না মেলালেই নয়, নইলে যাদবপুরের সুদিনও কাল না হোক পরশু গত হবে। তবু বলা যায়, নানা দিকে নানা উদ্দেশ্যে উন্নয়নের বহু পথ আজ খোলা, অন্তত নানা খাতে টাকা-পয়সা পাওয়া যায়। এই সুযোগ পশ্চিমবাংলার প্রতিষ্ঠানগুলি কাজে লাগায় কম। ইউজিসি-র আঞ্চলিক দফতরের বরাবরের দুঃখ, তাদের বরাদ্দ টাকা খরচ করা দুষ্কর, কলেজগুলি কিছু চায়-ই না। আগের তুলনায় সচেতনতা নিশ্চয় বেড়েছে, কিন্তু অবহেলিত সুযোগ আজও প্রচুর।
দেশের শিক্ষানীতির নতুন যুগের একটা সম্ভাবনা দিয়ে শেষ করছি, যা রাজ্যের নতুন নীতিতে নাটকীয় ভূমিকা নিতে পারে। সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার একটি বিশেষ বিতর্কিত দিক হল চোদ্দোটি নতুন ‘আন্তর্জাতিক মানের’ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। অল্প দিনেই প্রস্তাবটির বহু রূপান্তর ঘটেছে। প্রথম সংস্করণে এটি ছিল উদ্ভট কল্পনাশ্রয়ী চিন্তা, যার প্রকট উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক মন্দার বাজারে অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য দেশের মাটিতে একটা আশ্রয় গড়া। বহু সমালোচনা ও হয়তো কিছু আত্মসমীক্ষার পর প্রস্তাবটি খোলনলচে পাল্টেছে। এখন ভাবা হচ্ছে, বর্তমান প্রতিষ্ঠানেরই শ্রেষ্ঠ কয়েকটিকে একটা নতুন স্তরে উন্নীত করার কথা; আর তার উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে, শিক্ষায় প্রাগ্রসর কয়েকটি শহর ও অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয়েছে। শহর কলকাতা অবশ্যই সেই তালিকায় আছে।
শুধু একটি নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানই নয়, সেই সঙ্গে সামগ্রিক ভাবে কলকাতার শিক্ষাজগৎকে মস্ত এক কদম এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সময়টা নানা কারণে প্রশস্ত। দেশের কোনও রাজ্য, কোনও প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত এমন প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা নেই। পশ্চিমবাংলা যদি সবার আগে সুযোগটা গ্রহণ করে, তার সুফল কিন্তু প্রতীকের স্তরে আবদ্ধ থাকবে না। |
(শেষ)
|
সংশোধন |
এই লেখার প্রথম পর্বে (৩১-৫) দুটি মুদ্রণপ্রমাদ ঘটেছে।
এক, ভারতে তেরোটি ‘সম্ভাবনাময়’ বিশ্ববিদ্যালয়-এর
(ইউনিভার্সিটিজ উইথ
পোটেনশিয়াল ফর এক্সেলেন্স) উল্লেখ করা হয়েছিল। সংখ্যাটি ১৩ নয়, হবে ৯।
দুই, একটি বাক্য ছিল: ‘কিছু দিন আগে একটা খবর বেরোল, যার মর্র্মার্থ,
গবেষণার নিরিখে ভারতের শ্রেষ্ঠ পনেরোটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল কলকাতা।’ শ্রেষ্ঠ
পনেরোটি নয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শ্রেষ্ঠ কুড়িটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম। |
|
|
|
|
|
|