‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ যোগেশ দত্ত মূকাভিনেতা
কলকাতাকে প্রথম দেখেছিলাম সেই কোন ছোটবেলায়! দেশভাগের পর বাবার হাত ধরে ট্রেনে চেপে শিয়ালদহে আসা। তিন দিন পেটে কোনও দানাপানি পড়েনি। পরিবারের সবাই পুরোপুরি অভুক্ত। স্টেশন থেকে বাবা যখন ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ওখান থেকে একটু দূরেই একটি ভাড়াবাড়িতে নিয়ে গেলেন তখন খিদের জ্বালায় কেঁদে ফেলেছি। লম্বা টানা পুরনো বাড়ি। অসংখ্য ভাড়াটে। ওই বাড়িতে পা রাখতেই অন্যান্যরা এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কোথা থেকে এসেছি। ‘পূর্ববাংলা’ এবং ‘রিফিউজি’ শুনে তাঁরা চলেও গেলেন। ও মা, একটু পরেই দেখি বালতি ভর্তি ভাত, ডাল আর চচ্চড়ি নিয়ে তাঁরা হাজির! এমনও হয় নাকি! শুধু খিদেই মিটল না, আমাদের তিন দিন আর অন্নসংস্থানের চিন্তা রইল না।
এই শহর এতটাই মানবিক যে, না এলে তা বুঝতাম না। সেই থেকে এই শহর আমার আরও এক ‘মা’। অনেক ঘটনায় কখনও কখনও রেগেও যাই এই শহরের উপরে, কিন্তু তা সাময়িক। ছেঁড়া হাফ প্যান্ট পরে সেই কোন কালে এই শহরের ধুলো মেখেছি। আজও ধুতিপাঞ্জাবি পরে কলকাতার ধুলো মেখে চলেছি। এটা যে আমার জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। কিন্তু বয়সের ভারে এখন ভাঙা রাস্তা দেখলেই চট করে রেগে যাই। শরীরে বড় ধকল পড়ে। এক সময়ে কলকাতার রাস্তা জল দিয়ে ধোওয়া হত। ঝকঝকে রাস্তা। বহু কাল আর তা দেখিনি। ইদানীং দেখছি, কোনও কোনও রাস্তা আবারও জল দিয়ে ধোওয়া হচ্ছে।
ছোটবেলায় সিএলটিতে ভর্তি হয়েছিলাম। অভিনয়ের শেষ ধাপটাও শিখতে চাই। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। মন খারাপ করে এক দিন লেকের ধারে বসে কাঁদছিলাম। আমি বোধ হয় হেরে গেলাম। কেউ যে আমাকে কোথাও ঠাঁই দিচ্ছে না। এ রকমই এক দিন চুপ করে লেকে বসে আছি, দেখি আমার সামনে দিয়ে কত জোড়া জোড়া মহিলা ও পুরুষ চলে যাচ্ছেন। কেউ বা স্বামী-স্ত্রী, কেউ বা প্রেমিক-প্রেমিকা। ওদের আলোচনা শোনা যাচ্ছে না। অথচ কথার ধরন দেখে তা অনুমান করা যাচ্ছে। বোঝাও যাচ্ছে। তখনই আমার মনে হল, আচ্ছা ওদের এই ভাষাটাকে যদি আমি মূকাভিনয়ে রপ্ত করতে পারি? সেই শুরু। আমার জীবনটাই দ্রুত বদলে গেল। কাগজে প্রশংসা আর ছবি।
ফাংশনে ডাক পাচ্ছি। যাঁরা আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন তাঁরাই ডেকে প্রশংসা করছেন। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো। উত্তর কলকাতায় জীবনের প্রথম অনুষ্ঠানে আমার আগে ভি বালসারা অপূর্ব সুরে মাত করে দিলেন দর্শকদের। এর পরে আমার ডাক। তা-ও আবার মূকাভিনয়। বুক দুরদুর করছিল। কিন্তু হারলে চলবে না। তিনটি কাহিনি দেখালাম মূকাভিনয় করে। ব্যস, ধুন্ধুমার কাণ্ড। দর্শকদের হাততালি আর প্রশংসায় মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। তার উপরে বালসারাজি নিজে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। এই হল কলকাতা। ভাল জিনিসের কদর করতে জানে।
জীবনে তো বহু বার বিদেশে গিয়েছি। প্রথম গিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়ায়, বিশ্ব যুব উৎসবে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে। সে দেশে আমাদের মূকাভিনয় দেখে ওরা তো অবাক। মিডিয়া ঘিরে ধরেছিল আমাকে। প্রশ্ন ছিল একটাই, ‘‘এমন অভিনয় আপনি উৎসর্গ করবেন কাকে?’’ আমার তৎক্ষণাৎ উত্তর ছিল, ‘‘কলকাতাকে। যে শহর আজ আমাকে এখানে পাঠিয়েছে।’’
বয়স হলেও এখনও নিয়ম করে ভোর সাড়ে চারটেতে ঘুম থেকে উঠেই ম্যাডক্স স্কোয়্যারে হাঁটতে যাই। সাতটার মধ্যে যোগেশ মাইমে গিয়ে নতুনদের প্রশিক্ষণ দিই। ফেরার পথে বাজারে ঢুকি। মাছ কেনা আমার হবি। বিভিন্ন রকমের মাছ। মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আড্ডা মারতে খারাপ লাগে না। ওরাও যে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের কত খবর রাখে তা ভাবাই যায় না।
একটা ব্যাপারে আমার খুব দুঃখ আছে। বলব?
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই। এরা কারা? আমি যখনই যাই দেখতে পাই, আমার প্রিয় কয়েকটা টেবল ঘিরে বসে আছে কয়েক জন সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ। যাঁরা ব্যবসা বাড়াবার উপায় খুঁজছে। সত্যি বলছি, আর আমি ওখানে যাই না।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.