আমার বাড়ি জোড়াবাগান। মিঠুন চক্রবর্তীর আদি বাড়ির উল্টোদিকে। বাবার কর্মসূত্রে আমার শৈশব জীবন কাটে মেদিনীপুরে। পরে অবশ্য ফিরে আসি কলকাতার বাড়িতে। ইতিমধ্যেই জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ভাল ফল করে ভর্তি হলাম একটি নামী বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। স্মৃতির পাতা ওল্টাতেই প্রথমে মনে পড়ে বাড়ির পাশে শিউলি গাছটির কথা। দারুণ বন্ধুত্ব হয়েছিল ‘ওর’ সঙ্গে। বিকেল বেলায় গাছটির নীচে বসে মনের সুখে মাউথ অর্গ্যান বাজাতাম। গ্রীষ্মের রোদে খেলাধুলো করার পর ক্লান্ত হয়ে ‘ওর’ স্নিগ্ধ শীতল ছায়ায় আশ্রয় নিতাম। বড়া খাবে বলে যখন প্রতিবেশীরা গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ত, তখন খুব কষ্ট হত।
দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেল। কলেজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেঙ্গালুরুর একটি বহুজাতিক সংস্থায় ডাক পেলাম। চলে এলাম অনেক স্বপ্ন নিয়ে, নতুন ভবিষ্যতের খোঁজে। সেখানে গিয়েই মনে হল ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। জোরে আরও জোরে দৌড়তে হবে, নইলে পিছিয়ে পড়ব যে! বেঙ্গালুরুতে কর্মব্যস্ততার মধ্যে থাকলেও আমার ‘পরম বন্ধু’কে স্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে দিইনি কখনও। অবসরে যখনই বাড়িতে ফিরেছি শিউলি গাছটিকে দেখে পরম তৃপ্তি অনুভব করেছি। ভিনদেশি হয়েছিলাম বলে হয়তো এমন অনুভূতি কাজ করত। ক্লান্ত শরীরে ‘ওর’ স্নিগ্ধ শীতল ছায়ায় আর আশ্রয় নেওয়া হয় না ঠিকই! কিন্তু বাড়িতে এলেই ‘বন্ধুত্বের টানে’ বিকেল বেলা গাছের বাঁধানো বেদিতে গিয়ে বসি। তখন মনে হয় শিউলি গাছটি আমার কানে কানে বলছে, ‘‘বন্ধু তুমি ফিরে এসো। তুমি না থাকলে এই খেলাঘরে বড্ড একা লাগে। গ্রীষ্মের দাবদাহে একটু জলের জন্য আকুতি মিনতি করেও জল পাই না। তখন তোমার অভাব বোধ করি। ফিরে এসো স্বদেশে তুমি মোর মুখপানে চেয়ে!’’ কিন্তু আমি ‘ওর’ কথা শুনিনি। আর স্বার্থপরের মতো মনে মনে বলেছি, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও
আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি
যেটা ছিল না ছিল না সেটা না পাওয়াই থাক
সব পেলে নষ্ট জীবন...’
তবে সবচেয়ে স্মৃতিমধুর বিষয়, শরতের সময় বাড়িতে এলে আমার প্রবেশ পথে ‘বন্ধু’ যেন ফুল বিছিয়ে রেখে সাদর অভ্যর্থনা জানাত।
এখন আমি আরও বড় কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি। আগের থেকে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বেশি মাইনে। পাশাপাশি আরও দায়িত্ব, আরও কাজ। ঠিক দু’বছর পর আবার কলকাতায় ফিরে এলাম। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার মুখেই আমি থমকে গেলাম। পরিবর্তনটা বুঝে উঠতে কিছুটা সময় গেল। সম্বিত্ ফিরে পেতেই বুঝলাম অভ্যর্থনা জানাতে ‘বন্ধু’ আর সেইখানে দাঁড়িয়ে নেই। এসেছে এক নতুন অতিথি, ছোট্ট একটি গাছ। পরে জানলাম পুরসভার কর্মীরা শিউলি গাছটি কেটে নতুন এই চারাগাছটিকে লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে। হতাশ হলাম এই ভেবে, আর ‘সে’ আমাকে ছায়া দেবে না, আমার জন্য অপেক্ষা করবে না, কানে কানে নিজের সুখ দুঃখের অনুভূতিও ব্যক্ত করবে না! এখন আমার ‘পরম বন্ধু’ চলে গিয়েছে অনেক দূরে। মনে মনে নিজের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে, রাগে দুঃখে ফের ফিরে গেলাম কর্মস্থলে। দায়িত্ব ও কাজের জগতে নিজেকে একাত্ম করার চেষ্টায় মগ্ন হলাম। কিন্তু স্মৃতিগুলো তো নিজের হৃদয়ে বহন করেই নিয়ে এলাম! এখন আমার সঙ্গী একদা আমার মতো বেঙ্গালুরুবাসী গায়ক অনুপম রায় এর গান— ‘বাড়িয়ে দাও তোমার হাত
আমি আবার তোমার আঙ্গুল ধরতে চাই...
বাড়িয়ে দাও তোমার হাত, আমি তোমার পাশেই হাঁটতে চাই...’
জন্ম কলকাতায়। ডঃ বি সি রায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি। এখন বেঙ্গালুরুতে আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ওরাকেল কর্পোরেশনে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্টে কর্মরত।
ভাল লাগে বই পড়তে, রান্না করতে, গান শুনতে আর ঘুরে বেড়াতে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.