বৈচিত্রময় শিল্পের জাদুকর
ব্যবহারিক শিল্প বিভাগের প্রায় প্রত্যেকটিই যে মানুষটির স্পর্শে রঙিন হয়ে উঠেছিল সেই বহুমুখী শিল্পীর ছিল না কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা। কর্মজীবন শুরু বইয়ের প্রচ্ছদ অলঙ্করণ ও বিজ্ঞাপন শিল্প দিয়ে। দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন কলকাতার নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে। পুতুলনাচে ইতিহাস রচনা করেছিলেন তিনি। ছোটবেলার কোনও মেলায় দেখা পুতুলনাচ থেকে উৎসাহ পেয়েছিলেন। খুব দুবর্লতা ছিল গ্রামীণ পুতুলের প্রতি। পুতুলনাচ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণামূলক কাজও করেছিলেন। এই ক’টি বাক্যে যাঁর সৃষ্টি-পরিচয়কে কোনও ভাবেই ধরা সম্ভব নয়, প্রচারবিমুখ সেই শিল্প-জাদুকর রঘুনাথ গোস্বামী এ বার ‘অতীতের তাঁরা’য়।
ছোটবেলা থেকেই ছেলেটার ভাল লাগত ছবি আঁকতে। ভালবাসত মাটি-কার্ডবোর্ড-কাগজ-সহ ফেলে দেওয়া বিভিন্ন জিনিস দিয়ে মজাদার কিছু তৈরি করতে। কিন্তু বাড়ির অনেকেই সেটা ঠিক পছন্দ করতেন না। ফলে, ছেলেটি নিজের মনের মতো এ সবের এক আশ্চর্য কারখানা গড়ে তুলেছিল খাটের তলায়। সবার চোখের আড়ালে, নিভৃতে নির্জনে, নিজের সঙ্গেই এমন শিল্প-খেলায় মেতে উঠত ছোট্ট রঘু। তবে এক জনের চোখ এড়ানোটা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি, রঘুর ছোটমামা। ছবি আঁকায় ভাগ্নের উত্সাহ দেখে কিনে দিলেন পেন্সিল-রং-কাগজ। ছোটমামা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন, ছোট্ট রঘু এক দিন এই রং-বাজিতেই ভুবন কাঁপিয়ে হয়ে উঠবে একটি ব্র্যান্ড— রঘুনাথ গোস্বামী। শুধু রঙের গণ্ডিতে নিজেকে আটকে রাখেননি তিনি, শিল্পের নানা মাধ্যমেই তাঁর ছিল অবাধ যাতায়াত। গানবাজনা থেকে প্রকাশনা, বিজ্ঞাপন জগত্ থেকে পাপেট থিয়েটার— রঘুনাথ রং-রেখাকে সঙ্গে নিয়েই এমন ভাবে জুড়ে গিয়েছিলেন এ সব কাজে যে, অনায়াসেই তাঁকে ‘শিল্প-পতি’ বলা যায়।

ছোটবেলা ও সংস্কৃতি চর্চা
১৯৩১ সালের ১৩ জানুয়ারি। হাওড়ার সাঁতরাগাছির ভট্টাচার্য পরিবারে রঘুনাথ গোস্বামীর জন্ম। জন্মানোর পর ছোটবেলাটাও কেটেছে এই মামাবাড়িতেই। মামাদের বড় আদরের রঘু আদতে হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের গোস্বামী পরিবারের বংশধর। বাবা উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী ছাত্র। মা রানিবালা দেবী। বড়মামা সুকুমার ভট্টাচার্য ছিলেন ধ্রুপদ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে পারদর্শী। ছোটমামা শিবশঙ্কর সরোদবাদক। ফলে গানবাজনার চর্চা নিয়মিত হওয়ায় মামাবাড়িতে আসতেন নানা গুণীজন। সেই সূত্রেই রঘুনাথের গান ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। ছবি আঁকাতেও তার ব্যাপক উত্সাহ। আসলে মামাবাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশই তার মনে সঙ্গীতপ্রীতি ও ছবি আঁকার প্রতি ভালবাসা গড়ে তোলে।

এর পর মামাবাড়ির ডেরা ছেড়ে রঘুনাথ চলে এলেন কলকাতার পাইকপাড়ায় রানি হর্ষমুখী রোডে। তখন শৈলেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক শিল্পব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর সান্নিধ্যেই তিনি অল্প বয়সে ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেন। রঘুনাথ ছবি আঁকতেন অবনীন্দ্র-নন্দলাল প্রবর্তিত ধারায়, কখনও বা অন্য ধারায়। আর এখানেই অন্নদা মুন্সীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও হৃদ্যতা হয়। ইউরোপীয় সঙ্গীত কী ভাবে শুনতে হয় তা বোঝার জন্য রঘুনাথ ওঁর কাছে যেতেন। উপেন্দ্রকিশোরের একটি জার্মান বেহালা অন্নদা মুন্সী তাঁকে দিয়েছিলেন। সেই বেহালাতেই রঘুনাথের বেহালা শেখা।

শিক্ষাজীবন
রঘুনাথ গোস্বামীর পড়াশোনা বেলগাছিয়ার মনোহর অ্যাকাডেমিতে। পরে রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি। আর্টের দিকে বিস্তর ঝোঁক, তাই গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য বসলেন প্রবেশিকা পরীক্ষায়। তবে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বাঁধাধরা গণ্ডির মধ্যে থাকতে চাননি রঘুনাথ। কাজেই সরকারি আর্ট কলেজের ছাত্র হওয়া আর হয়ে ওঠেনি। তাতে যদিও শিল্পী হওয়া আটকায়নি তাঁর।

প্রকাশনা জগতের কিস্সা
বিজ্ঞাপন ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে নিজস্ব একটি স্টাইল গড়ে তুলেছিলেন রঘুনাথ গোস্বামী। অসামান্য দক্ষ এই শিল্পীর রেখচিত্রের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। রঘুনাথ তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন কমার্শিয়াল আর্ট মর্যাদাপূর্ণ, কার্যকরী, শিল্পগুণ সমন্বত ও কমিউনিকেটিভ। সেই সময় পূর্ণ চক্রবর্তী, প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর দে-রা তো ছিলেনই, সঙ্গে পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, মাখন দত্তগুপ্তদের। কাজের উৎসাহ বেড়ে চলল। এই কাজে গজেন্দ্রনাথ মিত্র, গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বইয়ের ডিজাইনেও অসাধারণ কাজ করেছেন রঘুনাথ। এবং সেই সুবাদে তিনি প্রবোধ সান্যাল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, কবি কালিদাস রায়, মুজতবা আলি, প্রেমেন্দ্র মিত্র-সহ নামজাদা সব সাহিত্যিকদের সান্নিধ্যে আসেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এতটাই ভক্ত ছিলেন যে, বিভূতিবাবুর ‘ইছামতী’র (প্রথম সংস্করণ) প্রচ্ছদ আঁকার জন্য রঘুনাথ ইছামতী দেখতে গিয়েছিলেন ওঁর সঙ্গে।
শুধু বই-ই নয়, পত্রপত্রিকার সঙ্গেও রঘুনাথের ছিল অন্তরের সম্পর্ক। ‘সারস্বত’ পত্রিকার প্রকাশক এবং মুদ্রকের পাশাপাশি চিত্রায়ন ও অঙ্গসজ্জার কাজও করেন তিনি। অন্য দিকে, ‘সুন্দরম’ পত্রিকার প্রচারশিল্পী ও লেখকও ছিলেন। বেঙ্গল স্যোশাল সার্ভিস-এর পক্ষ থেকে পরের দিকে একটি বই লিখেছিলেন রঘুনাথ গোস্বামী।

বাংলা ক্যালেন্ডারে রঘুনাথবাবু এনেছিলেন এক বর্ণময় বৈচিত্র। উনবিংশ শতাব্দির উডকাট প্রিন্টের আধুনিক ক্যালেন্ডার, ছয় পাতার একটি বাংলার ব্রতকথার ক্যালেন্ডার (মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছিল), বটতলার উডকাট প্রিন্টের ব্যবহার করে ১৩ পাতার একটি বাংলা ক্যালেন্ডার— এ সবই তাঁর অনন্য সৃষ্টি। এ ছাড়া যামিনী রায় (বাংলা) ও নন্দলাল বসুর (ইংরেজি) জন্ম শতবর্ষেও ক্যালেন্ডার করেছিলেন রঘুনাথ গোস্বামী।

এ সবের পাশাপাশি রঘুনাথ বিভিন্ন ধাতু দিয়ে ভাস্কর্য গড়তেন, অতি নিপুণ হাতে।

...গোস্বামী অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস
১৯৫৩ সালে আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে জে ওয়াল্টর থম্পসন কোম্পানিতে যোগ দেন রঘুনাথ। এখানে থাকতেই গ্রাফিক্স ডিজাইন ছাড়াও এগজিবিশন ডিজাইনে স্পেশালাইজেশন করেন। স্বাধীন ভারতে প্রথম শিল্প মেলা হয় নয়াদিল্লিতে। সেখানে তাঁর নির্মাণ— ন্যাশনাল কার্বন, টাটা স্টিল-এর প্যাভিলিয়ন— উল্লেখযোগ্য ভাবে নজর কাড়ে। দিল্লিতেই ‘ইন্ডিয়া ১৯৫৮’ মেলায় ‘ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্যাভিলিয়ন স্বর্ণপদক পায়। সেটিও তাঁর কীর্তি। ভারতের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থায় আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করলেও চাকরি ছেড়ে ১৯৬১ সালে কয়েক জন সহকর্মীকে নিয়ে ‘আর গোস্বামী অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ নামে নিজস্ব ডিজাইন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন রঘুনাথ গোস্বামী।
‘ক্যালকাটা পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।
সাতের দশকে আমদাবাদের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইন’-এর সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর। ‘আর গোস্বামী অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ ও ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইন’-এর যৌথ উদ্যোগে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কর্ম ও জীবন নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য স্থায়ী প্রদর্শশালা গড়ে ওঠে।

ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও ফ্যাব্রিকেশনের উপর তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ দেখা যায় রাধা সিনেমা, দিল্লির কনট প্লেস, বাটা ইন্ডিয়ার কলকাতা এবং হংকং ব্যাঙ্কের বিবাদি বাগ ও নিমতলা শাখায়।

পাপেট চলচ্চিত্র অ্যানিমেশন ডকুমেন্টারি
ছোটদের জন্য পাপেট থিয়েটারের উপর রঘুনাথবাবু নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ‘দ্য পাপেট’ নামে একটি সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৯ সালে উদয়পুরে ‘অল ইন্ডিয়া পাপেট অ্যান্ড ডামি ডান্সার ফেস্টিভ্যাল’-এ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে তাঁর সংস্থা। সেরা শিশু চলচ্চিত্র হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক লাভ করে ‘হট্টগোল বিজয়পালা’। সুকুমার রায়ের জন্মশতবর্ষে আবোল তাবোলের ‘রামগড়ুরের ছানা’, ‘চোরধরা’র ভিডিও ছবি তৈরি করা হয়। অ্যানিমেশন করা হয় ‘খুড়োর কল’। শ্যাডো পাপেট আর লাইভ অ্যাকশনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল ‘হ য ব র ল’। ১৯৬৩তে স্বামী বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক ভাবাদর্শের উপরে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছিল, যাতে ক্যামেরায় রামানন্দ সেনগুপ্ত ছিলেন এবং বাংলায় ধারা বিবরণী দিয়েছিলেন সবিতাব্রত দত্ত।
এ ছাড়া বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত ও শিক্ষামূলক পাপেট ফিল্ম তৈরি করেছেন। কলকাতার মঞ্চে প্রথম পাপেট ব্যবহার করেছিলেন রঘুনাথ গোস্বামী। রিচার্ড শেকনারকে নিয়ে থিয়েটার আর্টসের উপর কর্মশালা তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। তৈরি করেছেন দূরদর্শনের জন্য বহু পাপেট থিয়েটার। তিনি অ্যানিমেশন এবং কার্টুন ফিল্মের বিকল্প হিসেবে ছায়া পুতুলনাট্য নিয়ে কাজ করেছিলেন। নিজেদের তৈরি ভিডিও সেন্টারে টিভি সিরিয়াল করেছেন ছোটোদের জন্য।

লন্ডন, প্যারিস, রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ভারতোৎসবে সামগ্রিক ভাবে মণ্ডপ সাজানোর মূল পরিকল্পক ছিলেন রঘুনাথবাবু। কলকাতার বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটারের মঞ্চ ও পোশাক পরিকল্পনার ব্যাপারেও তাঁর পারদর্শীতা লক্ষণীয়। তাঁর কাজে ভারতীয় লোকশিল্পের প্রভাব দেখা যায়।

পুতুলনাচের অবদানের জন্য রাজ্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন ১৯৯১-৯২তে। পুতুলনাচের আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইউনিমা’র ভারতীয় শাখার তিনিই ছিলেন প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট। কলকাতা জাদুঘরে তাঁর ‘পুতুল’দের নিয়ে এক প্রদর্শনীও হয়েছে।

শেষের সে দিন
স্ত্রী উমা দেবীর সঙ্গে রঘুনাথ গোস্বামী
শিল্পচর্চার বিভিন্ন অঙ্গনে সাফল্যের সঙ্গে নিজের কৃতিত্ব প্রমাণ করে ১৯৯৫ সালের ১৯ জানুয়ারি চলে গেলেন ‘শিল্প-পতি’ রঘুনাথ গোস্বামী। স্ত্রী উমা গোস্বামী ও পুত্র মঙ্গল গোস্বামীকে রেখে তাঁর এই চলে যাওয়া আসলে ভারতের শিল্প-মানচিত্র থেকে এক নক্ষত্রের নিঃশব্দ পতন।

স্মৃতিচারণ
দিলীপ ভৌমিক (ভ্রাতৃপ্রতিম): রঘুদা ছিলেন বড় স্নেহময়। সকলকে বন্ধুত্বের বাঁধনে বেঁধে রাখার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তাঁর জীবনের প্রেরণা— শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের আদর্শ। শিল্প বিভাগের যে ক’টি পর্যায়ে তিনি হাত দিয়েছেন সেখানেই দৃষ্টান্ত রেখেছেন। অসামান্য বাদক ছিলেন। শুধু সরোদই নয়, পিয়ানো, ঢোল, দোতারা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র পুতুলনাচের সঙ্গে বাজাতেন। পুতুলনাচের তিনিই পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, পোশাক পরিকল্পক ও সঙ্গীত পরিচালক। কর্মপ্রিয়তা, সৃষ্টির আবেগ, স্বভাব-ভদ্রতা রঘুনাথ গোস্বামীকে সর্বদাই কর্মময় করেছে। উনি একজন ভাল শিক্ষকও ছিলেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, বিমল কর, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দক্ষিণারঞ্জন বসু, অন্নদা মুন্সী-সহ বহু জ্ঞানীগুণী মানুষই তাঁর পাইকপাড়ার বাড়িতে আসতেন। সেখানে ছিল একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ। ছোটদের জন্য চিন্তা ভাবনা ছিলই। তাদের জন্য পুতুলনাচের রকমফের তৈরি করেছিলেন। নিরন্তর গবেষণা তাঁর পুতুলনাচে অন্য মাত্রা দিয়েছিল। তিনি যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন সেখানে শেষে থাকত রঘুদার পাপেট শো। দোলের সময় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে গুণীসমাবেশ হলে থাকত ওঁর পাপেট শো আর শেষে লুচি-মাংস। পশ্চিমবঙ্গে পাপেট গ্রুপগুলিকে নিয়ে ‘ফেডারেশন অফ পাপেট থিয়েটার’ গড়ে তোলেন রঘুদা। আত্মপ্রচার ও অহমিকার লেশমাত্র কখনও ওঁর মধ্যে দেখিনি।


মনোজ মিত্র (নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা): রঘুদার মতো বিভিন্ন ব্যাপারে ‘পাইওনিয়ার’ মানুষ খুব কম দেখেছি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ওঁর অনেক কিছুই আমরা মনে রাখিনি, মনোযোগ দিয়ে দেখিওনি। সেই সময় হয়তো যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না, তাই তাঁর অমূল্য সে সব সম্পদ আজ আমরা হারাতে বসেছি। প্রচারবিমুখ মানুষটি প্রকাশ্যে আসতে পারেননি। থিয়েটার ওয়ার্কশপের ‘অশ্বত্থামা’ পড়ে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, আমাকে আর বিভাস চক্রবর্তীকে নিয়ে গহনার জন্য গোটা চিৎপুর ঘুরেছিলেন। কাহিনির দৃশ্যপট, পোশাকআশাক ও গহনায় এনেছিলেন পৌরাণিক ভাব— আশ্চর্য রূপ দিয়েছিলেন নাটকটিতে। গোধূলিবেলায় একটি দৃশ্যে যেখানে দুর্যোধন হাঁটু ভেঙে বসেছিলেন সেই সময় নেপথ্যের বাজনা আর সঙ্গে তাপস সেনের আলো আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ‘গল্প হেকিমসাহেব’ যখন করি, তখন রঘুদা সব চরিত্রগুলো ছবি এঁকে এঁকে তাদের পোশাক কেমন হবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সব একটা খাতায় লিখেও দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি সেই খাতাটি হারিয়ে ফেলেছি।


স্বপ্না সেন (শিল্পী): তখন আমি আর্ট কলেজের ছাত্রী। বিবেকানন্দ কেন্দ্রে একটি প্রদর্শনীতে প্রথম আলাপ হয় রঘুদার সঙ্গে। তার কথা বলার ধরন মুগ্ধ করে আমাকে। অত্যন্ত সহজ, সরল, শান্ত ব্যবহার। এর পর কর্মসূত্রে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় একটি ছোটদের নাটকের সুবাদে। কাঞ্চন দাশগুপ্ত পরিচালিত সেই নাটকের রূপসজ্জার দায়িত্বে ছিলেন রঘুদা। তার পর থেকে উনি হয়ে গেলেন আমার জীবনের আদর্শ। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন অথচ প্রচারবিমুখ এই মানুষটির ধ্যান জ্ঞান ছিল শিল্প আর সৃষ্টি। এবং সেই সৃষ্টির একটি অন্যতম দিক ছিল পাপেট। শিশুমন ও তার বিকাশের ক্ষেত্রে পুতুলনাচ বা পাপেট যে অভাবনীয় একটি মাধ্যম তা পূর্ণ রূপে উপলব্ধি ও কাজে লাগানোর জন্যই যেন রঘুনাথ গোস্বামীর জন্ম হয়েছিল। ছোটবেলায় কোনও এক গ্রামে দেখা পুতুলনাচ দেখে পরবর্তী কালে তাকে আন্তর্জাতিক স্তরে পরিবেশন করা ও স্বীকৃতি পাওয়া খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু রঘুদা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেন। তাঁর সৃষ্ট পাপেটগুলিতে থাকত গ্রাম বাংলার ছোঁয়া। ‘আগডুম বাগডুম’-এ যোদ্ধাদের বেশ ছিল ভারতীয় আঙ্গিকে। রঘুদা পাপেটকে অ্যানিমেশনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করেন। ওঁর কাজের মূলমন্ত্র ছিল ‘লো কস্ট’। ফেলে দেওয়া বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস কাজে লাগাতেন তার পাপেট রাজ্যে। বর্তমান লেক টেরাস-এর জায়গায় একটা স্কুল ছিল। সেই স্কুলবাড়ির ছাদে তখন সপ্তাহান্তে ‘পাপেট শো’ হত।

ওঁর কর্মজীবন নিয়ে অনেকে অনেক কথাই হয়তো বলবেন, আমি মানুষ রঘুদা সম্পর্কে দু’এক কথা বলি। রঘুদা ছিলেন স্বামীজির একনিষ্ঠ ভক্ত। ছোটবেলায় এক বার স্বামীজির বাড়িতে গিয়ে দাদা মহেন্দ্র দত্তের সঙ্গে দেখা করে রঘুদা নিজের আঁকা ছবি দেখিয়েছিলেন। পরে বড় হয়ে জানতে পারেন যে, মহেন্দ্র দত্ত তখন চোখে দেখতেন না। তবুও শিশুমনে আনন্দ দিতে তিনি বলেছিলেন, ছবিটি খুব সুন্দর। রামকৃষ্ণদেবের উপদেশ ও দর্শন নিয়ে একটি ‘সিরিজ’ তৈরি করেন রঘুদা শ্যাডো পাপেটের মাধ্যমে।

তিনি ছিলেন ভোজনরসিক। রান্নাও করতেন বেশ ভাল। দোল আর পয়লা বৈশাখের দিন ওঁর বাড়িতে জমিয়ে আড্ডা হত। বাড়িতে সরস্বতী পুজো করতেন, থার্মোকলের প্রতিমা নির্মাণ করে। যে কোনও কাজই শুরু করার আগে সেই বিষয় নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা ও গবেষণা করতেন রঘুদা। উনি বিশ্বাস করতেন ‘পারফেকশন’-এ। কাজের সূত্রে আমি ওঁর সঙ্গী ছিলাম ঠিকই তবে ছাত্রী বললেও ভুল হবে না। নিত্য দিন যাপনে অর্থের প্রয়োজন অস্বীকার করব না, তবে কোথায় যেন রঘুদার আদর্শ এখনও জেগে আছে মনের কোণে— আগে শিল্প।


প্রণবেশ মাইতি (প্রচ্ছদশিল্পী ও গবেষক): ব্যবহারিক শিল্প বিভাগের প্রায় প্রতিটি বিভাগ যে মানুষটির স্পর্শে রঙিন হয়ে উঠেছে সেই বহুমুখী শিল্পী রঘুনাথ গোস্বামীর ছিল না কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা। কর্মজীবন শুরু বইয়ের প্রচ্ছদ অলঙ্করণ ও বিজ্ঞাপন শিল্প নিয়ে। কলকাতার নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে তিনি দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন। ছিলেন ‘গল্প হেকিম সাহেব’, ‘শোয়াইক গেল যুদ্ধে’, ‘আলিবাবা’, ‘অশ্বত্থামা’, ‘মুদ্রারাক্ষস’ প্রভৃতি নাটকের সঙ্গে। প্রকাশনা শিল্পে তাঁর কাজ উল্লেখযোগ্য। ছোটদের জন্য অসম্ভব দরদী মন ছিল। তৈরি করেছিলেন লোককাহিনি ও উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্য নিয়ে ছোটদের পকেট বই, যাতে ছিল দুই রঙের আঁকা। তাঁর এই প্রচেষ্টা সেটাই প্রথম এবং শেষও। গল্প সঙ্কলনের ক্ষেত্রে তাঁর অলঙ্করণ— শিশুসাহিত্যে ‘সোনার কাঠি রুপোর কাঠি’, ‘পাতার বাঁশি’, ‘ক্ষীরের পুতুল’ এবং বড়দের ক্ষেত্রে বিমল করের ‘যযাতি’, ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’, প্রমথনাথ বিশীর ‘সিন্ধুনদের প্রহরী’, ‘মায়াকানন’, ‘চটজলদি’ ইত্যাদি। প্রচ্ছদের ক্ষেত্রেও স্বতন্ত্রতার ছাপ রেখে গিয়েছেন। ১৯৫৭ সালে রমাপদ চৌধুরীর ‘অরণ্য আদিম’ ১৯৬০ সালে সৈয়দ মুজতবা আলির ‘শবনম’, ১৯৭৬-এ চিত্ত সিংহের ‘ঈশ্বর পাটনী’তে তাঁর কাজ উল্লেখযোগ্য। এই সব প্রচ্ছদে রয়েছে কোথাও ইসলামিক, কোথাও বা লৌকিক মোটিভ, আবার কোথাও ফসিলের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রচারবিমুখ মানুষটি থেকে গেলেন অন্তরালেই।


দীপঙ্কর সরকার (শিক্ষক, পাঠভবন): যখন কলকাতায় সাদাকালো টেলিভিশন এল, তখন রঘুদার কাছে দায়িত্ব গেল ছোটদের জন্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান তৈরি করার। যূথিকা দত্তের প্রযোজনায় রঘুদা উপেন্দ্রকিশোর যে ভাষায় লিখতেন সেই ভাবে বিষয়গুলি উপস্থাপন করতেন। তিনি সব সময় লক্ষ রাখতেন শিশুদের জন্য কোনও অনুষ্ঠান যেন তাদের বোধগম্যের বাইরে না চলে যায়। তাই অ্যানিমেশনের মাধ্যমে, শেড ও শ্যাডোর ব্যবহার সহযোগে উপভোগের যোগ্য করে তুলতেন প্রযোজনাটিকে। প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর ওঁর সঙ্গে কাজ করেছি। সব অনুষ্ঠান শিক্ষামূলক হলেও তার গ্রাফিক্সের মানের দিকে নজর থাকত তীক্ষ্ণ। আমি ওই অনুষ্ঠানের অঙ্কের দিকটা দেখতাম।


কাঞ্চন দাশগুপ্ত (শিল্পী): পুতুলনাচে ইতিহাস রচনা করেছিলেন রঘুদা। ছোটবেলার কোনও মেলায় দেখা পুতুলনাচ থেকে উৎসাহ পান তিনি। গ্রামীণ পুতুলের প্রতি খুব দুবর্লতা ছিল। পুতুলনাচ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণামূলক কাজ করেছিলেন। শ্যাডো পাপেটে উপেন্দ্রকিশোরের ‘দুষ্টু বাঘ’ খুবই তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। লৌকিক পুতুলনাচে তিনি গুরুত্ব বেশি দিয়েছিলেন। মুখ নাড়ার সঙ্গে কথা বলাকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু মুখ, হাত-পা নাড়ার সঙ্গে পৃথক কথন ও সাজসজ্জায় মনোনিবেশ করেছিলেন। আধুনিক পুতুলনাচকে অত্যাধুনিক না করে তাকে পরিণত করেছিলেন ছায়াচিত্রে। তাঁর লক্ষ্য ছিল শিশুদের মনোরঞ্জন করা। সে কারণেই পুতুলনাচ সঙ্গীত নির্ভর ও রঙিন করে তুলেছিলেন। আমার দুর্ভাগ্য তাঁর কাজ আমি সে ভাবে দেখে উঠতে পারিনি। তবে আবার সৌভাগ্য, তিনি যখন কোনও কর্মশালা করেছেন তাতে আমি থাকতে পেরেছি। রঘুনাথদা কখনও ‘কম্প্রোমাইজ’ করেননি। শ্যাডো পাপেট তো আজও হল না। ওঁর ভাবনা এত সমসাময়িক ছিল, যা আজও সারা ভারতবর্ষে দেখিনি। পাশাপাশি তাঁর মঞ্চ নির্মাণও ছিল অসাধারণ। এক বার শম্ভু মিত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘তিনটি নাটকের নাম বলুন যেগুলির মঞ্চসজ্জা আপনার ভাল লেগেছে!’’ তিনটি নাম বলেছিলেন তিনি, যার দু’টিই ছিল রঘুদার করা (অশ্বত্থামা, মুদ্রারাক্ষস ও রাজা)।


শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের
কর্ম ও জীবন নিয়ে স্থায়ী প্রদর্শশালা।
রঘুনাথ গোস্বামীর স্থায়ী আঁকা আছে
বেলুড় মঠ (১৯৮৫) ও হায়দরাবাদে (১৯৮৮) (শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শন), কন্যাকুমারিকায় (১৯৭০) (বিবেকানন্দ শিলার চত্বরে স্বামীজির পরিব্রাজক জীবন সম্পর্কে), রবীন্দ্রভবন-শান্তিনিকেতন, শ্রীচৈতন্য রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়াম-এ।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রদর্শনী
১৯৮২তে লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে ক্রাফটস অফ বেঙ্গল প্রদর্শনী।
একই বছরে একই জায়গায় ইন্ডিয়া অ্যান্ড ব্রিটেন প্রদর্শনী।
১৯৮৫তে কলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশন ইউথ কনভেনশন প্রদর্শনী।
১৯৮৫তে ফ্রান্সের ভারত উৎসবের তিনি সহ-পরিকল্পক ছিলেন।
১৯৮৭তে সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো, লেলিনগ্রাদ ও তাসখন্দের ভারত উৎসবের তিনি সহ-পরিকল্পক ছিলেন।
The Indian Jute Mill Association India, 1958.
EEPC, CAPEXIL, Basic Chemical Export Promotion Coun-cil’s.
Pavillion at the ECAFE session in Delhi, 1966.
Bata Pavillions International Leather Fair, 1968, 1969, 1970, 1972.
ILF Madras 1968.
Bata Shoe Conference, Can-ada, 1969, Export Conference 1971 and ASIA ’72.
Hindusthan Steel, Ghana, Montreal 1967
Yogoslavia, Sydney, Calcutta 1975
CAPEXIL Pavillion ASIA ’72,
Hindusthan Motors Pavillion (interior only) ASIA ’72
The United Bank Of India, Silver Jubilee Exhibition, Calcutta, 1975
AGRIEXPO ’77-theme pavellion, New Delhi 1977
(In Collaboration with National Institute Of Design-1st prize winner)

বিখ্যাত ট্যাবলো
টাটা, প্রজাতন্ত্র দিবস (দিল্লি)
West Bengal 25th year of India -Independence (প্রজাতন্ত্র দিবস দিল্লি)

তথ্য: পাপিয়া মিত্র
চিত্র সৌজন্যে দিলীপ ভৌমিক, প্রণবেশ মাইতি ও দোয়েল
স্বপ্না সেনের সাক্ষাত্কার: শেলী মিত্র, ছবি: শ্রাবণী অধিকারী।
 
 

 
 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.