মানিয়ে নিয়েছি কলকাতার মল-কালচারে
সঙ্গীত শিল্পী
মার জন্ম কলকাতায় নয়। আমি চুঁচুড়ার মেয়ে। খুব ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে প্রথম কলকাতায় আসা। আমাদের একটা বড় গাড়ি ছিল। ভাইবোনেরা সবাই মিলে তাতে চড়েই কলকাতায় ঘুরতে আসতাম। তখন আমার বয়স বড়জোর দশ-এগারো হবে। একজোট হয়ে চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, মনুমেন্ট, বিড়লা তারামণ্ডল ঘুরে বেড়াতাম। তখন প্ল্যানেটোরিয়ামে টিকিটের দাম ছিল মাত্র চার আনা। এখনও খুব মনে পড়ে, পর পর দু’টো ভাষায় তারামণ্ডলে শো দেখেছিলাম। কত রকম গ্রহ-নক্ষত্র যে দেখেছিলাম, তার নামও জানি না। দিনের বেলায় অন্ধকার রাতের তারায় ভরা আকাশ দেখে অবাক হয়েছিলাম। ভিক্টোরিয়া চক্কর দিতাম ঘোড়ার গাড়ি চড়ে। ভাইবোনেরা মিলে যেতাম গড়ের মাঠে। আর তার পর ছুটোছুটি, খেলাধুলায় অতটা সময় কখন যে কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না। আর খেতাম ঠোঙায় মোড়া বাদামভাজা। তখন এত ভেলপুরি, বাটাটাপুরি পাওয়া যেত না। তবে আলুকাবলি তো ছিলই। একটু একটু করে কলকাতাকে ভালবেসে ফেললাম। আমার প্রিয় থেকে প্রিয়তম শহর।

বাবা ছিলেন পেশায় ডাক্তার। শিয়ালদহতে বাবার চেম্বার ছিল। তাই এক-দু’বার নয়, মাঝেমধ্যেই বায়না করে বাবার সঙ্গে চলে আসতাম শহরের টানে। তখনও শিয়ালদহতে ফ্লাইওভার হয়নি। বেশ জ্যাম হত। সত্যি কথা বলতে কী, ও রকম জ্যামে আমার খুব আনন্দ হত। কারণ, একটু বেশি সময় ধরে শহরটাকে দেখতে পেতাম। কত রকম মানুষ, কারও কোনও সময় নেই। সব্বাই ছুটছে।

ছোটবেলা থেকেই নাচ দেখার ঝোঁক ছিল আমার। উদয়শঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠান দেখতে এসেছিলাম এক বার। আর পাঁচটা বাচ্চার মতো ম্যাজিক দেখতেও খুব ভালবাসতাম। এক বার মহাজাতি সদনে সিনিয়র পি সি সরকারের ম্যাজিক শো দেখতে এসেছিলাম। বাড়ি ফিরে ম্যাজিক দেখানোর চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু সবার দ্বারা তো সব কিছু হয় না!

ছোট থেকেই ভালবাসতাম গান শুনতে। বাবার কাছেই গান শেখার হাতেখড়ি। নিয়ম করে হারমোনিয়াম নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা রেওয়াজে বসতাম। আর রেডিওতে গান শুনতাম। আমাদের সময়ে ছিল রেডিওর রমরমা ব্যাপার। বড় হয়েছি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে। গানগুলো শুনে শুনে নিজে গাইতাম আর বাবাকেও শোনাতাম। ১৯৬২-তে বাবার মৃত্যুর পর অসীম শূন্যতায় ভরে গেল আমার জীবন। তার পর আমার বিয়ে হয়ে গেল কলকাতায়। আর পাকাপাকি ভাবে চলে এলাম প্রিয়তম এই শহরে।

প্রথম দিকে ভাড়া বাড়ি হওয়ার জন্য দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি। বকুলবাগান, ভবানীপুর, সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এর রাস্তাঘাটের সঙ্গে আমার ওতপ্রোত সম্পর্ক। বিয়ের পর কলকাতায় এসেই আমি অনেক বড় মাপের এবং গুণী গায়কের সংস্পর্শে এসেছি। তাঁদের গুরু হিসেবে পেয়েছি। আমার গানের জীবনে প্রবীর মজুমদার, সন্তোষ সেনগুপ্ত, দীনেন্দ্র চৌধুরী প্রমুখের অবদান এখনও ভুলিনি। কলকাতায় না এলে এঁদের কাছে আসার সুযোগ পেতাম কি?

এখনও যখন ভবানীপুরের রাস্তা দিয়ে যাই, চোখের সামনে ভেসে ওঠে কত স্মৃতি। বসুশ্রী সিনেমা হলের পাশেই ছিল কফি হাউস। এক সময় কত না আড্ডা মেরেছি। কাপের পর কাপ কফি খেয়েছি। আমি খেতে খুব ভালবাসি। বিজলি গ্রিলে গিয়ে খেতাম কাটলেট। মোগলাই পরোটা খেতেও খুব ভালবাসতাম। তার টানেই মাঝেমাঝে চলে যেতাম নিউ মার্কেট। এ দিক সে দিক ঘুরে কেনাকাটার পর পেট পুরে খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। উত্তর কলকাতার মিত্র কাফের কথাই বা ভুলি কী করে? ওদের রান্নার মধ্যে এমন একটা জাদু ছিল যে বারবারই যেতে হত।

আগে সময় পেলেই দক্ষিণেশ্বর গিয়ে মায়ের কাছে পুজো দিতাম। বেলুড় মঠে ঠাকুরের মন্দিরে সন্ধ্যারতির ধূপের গন্ধ এখনও আমায় ছুঁয়ে যায়। সময়ের অভাবে এখন আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। কলকাতার আকাশ এখন এত ধূসর লাগে যে মন হাঁপিয়ে ওঠে। খোলা আকাশ দেখতে ইচ্ছে করলে চলে যাই গঙ্গার পাশে মিলেনিয়াম পার্কে। প্রাণখোলা আকাশ দেখতে দেখতে গুনগুনিয়ে উঠি ‘দূর আকাশে তোমার সুর...’।

কলকাতার মল-কালচারের সঙ্গে এখন নিজেকে জড়িয়ে নিতে খারাপ লাগে না। এক ছাদের তলায় সব কিছু পাওয়ার আনন্দই আলাদা। আমার বেশ ভাল লাগে সাউথ সিটি মল। কত আলো, কত মানুষ, হইচই, জমজমাট পরিবেশ। কখনও কখনও লোকজন আমায় চিনতে পেরে ছুটে আসে। আনন্দ হয় বেশ। মন খুশিতে ভরে ওঠে।

এই কলকাতা আমায় অনেক দিয়েছে। কলকাতায় গান গেয়েই আমি পরিচিতি পেয়েছি। পেয়েছি সম্মান, পুরস্কার। এই শহরের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। সঙ্গীতের সুবাদে আমায় বিভিন্ন শহরে যেতে হয়। কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারি না। কলকাতায় ফেরার জন্য মন হাঁসফাস করে। এই শহর আমার কাছে স্বর্গ। এখানেই আমার প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি।
 
 

 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.