আগে কলকাতায় আসতাম মফসসল শহর শিলিগুড়ি থেকে। বাবার হাত ধরে। এখন আসি আমেরিকা থেকে। আমার হাত ধরে থাকে একটি ছোট ছেলে। এই দ্বিতীয় ‘আসা’য় কলকাতা ও আমার অবস্থান একেবারে পাল্টে গেছে।
কলকাতা আমার নিজের শহর নয়। কিন্তু প্রবাসে যাওয়ার পর সে আমার নিজের ‘দেশ’।
সে সময় কলকাতা আমার কাছে ছিল অচেনা আনন্দ। সে কারণেই তার প্রচণ্ড আকর্ষণ। এত বড় বড় রাস্তা, এত অট্টালিকা, গিজগিজে লোকজন, দোতলা বাস, ট্রাম, হাওড়া ব্রিজ, লোকাল ট্রেন— সব নিয়ে ভীষণ সম্ভ্রম জাগানো ব্যাপার।
কলকাতা ঘুরে শিলিগুড়িতে যখন ফিরতাম তখন নিজেকে বেশ দামি মনে হত। যেন দারুণ কিছু একটা করে এলাম। এ শহর থেকে জিনিস কিনে নিয়ে যেতাম, যা শিলিগুড়িতে পাওয়া যেত না। অনেক দিন ধরে বন্ধু আর ভাইদের গল্প শোনাতাম— কলকাতার।
আটতলার উপর থেকে...
এক বার সেই দুষ্প্রাপ্য জিনিসের মধ্যে ভাইদের জন্য দু’টি জার্সি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম— মোহনবাগানের সবুজ-মেরুন আর ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ। মফসসল শহর তখন শুধু রেডিওতে খেলা শুনত আর খবরের কাগজে খেলোয়াড়দের ছবি দেখত। সত্যিকারের জার্সি, তাও নিজেদের মাপে, পেয়ে ওরা আনন্দ-উত্তেজনায় বিহ্বল। পরের দিনই সেই জার্সি পরে দু’জনে বারান্দা থেকে লাফিয়ে নীচে নেমে দৌড়ে গেট খুলে বেরিয়ে গেল। আর তাদের কিশোরী দিদি তখন গর্বিত মুখে তাকিয়ে আছে। তার চোখের ভাষা বলছে, এই হচ্ছে কলকাতা— এক আশ্চর্য শহর! ধুলো, জঞ্জালের পাহাড়, ভিড়ের কষ্ট, বাতাসের দূষণ— এ সবের কথা চেপে যেতাম। নিজেকে বোঝাতাম, বড় কিছু পেতে হলে ওসব একটু সহ্য করতেই হয়। তা ছাড়া কলকাতাকে কিছুতেই অন্যদের কাছে ছোট করতে পারব না।
এখন প্রতি এক-দেড় বছরে প্রবাস থেকে কলকাতায় যাই। থাকি দু’-তিন দিন। এখন যে শহর থেকে যাই সেটা অনেক বেশি জাঁকজমকওয়ালা। তাই কলকাতার সেই আগের রাস্তাঘাট, পার্ক, বিল্ডিং আর আমার মধ্যে কোনও সম্ভ্রম জাগাতে পারে না। বাতাসের দূষণে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
তবু এ শহরে না এসে আমি পারি না।
এই পরিণত বয়সে কোনও চটকদার জিনিস অথবা রঙিন জার্সির প্রতি আর কোনও মোহ নেই। যাদের কলকাতার গল্প শোনাতাম তারা বড় হয়ে ইতিমধ্যে কলকাতাকে আমার থেকে অনেক বেশি জানে।
কিন্তু একটি জিনিসের প্রতি আমার মোহ আরও বেড়েছে— মানবিক সম্পর্কের প্রতি, ভালবাসা, স্নেহের প্রতি। বহু জিনিসের মালিক হয়েও কেউ কেউ নিঃস্ব হতে পারে— যদি তাঁর কোথাও ভালবাসার সম্পর্ক না থাকে। আর যদি কোথাও তা থাকে, তবে সে স্থান হাজার ধুলো-ময়লা ভর্তি হলেও স্বর্গ!
এখন এই আমার অনুভূতি।
কলকাতায় এলে তিনটে জিনিস আমায় কিনতেই হয়— শাড়ি, মিষ্টি আর বাংলা বই। এর প্রতিটি জিনিসই অনলাইনে পাওয়া যায়। কিন্তু শহরের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে, দরদাম করে কেনার মজাই কিন্তু আলাদা।
ফুটপাতে চায়ের দোকান
চেনা শহরের ‘অচেনা’ রাস্তা
সেই কিশোরী মেয়েটি মনের কোণে কোথাও এখনও অল্প একটু কিশোরীই রয়ে গিয়েছে। আর সেখানে ছোটবেলায় প্রোথিত হয়ে যাওয়া কলকাতার মোহ— তাও কিছুটা আছে।
যে হেতু সেই মেয়েটির বয়স বেড়েছে, সাহস ও দক্ষতা বেড়েছে, তা দিয়ে সে এখন অপরিচিত কলকাতাকে একটি চেনা, নিজস্ব শহরে রূপান্তরিত করতে চায়।
আর সে কারণেই সল্টলেক থেকে একা একা ট্যাক্সি ধরে নন্দনে যাই। বাইপাস দিয়ে সেক্টর ফাইভের পাশ কাটিয়ে কারও সাহায্য ছাড়াই ক্রসওয়ার্ড, শপার’স স্টপ-এ পৌঁছই। আনন্দ পাবলিশার্স-এ গিয়ে বই কিনি, কফি হাউসের দরজায় কোনও বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করি। তার পর উড়ালপুলের উপর দিয়ে গিয়ে দক্ষিণাপণে ঢুকে যাই। আসার সময় মিত্র অ্যান্ড ঘোষ-এ নেমে আরও কিছু বই কিনি। শৈশবের দুর্গম, দুর্জয় কলকাতা ক্রমশ আমার কাছে সহজ হতে থাকে।
বিমানবন্দরের কাছে আমার এক খুড়তুতো দিদি থাকেন। শত কাজের মাঝেও ওঁরা আমাকে বিমানবন্দরে নিতে আসেন। আমার ভারী স্যুটকেস টেনে টেনে তিনতলায় তোলেন। তার পর বড়বাজারের চানাচুর আর ভীম নাগের সন্দেশ দিয়ে বলে, ‘‘তুই আসবি বলেই টাটকা কিনে আনলাম।’’ পর দিন যখন আমি বাইরে বেরোতে যাই, দিদি জিজ্ঞাসা করেন, একা পারব কি না?
আমি ফিরিস্তি দিতে থাকি বিদেশ ভ্রমণের। দিদি বলেন, ‘‘তবুও, কলকাতা একটা আলাদা ব্যাপার।’’ মনে মনে বলি, তা ঠিক। কলকাতা একটা আলাদা ব্যাপার, সে তুমি আছো বলে।
কফি হাউসে যাই, আমার বন্ধুর সঙ্গে। সে এখন বিখ্যাত লেখিকা। ঢুকতেই সবাই ফিরে তাকায়। চেয়ারে বসে গরমে হাঁসফাস করতে করতে বেয়ারাকে বলি, ‘‘ঠান্ডা কিছু আছে?’’ বেয়ারাটি এমন দুষ্টু, বলে, ‘‘গরম কফিটাকেই ঠান্ডা করে খান।’’
আমার বন্ধু জানতে চায়, ‘‘তুমি এখানে কিসে করে এলে?’’ আমি বলি, ‘‘তোমার সঙ্গে দেখা করতে কিছুটা সাঁতরে, কিছুটা উড়ে আর দৌড়ে এসেছি। জানো, মধুসূদনের তখন ভীষণ দারিদ্র। তবু বহু দূর থেকে এক জন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল বলে ওঁর শেষ সম্বল একশোটি টাকা লোকটিকে দিয়ে দিয়েছিল।’’ আমার বন্ধু বলল— আমি কিন্তু আজ ব্যাগ আনিনি। কফির দামটাও তোমাকে দিতে হবে।
আমরা হা হা করে হাসতে থাকলাম।
‘আমার শহরে’ বিদেশি সাজ
তার পর বইয়ের দোকানে যাই। বড় দু’ব্যাগ ভর্তি বই কিনি। যখন রাস্তায় পা দিতে যাব, দোকানদার ভদ্রলোক বলেন, ‘‘দিদি, রাস্তা পার হতে পারবেন তো?’’ আমি বলি জানেন, বিদেশে আমি নিজে নিজেই সব জায়গায় ঘুরে বেড়াই?
— কিন্তু সে তো কলকাতা নয়। ট্যাক্সি ডেকে ব্যাগগুলো তুলে দেব?
ভাবি, এঁরা আমাকে বড় হতে দেবেন না।
ট্যাক্সি নিয়ে বিশপ লেফ্রয় রোডে আসি। ট্যাক্সিতে ব্যাগগুলো রেখে তিনতলায় উঠতেই বুনিদি বলেন, ‘‘সে কি ব্যাগগুলো ট্যাক্সিতে রেখে এসেছ?’’ তার পর নিজে নেমে গিয়ে সেগুলো টানতে টানতে উঠিয়ে আনেন। জোর করে একটা ব্যাগ নিয়ে নিই।
এলগিন রোডে এক বোনের বাড়িতেও একটা দিন থাকতে হয়। ওরা অফিসে যাওয়ার আগে ভীম নাগ সন্দেশের দোকানের ম্যাপ এঁকে দিয়ে গেল। ছ’ বাক্স সন্দেশ নিয়ে যখন রাস্তায় এসে দাঁড়াই তখন সেখান দিয়ে সাঁ সাঁ করে গাড়ি যাচ্ছে। বিদেশে থাকার জন্য এই অজস্র গাড়ির মাঝখান দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার মানসিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। তাই এই একটি ব্যাপারেই কলকাতা আমার কাছে দুর্গম হয়েছে। অনেক ক্ষণ এ দিক ও দিক তাকানোর পর ভয়ে ভয়ে যেই পা বাড়িয়েছি, সদ্য শ্যাম্পু করা চুল হাওয়ায় চোখেমুখে এসে পড়ল, মুহূর্তের জন্য থেমে গেলাম। আর তাতেই অজস্র গাড়ি পায়ের কাছে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে থেমে যেতে থাকল। তত ক্ষণে ভয়ের চোটে চোখ বন্ধ করে ফেলেছি। কয়েক সেকেন্ড পরে শুনতে পেলাম এক জন বলছেন, ‘‘দিদি, যান যান।’’
এত কিছু চেষ্টা করার পরওশুধু রাস্তা পার হওয়াটাই যা এখনও শিখিনি!
জন্ম শিলিগুড়িতে হলেও কলকাতায় আসা হত প্রায়ই। বিবাহ সূত্রে দেশের বিভিন্ন শহর ঘুরে ফ্রান্স, জাপান হয়ে আপাতত আমেরিকাতে স্থায়ী বসবাস। প্রবাসে থেকেও নিবিড় যোগাযোগ আছে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে।
অন্যতম শখ বলতে— ধ্রুপদী গান, ভ্রমণ ও নানা দেশের ফিল্ম দেখা। সবচেয়ে ভাল লাগে মানুষের সঙ্গে মিশতে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.